ফুলের রাজ্য গদখালী
কালের সাক্ষী হয়ে শত বছরের ইতিহাস নিয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে অসংখ্য বৃক্ষ। দু’ধারে সগর্বে দাঁড়িয়ে থাকা এ বৃক্ষরাজির বুক চিরে চলে গেছে বাংলাদেশ-ভারতের সংযোগস্থল যশোরের বোনপোল রোড। অজগর সাপের মতো আঁকাবাঁকা চকচকে চওড়া রোডের উপর দিয়ে যাওয়ার আনন্দ হঠাৎ থমকে গেলে ইতিহাসে।
মনে পড়ে গেল হাজার হাজার মুক্তিযোদ্ধার সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার দৃশ্য। কতশত মুক্তিযোদ্ধা আর শরণার্থীর গড়ে উঠা ক্যাম্প। ঘুরে বেড়ানো অনেক নেতা, কবি-সাহিত্যিকেদের। গর্বের কল্পনায় আচ্ছন্ন আমার সাথে বাস কন্ডাকদারের কি শত্রুতা জানিনা। তবুও তিনি গদখালী নামেন বলে চিৎকার করে আমার সমস্ত চিন্তার ইতি ঘটালেন।
যশোর শহর থেকে ২৫ কিলো. পাড়ি দিয়ে গদখালী বাজারে পৌঁছানোর পরে ভাবলাম বাহ! চলে এসেছি। কিন্তু না, আমার গন্তব্য পৌঁছাতে এখনো ৩ কিলো. রাস্তা বাকি। এ দূরত্বটা ভ্যানে করে পাড়ি দিতে হবে। দূরত্বটা শুধু বলাতেই সীমাবদ্ধ। কেননা, এ দূরত্বের রাস্তায় যতদূর যাবেন ততদূর রাস্তার দু’পাশে শুধু ফুল আর ফুল দেখতে পাবেন। মনে হয় ফুলের গালিচায় মোড়ানো স্বপ্নের দুয়ার। মুগ্ধ নয়নের চাহনিতে উপভোগ করছি পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জিনিসের সৌন্দর্য আর ভাবছি স্বর্গ বুঝি এর থেকেও বেশি সুন্দর?
ফুল এমন এক জিনিস যাকে বলা হয় স্রষ্টার উপহার। সাধারণ উপহার পেলে সবার কতই না ভালো লাগে। সেখানে স্রষ্টার উপহার বলে কথা ভালো লাগাটা যেন কল্পনার অতীত। তাইতো, একটা-দুইটা ফুল দেখলেই সবার মনের মধ্যে আনন্দের খই ফুটে। সেখানে রাশি রাশি ফুলের বাগিচা যখন নিজের চোখের সামনে ধরা দিবে তখন মনে হবে স্বপ্ন দেখছি না বাস্তব। একটা কথা আছে কিছু বাস্তব স্বপ্নকেও হার মানায়, গদখালীর এ চিত্র দেখে সেটা যথার্থই মনে হলো।
যাই হোক, দু’ধারে শুধু ফুল না, গালিচা বিছানো যে রাস্তা দিয়ে আমরা যাচ্ছিলাম সে রাস্তাটা এতটাই রঙিন, মনে হলো এই মাত্র এক পশলা বৃষ্টিতে সাত রঙের রংধনু আবির মাখিয়ে রেখেছে। আনন্দে ডুবতে ডুবতে যখন গদখালী ফুলের রাজ্যে এসে পৌঁছালাম তখন আবারো মাথায় ভাবনা জন্মালো রাজ্যের সীমানা দেখে মনে যদি এতটা খুঁশি জাগে তাহলে রাজ্য দেখলে কেমন হবে। যেমন ভাবনা তেমন প্রতিফলন, রাজ্যের ভেতরে ফুলের সমারোহ দেখে আনন্দের ব্যস্ততা যেন ক্লান্ত করে ফেলল আমাকে।
যেদিকে তাকাই শুধু ফুল আর ফুল। বাতাসে দোল খাচ্ছে গোলাপ, সূর্যমুখি, গাঁদা, জারবেরা, গ্লাডিওলাস, চন্দ্রমল্লিকা, রজনীগন্ধাসহ নাম না জানা অসংখ্য রাণীরা। এসব ফুলের সুবাস শুধু নাকে না মনেও উতলা আবাস সৃষ্টি করেছে।
যশোর শহর থেকে সকাল ১১ টায় বের হয়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে সময় লাগলো ১ ঘন্টা ২৫ মিনিট। তারপর, ২ ঘন্টা ঘোরাঘুরি করতে করতে সূর্যের তপ্ত রোদ মাথার উপরে এসে ভিজিয়ে দিয়েছে গোটা শরীর। এত সময় মনের আনন্দে খেয়ালই করা হলো না শরীরের এ অবস্থা। ঠিক তখন একটু মৃদু হাসিতে বোকা মনকে আনন্দের স্রোতে হারিয়ে দিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম এবার যেতে হবে। সময় হলে সবকিছুই ইতিহাসে সাক্ষী হয়। কালের গহ্বরে সবকিছুই স্মৃতি হয়ে যায় এইটাও তার বাহিরে নয়।
ঘোরাঘুরি সময় ১০০ টাকায় কেনা ১০০ গোলাপ, ৪০ টাকা কেনা গোলাপ, জারবেরা, চন্দ্রমল্লিকায় মোড়ানো বিশেষ মালা ততক্ষণে কিছুটা মলিন হতে শুরু করলো। এরপর, রাজ্যের বাহিরে এসে চোখে পড়লো প্রচুর নার্সারি। সেখানে গিয়ে কিছু রাণীকে যুক্ত করলাম আমাদের সঙ্গী হিসেবে। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ার আগে সোনালী বিকেলে রুমে এসে পৌঁছালাম। তারপর আবারো ভাবনার জন্ম কিভাবে সৃষ্টি হলো এই রাজ্যের?
কথিত আছে, ১৯৮২ সালে যশোর জেলার ঝিকরগাছা উপজেলার গদখালি ইউনিয়নে ছোট্ট একটি নার্সারির মাধ্যমে ফুলের চাষ শুরু করেন শের আলী সরদার নামে এক কৃষক। দেশে বাণিজ্যিকভাবে ফুলচাষের পথিকৃৎ বলা যায় তাঁকেই। তাঁর সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়েই গদখালি এলাকায় সাড়ে পাঁচ হাজারেরও বেশি চাষি ঝুঁকেছেন ফুল চাষে।
বর্তমানে, যশোর শহর থেকে প্রায় পঁচিশ কিলোমিটার দূরের এ ইউনিয়ন বিখ্যাত হয়েছে ফুল চাষের কারণে। এ ইউনিয়নের পানিসারা, হাড়িয়া, কৃষ্ণচন্দ্রপুর, পটুয়াপাড়া, সৈয়দপাড়া, মাটিকুমড়া, বাইসা, কাউরা, ফুলিয়া ইত্যাদি গ্রামের প্রতি ইঞ্চি জমি চাষিরা কাজে লাগিয়েছেন ফুল চাষে। বছর জুড়ে উৎপাদন হচ্ছে দেশী বিদেশী নানা জাতের ফুল যার বার্ষিক বাজার মূল্য প্রায় দেড় হাজার কোটি টাকা। এই গ্রামের ফুল সারাদেশ তো বটেই, যাচ্ছে বিদেশেও।
ভাবনার অন্ত শেষ হতে না হতে জরুরী কাজে নিজেকে ব্যাস্ত হতে হলো। ব্যাস্ততার আড়ালে হারিয়ে গেলে আরো এক স্বপ্নীল স্মৃতি। তবে, এধরণের স্মৃতি চিরজীবনের তৃপ্তি হয়েই থাকে।