১৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৯:৫৩

পদোন্নতিতে ‘ইতিহাসের সেরা’ অনিয়ম ইউজিসিতে

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)  © সম্পাদিত

দেওয়া হয়নি সার্কুলার, নেওয়া হয়নি লিখিত পরীক্ষা কিংবা ভাইভা; পদ না থাকলেও পদায়ন, কমিটির সদস্য হয়ে নিজেই নিজেকে পদোন্নতি প্রদান— এমন হ-য-ব-র-ল কাণ্ড ঘটেছে দেশের ১৭০টি পাবলিক-প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের তদারক প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)।

অভিযোগ উঠেছে, শুধুমাত্র দাবির প্রেক্ষিতে অভ্যন্তরীণ সদস্য-কর্মকর্তাদের নিয়ে গঠিত একটি কমিটির মাধ্যমে কমিশনের ২৮ কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে । আইন-নীতিমালা তোয়াক্কা না করেই সম্প্রতি কমিশনে অনুষ্ঠিত এক ‘ক্লোজ ডোর’ বৈঠকে এসব পদোন্নতি দেওয়া হয়। 

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রতিষ্ঠার পর থেকে এমন পদোন্নতির নজির নেই ইউজিসিতে। ক’দিন আগেও যে অনিয়মের জন্য বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় ও উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে দফায় দফায় নোটিশ দিয়েছিল ইউজিসি; সেই অনিয়মই এবার তারা নিজেরা করেছেন। এতে তদারক সংস্থা হিসেবে মঞ্জুরি কমিশনের নৈতিক স্থলন যেমন হয়েছে, তেমনি অনিয়মে তৈরি হয়েছে ইতিহাসসেরা নজির। বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার অভিযোগ, ‘একে তো অনিয়ম করে পদোন্নতি। তার ওপরে বিষয়টি একপেশে। ফলে এখানে নতুন বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছে। কারণ, যাদেরকে পদোন্নতি দেয়া হয়েছে; তারা নিজেদের জ্যেষ্ঠতার দাবি করার ফলে পদোন্নতি না পাওয়া কর্মকর্তাদের জ্যেষ্ঠতা ক্ষুণ্ন হয়েছে।’ 

পঞ্চম গ্রেডের উপরে কোনো পদে নিয়োগ দিতে হলে সরাসরি সার্কুলার দিতে হবে মর্মে ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে একাধিক নোটিশ দেয় ইউজিসি। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ও সমমর্যাদার চতুর্থ গ্রেডের পদসমূহে কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হবে— এ বিষয়ে ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি নির্দেশনা প্রদান করে ইউজিসি।

এর আগে পদোন্নতি প্রদানের জন্য গত ২৩ অক্টোবর ৬ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে। যেখানে ইউজিসির সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলামকে আহ্বায়ক এবং সহকারী সচিব নাসরিন সুলতানাকে সদস্য-সচিব করা হয়। এছাড়াও সদস্য হিসেবে অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক মো. রেজাউল করিম হাওলাদার, যুগ্মসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মুহম্মদ নাজমুল ইসলাম, উপসচিব (লিগ্যাল) (জেলা ও দায়রা জজ) নূরনাহার বেগম শিউলী এবং উপ-সচিব মো. আসাদুজ্জামানকে রাখা হয়। যাদের পরামর্শ অনুযায়ী ১৮ নভেম্বর এই পদোন্নতি দেয়া হয়। 

আরও পড়ুন: ‘স্বতন্ত্র পরিচয়ে’ সাত কলেজ নাকি বিশ্ববিদ্যালয় হবে?

জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন চাকরি প্রবিধানমালা ১৯৮৭’র (১৯৮৭ সালের ৩১ আগস্ট প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেট, অতিরিক্ত সংখ্যা, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন, প্রজ্ঞাপনে) ১৯ ধারা (পদোন্নতি) অনুযায়ী, ‘উপ-প্রবিধান (২)-এর বিধান সাপেক্ষে, কমিশনের সকল পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হইবে। প্রথম শ্রেণীর পদ ছাড়া, অন্যান্য শ্রেণীর পদের অনধিক ৫০% পদে পদোন্নতির মাধ্যমে পূরণ করা যাইতে পারে। প্রতিটি ক্ষেত্রে যোগ্যতার ভিত্তিতে পদোন্নতি দেওয়া হইবে এবং কোন কর্মচারী শুধু জ্যেষ্ঠতার কারণে কোন পদে বা শ্রেণীতে পদোন্নতি দাবি করিতে পারিবেন না।’

প্রবিধান অনুযায়ী, ইউজিসির ১৫৭তম সভায় অনুমোদিত কর্মচারী নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদোন্নতি নীতিমালার ৬ ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে, চাকুরী প্রবিধানমালা, ১৯৮৭ এর ধারা ১৯-এ বিধৃত কমিশনের সকল পদ সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা হইবে। তবে দ্বিতীয় শ্রেণীর পদ হইতে নিম্নতর সকল পদের অনধিক ৫০% পদে সরাসরি নিয়োগের মাধ্যমে পূরণ করা যাইবে। নীতিমালায় আরও উল্লেখ করা হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সকল পদে যথাযথ বাছাই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে এবং কমিশনের অনুমোদনক্রমে নিয়োগ দান করা হইবে।

তবে পদোন্নতি পাওয়া ২৮ কর্মকর্তার নিয়োগের ক্ষেত্রে এই বিধি অনুসরণ করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, অতিরিক্ত পরিচালক পদে নয়জন কর্মকর্তার পদোন্নতি দেয়া হলেও যুগ্মসচিব পদমর্যাদার অতিরিক্ত পরিচালকের কোন পদ খালি নেই।

অভিযোগ উঠেছে, পদোন্নতির জন্য গঠিত কমিটির একজন সদস্য হয়েও পদোন্নতি পেয়েছেন যুগ্মসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মুহম্মদ নাজমুল ইসলাম। তার পদোন্নতি প্রদানের ক্ষেত্রে কী ধরনের নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছে, সে বিষয়ে কথা বলতে কমিটির আহ্বায়ক মো. ফখরুল ইসলাম ও সদস্য রেজাউল করিম হাওলাদার এবং নূরনাহার বেগম শিউলীর সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তারা কোন সাড়া দেননি।

তবে আহ্বায়ক কমিটিতে থেকে অতিরিক্ত পরিচালক হিসেবে পদোন্নতি পাওয়া মুহম্মদ নাজমুল ইসলামের সাথে কথা হলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, কমিটির কার্যক্রম শুরুর আগেই আমাকে প্রত্যাহার করা হয়। তবে প্রত্যাহারকৃত কমিটি অনুমোদনের জন্য কোন অফিস আদেশ হয়েছে কিনা জানতে চাইলে বিষয়টি নিয়ে চেয়ারম্যানের সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন তিনি।

‘এই মুহূর্তে প্রতিটি বিষয়ে একেবারে দাঁড়ি-কমা অনুসরণ করে কাজ করার চেয়ে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করা জরুরি। আবার সিদ্ধান্তগুলো যেন আইনসিদ্ধ হয় সেটা নিয়েও আমরা সতর্ক রয়েছি। সিদ্ধান্তগুলোকে কীভাবে দ্রুত সময়ে আইনের মধ্যে নিয়ে আসা যায় আমরা সেটা নিয়েও কাজ করবো— অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ, চেয়ারম্যান, ইউজিসি

নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, পদোন্নতির এমন ‘নষ্ট সংস্কৃতি’ ভবিষ্যতেও প্র্যাকটিস হতে পারে। কারণ, এখানে আইনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হয়েছে। পদোন্নতি হয়েছে ইউজিসির নিয়মের উল্টো পথে। অর্থাৎ পদোন্নতির আইনসিদ্ধ যে নিয়ম আছে; তাতে প্রথমে ‘ওপেন সার্কুলার’; পরে আবেদন গ্রহণ এবং কয়েকধাপে পরীক্ষার মাধ্যমে প্রার্থী নির্বাচন করা হতো। পরবর্তীতে সেটাই ফুল কমিশন মিটিংয়ে গৃহীত হলে পদোন্নতি দেওয়া হতো। কিন্তু এবারের প্র্যাকটিসে আগে পদোন্নতি প্রদান এবং পরে ফুল কমিশনে নেওয়া হবে; যেখানে সার্কুলার কিংবা পরীক্ষার বালাই নেই। ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘আমার মনে হয় এখানে এমন একটা পক্ষ কাজ করেছে; যারা চেয়ারম্যানের কাছে নিয়মগুলো ভুলভাবে উপস্থাপন করে নিজ নিজ স্বার্থ উদ্ধারের চেষ্টা করছে।’

এদিকে নিয়ম ভঙ্গ করে ওই পদোন্নতির এক দিনের মাথায় (১৯ নভেম্বর) ইউজিসির অন্তত এক ডজন কর্মকর্তা-কর্মচারী একই উপায়ে নিজেদের পদোন্নয়নের জন্য আবেদন করেছেন। বিভিন্ন দাবি তুলেছেন তৃতীয় শ্রেণি এমনকি চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরাও। সূত্রের তথ্য, ওই দাবিদারও ইউজিসিতে নিজেদের যোগদানের তারিখ এবং সর্বশেষ পদোন্নতি পাওয়ার তারিখ উল্লেখ করে বৈষম্য নিরসনের দাবি জানিয়েছেন।

তাদেরই একজন দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতা বিবেচনায় আগেও আমি সরাসরি নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে পদোন্নতি পাইনি। অথচ যাদেরকে নিয়োগ দেয়া হয়েছে তারা এখন জ্যেষ্ঠতা দাবি করছে। কিন্তু আমি জ্যেষ্ঠ হয়েও বৈষম্যের শিকার হয়েছি। আবেদন জমা দিয়েছি, কিন্তু সমাধান আসবে কিনা জানা নেই।’ তার বক্তব্য, ‘নিয়ম ভঙ্গের ফলে আমি উচ্চতর পদের অভিজ্ঞতাসহ আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। তাই আমার প্রাপ্যতা ফিরিয়ে দিতেই প্রশাসনিক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য আবেদন জানিয়েছি।’

আরও পড়ুন: বেরোবিতে কর্মকর্তা পদোন্নতি: ইউজিসির নির্দেশনা না মেনে ‘গোপনে বসছে’ নিয়োগ বোর্ড

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, পঞ্চম গ্রেডের উপরে কোনো পদে নিয়োগ দিতে হলে সরাসরি সার্কুলার দিতে হবে মর্মে ২০২৩ এবং ২০২৪ সালে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় এবং উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়কে একাধিক নোটিশ দেয়। এছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয়সমূহে অতিরিক্ত রেজিস্ট্রার ও সমমর্যাদার চতুর্থ গ্রেডের পদসমূহে কর্মকর্তাদের নিয়োগের ক্ষেত্রে ইউজিসির বিদ্যমান নীতিমালা অনুযায়ী উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে নিয়োগ কার্যক্রম সম্পন্ন করতে হয়। এ বিষয়ে ২০২১ সালের ৩১ অক্টোবর সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি নির্দেশনা প্রদান করে ইউজিসি। যদিও খোদ ইউজিসির কর্মকর্তাদের এবারের পদোন্নতির ক্ষেত্রে এই নিয়ম মানা হয়নি।

ফুল কমিশন ছাড়া পদোন্নতি দেয়ার বিষয়ে ইউজিসির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এস এম এ ফায়েজ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমরা প্রতিটি বিষয়ে সতর্ক আছি। যেখানে মনে হয়েছে কোন প্রকার বৈষম্যের ঘটনা ঘটেছে সেটাই আমরা সমাধানের চেষ্টা করেছি। আমাদের এত ত্যাগ এবং রক্ত ঝরার পেছনে মৌলিক কারণ ছিল বৈষম্যমূলক আচরণ চরমভাবে বিরাজ করছিল। আন্দোলনটাই হয়েছে বৈষম্যের বিরুদ্ধে, কাজেই এখনও যদি আমরা বৈষম্য নিরসন করতে না পারি সেটা ব্যর্থতা হিসেবে বিবেচিত হবে।

আরও পড়ুন: বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি চালু নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান কী?

ইউজিসির আইনের প্রসঙ্গে চেয়ারম্যান বলেন, এই মুহূর্তে প্রতিটি বিষয়ে একেবারে দাঁড়ি-কমা অনুসরণ করে কাজ করার চেয়ে ইতিবাচক মনোভাব নিয়ে কাজ করা জরুরি। আবার সিদ্ধান্তগুলো যেন আইনসিদ্ধ হয় সেটা নিয়েও আমরা সতর্ক রয়েছি। সিদ্ধান্তগুলোকে কীভাবে দ্রুত সময়ে আইনের মধ্যে নিয়ে আসা যায় আমরা সেটা নিয়েও কাজ করবো।

পদোন্নতি পেতে পারেন ইউজিসিতে এমন আরও কয়েকজন কর্মকর্তা রয়েছেন, তাদের বিষয়ে ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাইলে অধ্যাপক ফায়েজ বলেন, সবার জন্য দরজা খোলা রয়েছে। যেকোনো কর্মকর্তা চাইলে আমার সাথে কিংবা সদস্যদের সঙ্গে কথা বলতে পারেন। সবার কথা আমরা ধৈর্যসহকারে শুনছি। যেখানে জেনুইন কিছু থাকবে; সেটা নিয়ে আমরা কাজ করব। ইউজিসিতে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করতে আমরা বদ্ধপরিকর।

প্রসঙ্গত, পদোন্নতি প্রদানের জন্য গত ২৩ অক্টোবর ৬ সদস্যের একটি আহ্বায়ক কমিটি গঠন করে। যেখানে ইউজিসির সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলামকে আহ্বায়ক এবং সহকারী সচিব নাসরিন সুলতানাকে সদস্য-সচিব করা হয়। এছাড়াও সদস্য হিসেবে অর্থ ও হিসাব বিভাগের পরিচালক মো. রেজাউল করিম হাওলাদার, যুগ্মসচিব (অতিরিক্ত দায়িত্ব) মুহম্মদ নাজমুল ইসলাম, উপসচিব (লিগ্যাল) (জেলা ও দায়রা জজ) নূরনাহার বেগম শিউলী এবং উপ-সচিব মো. আসাদুজ্জামানকে রাখা হয়। যাদের পরামর্শ অনুযায়ী ১৮ নভেম্বর এই পদোন্নতি দেয়া হয়।