এই শীতে ঘুরে আসুন প্রাকৃতিক লীলাভূমি নিঝুম দ্বীপ
ঘুরে বেড়ানোর জন্য বাংলাদেশেই রয়েছে অনেকগুলো সুন্দর, মনমাতানো জায়গা। আর যদি আপনি হন প্রকৃতিপ্রেমিক, তাহলে নোয়াখালীর নিঝুম দ্বীপ রয়েছে আপনার জন্যই।
নানা বৈচিত্র্যে ভরপুর এ দ্বীপ এখন বাংলাদেশের অন্যতম ভ্রমণকেন্দ্র। এটি নোয়াখালী জেলার হাতিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে ওঠা ছোট্ট একটি ভূ-খণ্ডে অবস্থিত। ‘দ্বীপ’ বলা হলেও এটি মূলত একটি ‘চর’। এক সময় এটিকে চর ওসমান বা বল্লার চরও বলা হতো। এছাড়াও এর আরও বেশ কিছু নাম রয়েছে; যেমন- কামলার চর, চর ওসমান ও চর মুরি। বেশ কয়েকটি ছোট চরের সমন্বয়ে ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে এ দ্বীপাঞ্চলটি জেগে ওঠে, যার আয়তন প্রায় ১৪,০৫০ একর। ১৯৫০ সালের শুরুর দিকে নোয়াখালী জেলার দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের অগভীর এলাকায় উত্তর দীপপুঞ্জে একটি ক্লাস্টার আবির্ভূত হয়। এই নতুন স্যান্ডব্যাংকগুলোকে প্রথমে জেলেদের একটি গোষ্ঠী আবিষ্কার করে। পরে ১৯৭৯ সালে সাবেক মন্ত্রী আমিরুল ইসলাম কালাম এটিকে নিঝুম দ্বীপনামে নামকরণ করেন।
১৯৭০ খ্রিস্টাব্দের আগপর্যন্ত এখানে কোনো লোকবসতি ছিলো না, তাই দ্বীপটি নিঝুমই ছিলো। পরবর্তীতে সত্তরের দশকে বন বিভাগের কার্যক্রম শুরু হয়। প্রথমে পরীক্ষামূলকভাবে চার জোড়া হরিণ ছাড়া হয় এখানে। নিঝুম দ্বীপ এখন হরিণের অভয়ারণ্য। ১৯৯৬ সালের হরিণশুমারি অনুযায়ী হরিণের সংখ্যা ছিলো ২২,০০০।
এ দ্বীপের প্রধান আকর্ষণ হচ্ছে চিত্রা হরিণ। তাই হরিণের খোঁজে বেশীরভাগ মানুষ এখন পারি জমায় নিঝুম দ্বীপে। এ বনে আরো আছে উদ্বিড়াল, মেছো বাঘ, খেকশিয়াল ইত্যাদি। দ্বীপে পাখিদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো নিশি বক, কানি বক, গোবক, পানকৌড়ি, ধূসর বক, কাদাখোঁচা, বালিহাঁস, লালপা, নানা জাতের মাছরাঙ্গা ইত্যাদি। রয়েছে মারসৃপারি নামে এক ধরনের মাছ, যাদেরকে উভচর প্রাণী বলা হয়। ৫ বছর পর্যন্ত বাঁচে এ মারসৃপার। ৬-৯ ইঞ্চি পর্যন্ত লম্বা হয় এগুলো।
বর্ষা মৌসুমে ইলিশের জন্য নিঝুম দ্বীপ বিখ্যাত। এ সময় ঢাকাসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকাররা নিঝুম দ্বীপে মাছ কিনতে আসে। এছাড়া শীত কিংবা শীতের পরবর্তী মৌসুমে নিঝুম দ্বীপ চেঁউয়া মাছের জন্য বিখ্যাত। জেলেরা এ মাছ ধরে শুঁটকি তৈরি করেন। এ শুঁটকি মাছ ঢাকা, চট্টগ্রাম, চাঁদপুরসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাইকারদের কাছে বিক্রি হয় ৩০-৩৫ টাকা কেজি দরে। আবার এই শুঁটকি হাঁস-মুরগীর খাবারেও ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও শীতকালে শত শত প্রজাতির অতিথি পাখি আসে এই দ্বীপে। নিঝুম দ্বীপে রয়েছে প্রায় ৩৫ প্রজাতির পাখি। জোয়ারের পানিতে বয়ে আসা বিভিন্ন প্রজাতির মাছ এদের একমাত্র খাবার। পাখি বা হরিণ দেখতে হলে খুব ভোরে উঠতে হবে। হরিণ মূল দ্বীপেই স্থানীয় গাইডদের সাথে গিয়ে দেখে আসতে পারবেন। তবে পাখি দেখতে হলে ট্রলারে করে পার্শ্ববর্তী দ্বীপগুলোতে যেতে হবে, সেক্ষেত্রে অনেক কষ্ট করতে হবে। অনেক কাঁদা মাটি পেরিয়ে যেতে হবে সেখানে। কিন্তু যাওয়ার পর আপনার সব কষ্ট নিমিষেই চলে যাবে।
নিঝুম দ্বীপে থাকার কোনো সমস্যা নেই। দ্বীপের মূল জনবসতির নাম হলো ‘নামার বাজার’। এখানকার পর্যটন রিসোর্টে আপনি নিশ্চিন্তে থাকতে পারবেন। ভাড়া পড়বে রুমপ্রতি ৫০০ থেকে ১,৫০০ টাকা পর্যন্ত। পাঁচ বেডের ডরমিটরি রুম আছে, ভাড়া তুলনামূলক কম। এছাড়া বাজারে হোটেল শাহীনে থাকতে পারবেন, যদিও খরচ তুলনামূলকভাবে বেশি পড়তে পারে। বাজারেই আছে মসজিদ বোর্ডিং। এখানে খুবই কম খরচে থাকা যাবে, তবে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। পুরো দ্বীপেই সীমিত সময়ের জন্য সোলার প্যানেল অথবা জেনারেটর ব্যবহার করে বিদ্যুৎ সরবরাহ করা হয়। কাজেই বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম বুঝে-শুনে ব্যবহার করাই ভালো। নাহলে শূন্য চার্জে বাড়ি ফিরতে হতে পারে। দ্বীপে থাকতে পারেন সরকারি উপজেলা কমপ্লেক্স অথবা বন বিভাগের ডাকবাংলোতেও। তবে পরিচিত কেউ থাকলে এগুলোর জন্য আগে থেকে অনুমতি নিয়ে রাখা উচিৎ। আর ক্যাম্পিং করতে চাইলে মূল দ্বীপেই করা ভালো। স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, আশপাশের চরগুলোতে মাঝেমধ্যে ডাকাত বা জলদস্যুরা হানা দিয়ে থাকে। তবে বর্তমানে প্রশাসনের সজাগ দৃষ্টির কারণে জলদস্যুদের প্রকোপ অনেকটাই কমে গিয়েছে।
নিঝুম দ্বীপে হরিণ দেখতে হলে ভ্রমণকালীন সময়ে কিছু বিষয়ের প্রতি অবশ্যই লক্ষ্য রাখা উচিত। বনে চলাচলের সময় একদম নিঃশব্দে চলতে হবে। কোনো প্রকার শব্দ অথবা উচ্চ গলায় কথা বলা যাবে না। কারণ বনের পশু পাখিদের যেকোনো শব্দ শোনার তীব্র ক্ষমতা রয়েছে। সামান্য হৈচৈ করলেই এখানে হরিণের দেখা পাওয়া কঠিন হয়ে পড়ে। জঙ্গলে ট্রেকিংয়ের সময় যথাসম্ভব সবাই হালকা রংয়ের সুতি পোশাক পরিধান করবেন। বন্য প্রাণীদের দৃষ্টিও খুব প্রখর হয়ে থাকে। অতি উজ্জ্বল পোশাকের পরিধানের কারণে দূর থেকেই বন্যপ্রাণীরা তাঁদের শিকার দেখে ফেলে। তবে নিঝুম দ্বীপে হরিণ এবং মহিষ ছাড়া অন্য কোনো হিংস্র প্রাণী নেই। তাই ভয় পাবার কোনো কারণ নেই।
পর্যটকদের খাবারদাবারের জন্য স্থানীয় নামার বাজারে সব রকমের সুব্যবস্থা রয়েছে। এখানে সকালের নাস্তা থেকে শুরু করে দুপুর ও রাতের খাবার, চা, বিস্কুট সবকিছুই পাওয়া যায়। তাছাড়াও এখানে যে খাবার খেয়ে আপনি সবচেয়ে বেশি মজা পাবেন সেটা হচ্ছে মাছ। কারণ এখানে প্রতি বেলায় আপনি একদম তাজা মাছের তরকারী অথবা মাছ ভাঁজা খেতে পারবেন। আপনি চাইলে বার-বি-কিউও করতে পারবেন।
নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার জন্য আগে থেকেই সবধরনের প্রস্তুতি নিয়ে রাখা ভালো। যেমন- কী পোশাক নিবেন, যদি শীতের মৌসুমে নিঝুম দ্বীপ ভ্রমণে যান, তাহলে সঙ্গে নিতে হবে পর্যাপ্ত শীতের কাপড়, কান টুপি, রোদ টুপি, ভালো গ্রিপের জুতা, হেড ল্যাম্প কিংবা টর্চ লাইট, বাইনোকুলার অবশ্যই সঙ্গে নিবেন, ক্যামেরা, জুম লেন্স, দরকারি ওষুধ, ওরস্যালাইন, পতঙ্গনাশক ক্রীম ইত্যাদি।
ঢাকা থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সহজ রুটটি হলো সদরঘাট থেকে লঞ্চে হাতিয়ার তমরুদি। এ পথে দুটি লঞ্চ নিয়মিত চলাচল করে। একটি হচ্ছে এমভি পানামা-২ এবং অন্যটি এমভি টিপু-৫। ভাড়া ডাবল কেবিন ১৫০০ টাকা, সিঙ্গেল ৮০০ টাকা। ডেকে জনপ্রতি ২২০ টাকার মতো হবে। লঞ্চ ঢাকা থেকে ছাড়ে বিকেল সাড়ে ৫ টায় আর তমরুদি থেকে ঢাকার উদ্দেশ্যে ছাড়ে দুপুর সাড়ে বরোটায়। লঞ্চ সব সময় একদম ঠিক সময়ে ছাড়ে। কাজেই এ ব্যাপারে সতর্ক থাকবেন। এটা নিঝুম দ্বীপের এক প্রান্ত, আসল গন্তব্য অন্য প্রান্তের নামা বাজার। এছাড়াও আপনি যদি বাসে যেতে চান তাহলে ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে প্রতিদিন ভোর থেকে রাত পর্যন্ত অনেকগুলো চেয়ারকোচ সরাসরি নোয়াখালীতে যাতায়াত করে। চার থেকে সাড়ে চার ঘন্টায় এগুলো সরাসরি মাইজদী সোনাপুর এসে পৌঁছে যাবে। ভাড়া ২৫০ টাকার মতো নিবে। সকাল সাতটায় কমলাপুর থেকে ছাড়ে উপকূল এক্সপ্রেস ট্রেন। নোয়াখালীর সোনাপুর পৌঁছে সেখান থেকে যেতে হবে চেয়ারম্যান ঘাট। বাস, টেম্পু বা বেবী ট্যাক্সিতে করে সরাসরি ৪০ কি.মি. দক্ষিণে সুধারামের শেষ প্রান্তে চর মজিদ স্টিমার ঘাট। তারপরেই হাতিয়া যাবার চেয়ারম্যান ঘাট। সোনাপুর থেকে একটি বেবী ট্যাক্সি রিজার্ভ নিলে ৩০০-৪০০ টাকায় যাওয়া যায়। টেম্পো, বাসে জনপ্রতি ভাড়া আরো কম। চর মজিদ ঘাট থেকে ট্রলার কিংবা সী-ট্রাকে করে হাতিয়া চ্যানেল পার হয়ে যেতে হবে হাতিয়ার নলচিরা ঘাটে, সময় লাগে প্রায় দু’ঘন্টা। নলচিরা বাজার থেকে যেতে হবে হাতিয়ার দক্ষিণে জাহাজমারা। জাহাজমারা থেকে ট্রলারে সরাসরি নিঝুম দ্বীপ। তবে দলবেঁধে গেলে ট্রলার রিজার্ভ করে সরাসরি চেয়ারম্যান ঘাট থেকে নিঝুম দ্বীপ যাওয়া যায়। ঘাট থেকে নদীপথে হাতিয়া অথবা নিঝুম দ্বীপে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে জোয়ারের জন্য। অন্যান্য অঞ্চলে যাতায়াত করতে হলে জোয়ার-ভাটার উপর নির্ভর করেই চলতে হয় নিঝুম দ্বীপের মানুষদের।
নিঝুম দ্বীপে বর্ষাকালে গেলে কাঁদায় গোসল করতেই হবে, যদিও এতে একধরনের আনন্দ রয়েছে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্তই আমাদের উপভোগ করা উচিত। কিন্তু গ্রীষ্মকালে গেলে ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের ভয় তো থাকবেই। এ ভয়ে আনন্দ করার কথাও ভুলে যেতে পারেন। সে সময়ে নিজেকে দুধর্ষ অভিযাত্রীর মতো মনে হবে। কারণ এপ্রিল থেকে সাগর ধীরে ধীরে অশান্ত হতে থাকে এবং তখন ঢেউয়ের উচ্চতাও অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। ট্রলারে চড়ে বিক্ষুদ্ধ সে সাগর পাড়ি দিতে প্রয়োজন অনেক সাহসের। তাই নিঝুম দ্বীপ যাওয়ার সবচেয়ে উপযুক্ত সময় হচ্ছে শীতকাল।
শীত মৌসুমে সাগর শান্ত থাকলেও বছরের যেকোনো সময় এখানে আসা যায়। যারা উচ্ছাস, উচ্ছলতা আর রোমাঞ্চে জীবনকে অর্থবহ ও স্মরণীয় করতে চান, তারা নিঝুম দ্বীপকে ঘিরে সেই আশার ষোলকলা পূর্ণ করতে পারেন। আর যদি আপনি হন অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়, তাহলে কথা দিচ্ছি নিঝুম দ্বীপ আপনাকে একদমই নিরাশ করবে না। নিঝুম দ্বীপে যাওয়াটা বেশ সময় ও শ্রমসাপেক্ষ, তাই বয়স্ক অথবা কম বয়সীদের সেখানে না নিয়ে যাওয়াই ভালো। আর দেরি না করেই আজকেই বন্ধুদের সাথে পরিকল্পনা করে ফেলুন। দেখে আসুন নিস্তব্ধ নিঝুম দ্বীপের অকল্পনীয় সৌন্দর্য, মনের ক্যানভাসে যোগ করে নিন স্বদেশের আরেকটি চমৎকার আল্পনা।