উচ্চশিক্ষায় সুশাসনের দায়িত্বে থেকে নিজেই নানা অপকর্মে জড়ান ড. সাজ্জাদ
দেশের উচ্চশিক্ষায় সুশাসন নিশ্চিতে কাজ করে যাচ্ছে সরকারি প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)। সরকারি এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকারী এই সংস্থায় একজন চেয়ারম্যান ও ৫ জন পূর্ণকালীন সদস্য রয়েছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর পদত্যাগ করেছেন সংস্থাটির চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুল্লাহ।
অন্যদিকে, সরকার পতনের পর ইউজিসির কয়েকজন সদস্য নিয়মিত অফিসে উপস্থিত থাকছেন না। কোনো কোনো সদস্য এখন পর্যন্ত এক থেকে দুইদিন ইউজিসিতে এসেছেন। ফলে ইউজিসির নিয়মিত কার্যক্রম বিঘ্নিত হচ্ছে বলে জানা গেছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন ও মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে ইউজিসি। সেই সম্মেলন থেকে তিনি কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, নানা সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা বলে একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোটি কোটি টাকা স্পনসর আনতেন তিনি।
নিয়মিত অফিসে অনুপস্থিত সদস্যের মধ্যে অন্যতম পূর্ণকালীন সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন। কমিশনের আইএমসিটি এবং রিসার্চ সাপোর্ট এন্ড পাবলিকেশন ডিভিশনের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি।
উচ্চশিক্ষায় সুশাসনের দায়িত্বে থেকে নিজেই নানা অপকর্মে জড়ান ড. সাজ্জাদ। এ নিয়ে সব সময় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে থাকতেন তিনি। এ কারণে সরকার পতনের পর তিনি অফিসে আসতে চাইলেও তাকে ইউজিসির কর্মকর্তাদের তোপের মুখে পড়তে হয়েছে। ফলে অফিসে আসতে পারেননি তিনি। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি ছুটি নিয়েছেন বলে জানা গেছে।
আরও পড়ুন: ডা. জাফরুল্লাহ’র মৃত্যুর ১০ দিনের মাথায় দখল গণস্বাস্থ্যের মেডিক্যাল কলেজ
অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেন বিগত জোট সরকারের আমলে জামায়াত ইসলামী নিয়ন্ত্রিত চট্টগ্রামের আন্তর্জাতিক ইন্টারন্যশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি (আইআইইউসি) থেকে তার কর্মজীবন শুরু হয়েছিল। সেখানে তিনি বেশ কয়েক বছর শিক্ষকতা করেন। এরপর সেখান থেকে যুক্তরাষ্ট্রে পিএইচডি করতে যান। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুর দিকে রাজধানীর ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ-এ (ইউল্যাব) অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। তবে তিনি কি যোগ্যতায় সেখানে অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন, সেটি নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে। জানা যায়, সেসময় আওয়ামী লীগ এবং সরকারের প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলায় তাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি ।
২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে প্রথমবারের মতো বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ৪ বছরের জন্য ইউজিসির পূর্ণকালীন সদস্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন। এরপর ২০২৩ সালে দ্বিতীয় মেয়াদে ফের দায়িত্ব পান।
জানা যায়, অধ্যাপক সাজ্জাদের আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেউ ইউজিসির সদস্য পদে নিযুক্ত হননি। সদস্য পদে নিযুক্ত হওয়ার পরে ‘অদম্য বাংলাদেশ’ নামে শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনাকে নিয়ে তার লেখা একটি বই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাধ্যতামূলক ক্রয়ের জন্য নোটিশ পাঠাতেন তিনি। কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে তারা বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
দুইজন সদস্য ছুটিতে আছেন। এরমধ্যে ড. বিশ্বজিৎ চন্দের মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ মাসেই। আর কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় সচলের জন্য নোটিশ দিয়েছি-ড. মো. ফখরুল ইসলাম, সচিব, ইউজিসি
অধ্যাপক সাজ্জাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, ইউজিসি কর্তৃক আয়োজিত শিক্ষক, কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে আয়োজিত বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও প্রশিক্ষণে অংশ নিয়ে আওয়ামী লীগের গুণগান করে সময় কাটাতেন। বিষয়টি নিয়ে এতদিন ক্ষুব্ধ থাকলেও ভয়ে কেউ মুখ খোলেননি।
জানা গেছে, ড. সাজ্জাদের বাড়ি চট্টগ্রাম হওয়াতে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে তোলেন তিনি। পরে নওফেলের সুপারিশে তাকে ইউজিসির সদস্য হিসেবে নিয়োগ করা হয়। তবে ইউজিসির সদস্য হিসেবে ড. সাজ্জাদের যোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন থাকলেও পরপর দুই মেয়াদে তিনি নিয়োগ পান।
এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ড. সাজ্জাদ বিএনপি-জামায়াতের সময়ও সুবিধা নিয়েছেন এরপর আওয়ামী লীগের সময়েও। শুধুমাত্র নওফেলের সুপারিশে তিনি ইউজিসিতে আসতে পেরেছেন। তার আর কোনো যোগ্যতা ছিল না। অথচ তার চেয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক জ্যেষ্ঠ অধ্যাপক এ পদে আসার মতো ছিলেন। তিনি এ পদে এসে সরকার ও আওয়ামী লীগের গুণগান ছাড়া কোনো কিছুই করতে পারেননি বলে মনে হয়েছে আমার। এমনকি আমি একটি অনুষ্ঠানে এটা নিয়ে প্রতিবাদও করেছিলাম।
‘আমি অনেক ছুটি পাওনা রয়েছি। যেহেতু আমার মেয়াদ শেষ, তাই শেষের কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়েছি-ড. বিশ্বজিৎ চন্দ, সদস্য ইউজিসি
নাম প্রকাশ না করার শর্তে ইউজিসির একজন সিনিয়র কর্মকর্তা জানান, অধ্যাপক সাজ্জাদের যে যোগ্যতা সে অনুযায়ী তিনি সদস্য হওয়ার কথা না। বিশেষ সুপারিশে তিনি সদস্য হয়েছিলেন। এমনকি ইউজিসির বিভিন্ন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সাথে বিভিন্ন সময় খারাপ আচরণ করেছেন। অনেকের পদোন্নতি আটকে দিয়েছিলেন। ফলে সবাই তার উপর ক্ষুব্ধ।
২০২১ সালের শেষের দিকে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উদ্যাপন ও মুজিববর্ষ উপলক্ষ্যে ৪র্থ শিল্প বিপ্লবের ওপর একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন করে ইউজিসি। সেই সম্মেলন থেকে তিনি কয়েক কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছন বলে অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয়, নানা সময়ে বিভিন্ন অনুষ্ঠান আয়োজনের কথা বলে একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কোটি কোটি টাকা স্পনসর আনতেন তিনি।
অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ
তাছাড়া ‘অদম্য বাংলাদেশ’ নামে তার লেখা বই কিনতে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে চাপ প্রয়োগ করতে তিনি। ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তার লেখা এই বইটি শত শত কপি কিনতে বাধ্য হয়েছিল বলে জানা গেছে। এ বিষয়ে অধ্যাপক ড. সাজ্জাদ হোসেনের সাথে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে তিনি কোনো সাড়া দেননি।
অধ্যাপক সাজ্জাদের আগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কেউ ইউজিসির সদস্য পদে নিযুক্ত হননি। সদস্য পদে নিযুক্ত হওয়ার পরে ‘অদম্য বাংলাদেশ’ নামে শেখ মুজিবুর রহমান এবং শেখ হাসিনাকে নিয়ে তার লেখা একটি বই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বাধ্যতামূলক ক্রয়ের জন্য নোটিশ পাঠাতেন তিনি।
ইউজিসির আরেক পূর্ণকালীন সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় বিভাগে দায়িত্ব পালন করতেন। জানা যায়, ড. বিশ্বজিৎ চন্দের বাবা নারায়ণ চন্দ্র চন্দ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে দুই মেয়াদে মন্ত্রিত্ব পালন করেন। প্রথমে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রী এবং ২০২৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরায় সরকার গঠন করলে তিনি ভূমিমন্ত্রীর দায়িত্ব পান।
জানা যায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের এই অধ্যাপক মূলত বাবার প্রভাবে ইউজিসির সদস্য হয়েছিলেন। ইউজিসিতে তার মেয়াদ শেষ হবে চলতি আগস্ট মাসে। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনিও বর্তমানে ছুটিতে আছেন।
আরও পড়ুন: ১৫ দিন ধরে আইসিইউতে তিনি, পরিবার খুঁজছে ঢামেক হাসপাতাল
ড. বিশ্বজিৎ চন্দের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, ‘আমি অনেক ছুটি পাওনা রয়েছি। যেহেতু আমার মেয়াদ শেষ, তাই শেষের কয়েকদিনের জন্য ছুটি নিয়েছি।’
বর্তমানে ইউজিসির চেয়ারম্যানের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ আলমগীর। গতকাল বুধবার (২৯ আগস্ট) তার অফিসে গেলে তাকে পাওয়া যায়নি। পরে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি কোনো সাড়া দেননি।
জানতে চাইলে ইউজিসির সচিব ড. মো. ফখরুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানান, দুইজন সদস্য ছুটিতে আছেন। এরমধ্যে ড. বিশ্বজিৎ চন্দের মেয়াদ শেষ হচ্ছে এ মাসেই। আর কমিশনের পক্ষ থেকে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় সচলের জন্য নোটিশ দিয়েছি। এছাড়া কোথাও কোনো ক্ষতি হলে সেটা সমাধানের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর চাহিদা সাপেক্ষে আমরা ব্যবস্থা গ্রহণ করব।