ষাট গম্বুজ মসজিদ: উপমহাদেশে মুসলিম স্থাপত্যের প্রাচীন নিদর্শন

ষাট গম্বুজ মসজিদ
ষাট গম্বুজ মসজিদ  © আহ্সান হাবীব

মুসলিম স্থাপত্যের প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে পরিচিত ষাট গম্বুজ মসজিদ। বাগেরহাট শহরের সাত কিলোমিটার পশ্চিমে খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়কের উত্তর পাশে সুন্দরঘোনা গ্রামে ঐতিহ্যবাহী  এ মসজিদটির অবস্থান। মসজিদটির গায়ে কোন শিলালিপি না থাকায় এটি কে কখন নির্মাণ করেছিলেন সে সম্বন্ধে সুনির্দিষ্ট ও সঠিক কোন তথ্য পাওয়া যায় না। কথিত রয়েছে, সুলতান নসিরউদ্দিন মাহমুদ শাহের (১৪৩৫-৫৯) আমলে খান আল-আজম উলুগ খানজাহান বাগেরহাট জেলার দক্ষিণ-পশ্চিমে সুন্দরবনের কোলঘেঁষে খলিফাবাদ রাজ্য গড়ে তুলছিলেন। এসময় তিনি ধর্মীয় দাওয়াত প্রদান ও কর্মকর্তাদের সাথে বৈঠক করার জন্য একটি দরবার হল গড়ে তোলেন, যা পরে ষাট গম্বুজ মসজিদ হিসেবে পরিচিতি পায়।

আধুনিককালের ঐতিহাসিক লেনপুলের মতে, ১৮৭১ সালে আগাছার তলদেশ থেকে এই মসজিদ আবিষ্কার করা হয়। শুরুতে জরাজীর্ণ অবস্থায় ছিল মসজিদটি। দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি একাধিকবার সংস্কার করার পর পোড়া লাল মাটির ওপর সুনিপুণ লতাপাতার অলংকরণসহ মসজিদের ভেতরে-বাইরে সৌন্দর্যের প্রকৃত রূপ ফুটে উঠেছে। বর্তমানে মসজিদে প্রায় আড়াই হাজার মুসল্লি একসঙ্গে নামাজ আদায় করতে পারেন।

জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি সংস্থা ইউনেস্কো ১৯৮৩ সালে ঐতিহাসিক মসজিদের শহর হিসেবে ষাট গম্বুজ মসজিদসহ খানজাহানের স্থাপত্যগুলোকে তালিকাভুক্ত করে এবং ৬০০ বছর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই মসজিদটিকে বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানগুলোর মধ্যে প্রচীন নিদর্শন হিসেবে স্থান দেয়।

ঐতিহ্যবাহী এ মসজিদটির ’ষাটগম্বুজ মসজিদ’ নামকরনের সঠিক ইতিহাস নিয়ে মতভেদ রয়েছে। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে, মসজিদটির ছাদ সমতল নয়। এটি গম্বুজ আকৃতির। অর্থাৎ ছাদে গম্বুজ। এর থেকে মসজিদটি ‘ছাদগুম্বজ’ নামে পরিচিতি লাভ করে। পরে যা কথ্যরুপে ‘ষাটগুম্বজ’ নাম হয়েছে। আবার কারও মতে, মসজিদের অভ্যন্তরে ছয়টি সারিতে দশটি করে মোট ষাটটি পাথরের খাম্বার উপর মসজিদের ছাদ নির্মাণ করা হয়েছে বলে এর নাম হয়েছে ষাটগম্বুজ। তবে নাম যাই হোক পাঁচ শতাব্দীর অধিক কাল ধরে এই মসজিদটি বাগেরহাটসহ দেশ বিদেশের অনেকের হৃদয়ে স্থান করে নিয়েছে।

মসজিদটির নির্মান নিয়ে জনশ্রুতি আছে যে, হজরত খানজাহান আলী (রহ.) ষাট গম্বুজ মসজিদ নির্মাণের জন্য সমুদয় পাথর তাঁর অলৌকিক ক্ষমতাবলে সুদূর চট্টগ্রাম, মতান্তরে ভারতের ওডিশার রাজমহল থেকে জলপথে ভাসিয়ে এনেছিলেন। এছাড়া, ইমারতটির গঠনবৈচিত্র্যে তুঘলক স্থাপত্যেরও বিশেষ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়।

এদিকে মসজিদটি ষাটগুম্বজ নামে পরিচিত হলেও এতে মোট গম্বুজ আছে ৮১ টি। এদের মধ্যে সাত লাইনে ১১ টি করে ৭৭ টি এবং চার কোনায় ১ টি ৪টি গম্বুজ অবিস্থিত। দৃষ্টিনন্দনি এই মসজিদটি উত্তর-দক্ষিণে বাইরের দিকে প্রায় ১৬০ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ১৪৩ ফুট লম্বা এবং পূর্ব-পশ্চিমে বাইরের দিকে প্রায় ১০৪ ফুট ও ভিতরের দিকে প্রায় ৮৮ ফুট চওড়া। মসজিদের প্রতটি দেয়াল প্রায় ৮•৫ ফুট পুরু। ষাট গম্বুজ মসজিদে গম্বুজের সংখ্যা মোট ৮১ টি, সাত লাইনে ১১ টি করে ৭৭ টি এবং চার কোনায় ৪ টি মোট ৮১ টি। গবেষকরা বলছেন, জলবায়ুর ক্ষতি থেকে মসজিদটি রক্ষায় স্তম্ভের নিচে চার ফুট পর্যন্ত পাথরের আস্তরণ দেওয়া হয়েছে।

কীভাবে যাবেন ষাট গম্বুজ মসজিদে: ঢাকার থেকে সরাসরি বাগেরহাটের বাস আছে আবার মুন্সিগঞ্জের মাওয়া থেকে লঞ্চ বা ফেরিতে পদ্মা নদী পার হয়ে কাঁঠালবাড়ি থেকে বাসে সরাসরি বাগেরহাটে যেতে পারেন। এই সড়কটাও চমৎকার।এছাড়া গাবতলী থেকেও বাগেরহাটে যাওয়ার বাস ছাড়ে। যাঁরা সময় নিয়ে যাবেন, তাঁরা বাগেরহাট থেকে মোংলায় গিয়ে সেখান থেকে মোটরচালিত নৌকায় চড়ে সুন্দরবনেও  ঘুরে আসতে পারেন।

আবাসিক ব্যবস্থা: বলে রাখা ভালো, বাগেরহাটে থাকার ব্যবস্থা একটু কম। দু-একটা ভালো হোটেলের মাঝে হোটেল আল আমিন, ধানসিঁড়ি উল্লেখযোগ্য।

ষাট গম্বুজ মসজিদ ও বাগেরহাট জাদুঘর: ষাট গম্বুজ মসজিদের পাশেই রয়েছে বাগেরহাট জাদুঘর। এ জাদুঘরে হযরত খান জাহান আলীর সব ধরনের স্মৃতি প্রদর্শিত হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কর্তৃক এ জাদুঘরটি পরিচালিত হচ্ছে। এই যাদুঘরে গেলে দেখা মিলবে সে সময়কার ব্যবহারের নানান কিছু। জানা যাবে ইতিহাস। দেশি পর্যাটকদের জন্য ২০ টাকা ও বিদেশি পর্যাটকদের জন্য ২০০ টাকা। তবে সার্কভুক্ত দেশ সমূহের নাগরিকদের জন্য ১০০ টাকা।

প্রতিদিন হাজারো পর্যটকের মুখরে মুখরিত হয় এই ষাট মসজিদ প্রাঙ্গন। মসজিদের দ্বায়িত্বে থাকা মুজিবর রহমান জানান ‘৬০০ বছরের প্রাচীন এই স্থাপনাকে সংরক্ষণ করা সবারই দায়িত্ব। মসজিদের এই স্থাপত্যশৈলী বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে নতুন করে পরিচিত করেছে’।


সর্বশেষ সংবাদ