ইউজিসির পরিচালক-অফিসারদের বিরুদ্ধে মামলার নেপথ্যে অভ্যন্তরীণ কর্মকর্তারা!
বেসরকারি আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির একজন শিক্ষার্থী সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সাবেক অতিরিক্ত চেয়ারম্যান, সাবেক সচিব এবং বেশকিছু কর্মকর্তাসহ মোট ৩০ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন। গত ১১ সেপ্টেম্বর ঢাকার আশুলিয়া থানায় এ মামলাটি করা হয়। তবে ইউজিসির নির্দিষ্ট কয়েকজন কর্মকর্তার নাম জড়িয়ে এমন মামলাকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
রবিউস সানি শিপু নামে ওই শিক্ষার্থীর করা মামলায় ১৪৭, ১৪৮, ১৫৩, ১২০ (বি), ৩২৩, ৩২৬, ৩০৭, ১০৯, ৩৪ পেনাল কোডে ৩০ সংযুক্ত করা হয়। তবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের সাথে ইউজিসির বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তাদের নাম জড়ানোর বিষয়টি নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন মামলায় নাম আসা ব্যক্তিরা। পাশাপাশি মামলায় ইউজিসির `ডি নথি' যুক্ত হওয়ার বিষয়েও প্রশ্ন তোলেন তারা। তারা বলছেন, ইউজিসির কোন একটি পক্ষের যোগসাজশ না থাকলে এমনটি সম্ভব না।
‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর করা মামলায় ইউজিসির ডি-নথি সংযুক্ত করার বিষয়টিকে আইনের ব্যত্যয় হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, এ ধরনের ঘটনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে ভবিষ্যতে ইউজিসির গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।’
রবিউস সানি শিপুর করা আশুলিয়া থানার ২৬ নাম্বার মামলার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মামলার এজহারে সংযুক্তি হিসেবে অন্যান্য তথ্যের সাথে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের দেয়া নোটিশ এবং ১৬ জুলাই এই নোটিশ সাইন করার কপি সংযুক্ত করা হয়েছে। তবে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর করা মামলায় ইউজিসির ডি-নথি সংযুক্ত করার বিষয়টিকে আইনের ব্যত্যয় হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, ‘এ ধরনের ঘটনা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এতে ভবিষ্যতে ইউজিসির গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়তে পারে।’
রবিউস সানী শিপুর করা মামলার সঙ্গে দাখিলকৃত গোপন অফিস নোট পর্যালোচনায় করে দেখা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের অফিস আদেশে ইউজিসি’র চারজন কর্মকর্তার স্বাক্ষর রয়েছে। তারা হলেন— ইউজিসি’র সাবেক চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত দায়িত্ব) প্রফেসর ড. মুহাম্মদ আলমগীর, সচিব ড. ফেরদৌস জামান, উপসচিব মো. আসাদুজ্জামান এবং সহকারী কাজী ইসমাইল হোসেন। এদের মধ্যে প্রথম দু’জনকে মামলায় আসামি করা হলেও অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে অফিস আদেশ জারি সঙ্গে যুক্ত বাকি দু’জন।
ইউজিসি কর্মকর্তাদের ভাষ্য, ইউজিসির ডি নথিতে মামলার সাথে সংযুক্ত হয়েছে এটা যেমন আশ্চর্যের, আবার নথিতে স্বাক্ষরকারীদের বাদ দিয়ে কোন প্রকার সংশ্লিষ্টতা না থাকা ব্যক্তিদের নাম জড়ানোর বিষয়টি প্রশ্নের জন্ম দেয়। এটা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণ হয় যে, ইউজিসির কিছু ব্যক্তি এসব ঘটনার পেছনে কাজ করছেন।
`মামলায় নিজের নাম দেখে হতবাক হয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কিংবা খোলা এসব বিষয়ে আমার জড়িত থাকার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি বন্ধের ডে নোটিশ দেয়া হয়েছে আমি সেটার অনুলিপিও পাইনি। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের পর মূলত বিষয়টি জানতে পারি। এ পর্যন্ত কোথাও কোনো মামলায় পরিবারের কোনো সদস্যের নাম যুক্ত হয়নি। বিষয়টি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু কারা এটার সাথে জড়িত, আমি বুঝতে পারছি না —মো. জামিনুর রহমান, সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক, ইউজিসি
১৬ জুলাইয়ে প্রকাশিত ইউজিসির ডি নথিটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অফিস আদেশ জারির প্রক্রিয়া শুরু হয় নির্দিষ্ট তারিখে রাত ৮ টার পরে। ফলে অফিসের অন্য কোন কর্মকর্তার এ প্রক্রিয়ায় জড়িত হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। বিষয়টি নিয়ে রবিউস সানী শিপুর সাথে কথা হলে গোপন নথির বিষয়ে তিনি এই মুহূর্তে কোন মন্তব্য করতে রাজি হননি।
ইউজিসির বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নাম জড়ানোর বিষয়টি জানতে চাইলে রবিউস সানি শিপু বলেন, ‘আমার একজন মামা আছেন, যিনি ইউজিসিতে চাকরি করেন। আমি এসব বিষয়ে তার পরামর্শ নিয়েছি।’ তবে মামার পরিচয় এবং গোপন নথি প্রাপ্তির বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এটার বিষয়ে আমি আপাতত কোন মন্তব্য করতে চাই না। কেউ যদি নির্দোষ থাকেন, মামলা প্রসিড হলে তদন্ত সাপেক্ষে তারা হয়তো খালাস পাবেন।’
এ বিষয়ে মামলার আসামি ইউজিসি’র সিনিয়র একজন কর্মকর্তা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে তাদের মধ্যে দুজন বাদে কোনোভাবেই বাকি কর্মকর্তারা এই প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত নন। তাছাড়া সরকারের দুজন মন্ত্রীর নির্দেশে অফিস আদেশ জারি করতে বাধ্য হয়েছিলেন বলে ইউজিসি’র সাবেক চেয়ারম্যান ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছিলেন। হঠাৎ রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সুযোগে ইউজিসি’র সুবিধাবাদী কয়েকজন কর্মকর্তা দ্রুত পদোন্নতির আশায় নির্দোষ সিনিয়র কর্মকর্তাদের মামলার ফাঁসিয়ে পদচ্যুত করার হীন উদ্দেশ্যে বাদীকে দিয়ে মামলা করিয়েছেন। তিনি আশা পোষণ করেন, সঠিক পুলিশি তদন্তের মাধ্যমে তারা নির্দোষ প্রমাণিত হবেন।
মামলায় নাম থাকা সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগের পরিচালক মো. জামিনুর রহমান জানান, ‘মামলায় নিজের নাম দেখে হতবাক হয়ে যাই। বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কিংবা খোলা এসব বিষয়ে আমার জড়িত থাকার কোনো সুযোগ নেই। এমনকি বন্ধের যে নোটিশ দেয়া হয়েছে আমি সেটার অনুলিপিও পাইনি। গণমাধ্যমে সংবাদ প্রচারের পর মূলত বিষয়টি জানতে পারি। এ পর্যন্ত কোথাও কোনো মামলায় পরিবারের কোনো সদস্যের নাম যুক্ত হয়নি। বিষয়টি আমাকে খুব কষ্ট দিয়েছে। কিন্তু কারা এটার সাথে জড়িত, আমি বুঝতে পারছি না।’
তবে কোন সরকারি অফিস থেকে গোপন নথি এভাবে পাবলিকলি উপস্থাপনের বিষয়ে বাংলাদেশের আইনে একটি নির্দেশনা পাওয়া যায়। আইনের ৩২ ধারা অনুযায়ী, যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা সংবিধিবদ্ধ সংস্থার কোনো ধরনের গোপনীয় বা অতি গোপনীয় তথ্য-উপাত্ত কম্পিউটার, ডিজিটাল ডিভাইস, কম্পিউটার নেটওয়ার্ক বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ বা সংরক্ষণ করেন বা সংরক্ষণে সহায়তা করেন তাহলে কম্পিউটার বা ডিজিটাল গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ বলে গণ্য হবেন।
মামলায় নাম আসা ইউজিসির দুই কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ‘১৬ জুলাই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধের অন্তত ২০ দিন পর এই মামলাটি করা হয়। এটা স্পষ্ট যে, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের অভ্যন্তরের একটি পক্ষ তাদের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য এটি করেছে। এখানে এমন ব্যক্তিদের নাম রয়েছে, যারা কোন স্তর থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ কিংবা এ ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট না। কেউ অপরাধী হলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হোক; কিন্তু এভাবে ঢালাওভাবে নাম জড়ানোটা হয়রানি এবং সামাজিকভাবে অপদস্থ করা ছাড়া কিছু নয়। তারা অভিযোগ করেন, ইউজিসির প্রথম ও দ্বিতীয় সারির কয়েকজন কর্মকর্তা অর্থের বিনিময়ে কাজটি করিয়েছেন।
যদিও অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’র অন্তর্ভুক্ত ৩২ ধারা নিয়ে বিতর্ক দেখা যায় বিভিন্ন মহলে। আইনজ্ঞরা মনে করেন, ‘এখন দুর্নীতি প্রতিরোধের জন্য তথ্য বের করা রাষ্ট্রের জন্য, জনগণের জন্য খুবই প্রয়োজন।’
এদিকে গত ১১ সেপ্টেম্বর মামলা হওয়ার পূর্বে ৯ সেপ্টেম্বর আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি, বাংলাদেশের দুজন শিক্ষার্থীর মধ্যে মামলা সংক্রান্ত কথপোকথনের একটি স্ক্রিনশর্ট দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের হাতে এসেছে। সেখানে একজন শিক্ষার্থী অপরজনকে বলতে দেখা যায়, ‘ইউজিসির এক পিএস দিয়ে ভার্সিটি যারা অফ করেছে ওদের নামে মামলা দিলে নাকি বিগ অ্যামাউন্ট পাবে, যেটা দিয়ে আমরা কক্সবাজার যাব, তুই আসস লগে?’ প্রতিউত্তরে অপরজন রাজি না থাকার কথা জানান।
বিষয়টি নিয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির একজন কর্মকর্তা বলেন, কাজগুলোর সাথে কারা জড়িত সেটা আমরা জানি। রবিউস সানি শিপুর বিষয়ে আমরা মর্মাহত। তবে মামলা এবং সাম্প্রতিক কিছু বিষয়ে সুবিধাবাদী মহল ছেলেটাকে ব্যবহার করছে। সম্প্রতি তাকে দিয়ে একটি সংবাদ সম্মেলন করানো হয়েছে, সেখানেও ইউজিসির কয়েকজন কর্মকর্তা জড়িত আছেন। আগের বিষয়গুলো এবং অর্থ লেনদেনের বিষয়গুলোও একইরকম।
ইউজিসির সাবেক সচিব ড. ফেরদৌস জামানের সাথে কথা হলে তিনি জানান, ‘আমি দায়িত্ব ছাড়ার সময় সাইটের পাসওয়ার্ড দিয়ে দিয়েছি। কারা এটা করেছে বিষয়টি বলতে পারছি না। তবে এটি স্পর্শকাতর। বর্তমান প্রশাসন যারা আছে তারাই ভালো জানবেন।’
ইউজিসির একটি সূত্র জানায়, গোপন নথি প্রাপ্তির জন্য সাইটের পাসওয়ার্ড আবশ্যক। সচরাচর চেয়ারম্যান, সচিব, তাদের পিএস এবং প্রশাসন শাখার কয়েকজন কর্মকর্তার কাছে এই পাসওয়ার্ড সংরক্ষিত থাকে। তবে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে ইউজিসির বর্তমান সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলামের সাথে একাধিকবার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার মন্তব্য পাওয়া যায়নি।
‘অনেককে উদ্দেশ্যমূলক ভাবে জড়ানো হয়েছে। আমার সম্পূর্ণ বিষয়টি সচেতনভাবে তদন্ত করছি। এজন্য ইউজিসি একজন কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করেছে। পুলিশ প্রশাসনও বিষয়টি তদন্ত করছে। বিনা কারণে কেউ যাতে শাস্তির মুখোমুখি না হয়, সেটি নিশ্চিতে ইউজিসি কাজ করছে— অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ, চেয়ারম্যান, ইউজিসি
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এস এম এ ফায়েজ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘এখানে যাদের নাম যুক্ত করা হয়েছে তারা সবাই প্রকৃত দোষী না। অনেককে উদ্দেশ্যমূলকভাবে জড়ানো হয়েছে। আমরা সম্পূর্ণ বিষয়টি সচেতনভাবে তদন্ত করছি। এজন্য ইউজিসি একজন কর্মকর্তাকে নিযুক্ত করেছে। পুলিশ প্রশাসনও বিষয়টি তদন্ত করছে। বিনা কারণে কেউ যাতে শাস্তির মুখোমুখি না হয়, সেটি নিশ্চিতে ইউজিসি কাজ করছে।’
মামলার নথিতে ইউজিসির ডি নথি যুক্তের বিষয়ে তিনি জানান, ‘আমরা জানি না বিষয়টি কীভাবে সেখানে গেল। ‘ডি নথি’ সংগ্রহের অ্যাকসেস অল্প কয়েকজনের কাছে থাকে। আমরা এটিও খতিয়ে দেখার চেষ্টা করছি কারা এখানে জড়িত।’