নুহাশপল্লীতে এক বিকেল 

গবি ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সস অনুষদের ‘বি’ গ্রুপের ইন্টার্ন ডাক্তারগণ
গবি ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সস অনুষদের ‘বি’ গ্রুপের ইন্টার্ন ডাক্তারগণ  © টিডিসি ফটো

যদি মন কাঁদে/ তুমি চলে এসো, চলে এসো 
এক বরষায়...
এসো ঝর ঝর বৃষ্টিতে/ জল ভরা দৃষ্টিতে/ এসো কোমল শ্যামল ছায়...।

বিখ্যাত বাংলা কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে আমরাও গেলাম নুহাশ পল্লীর সেই ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড়ে। লেখক মূলত প্রিয় কারো উদ্দেশ্যে গানটি লিখেছিলেন। তবে, আমরা তার সেই প্রিয় না হলেও তিনি আমাদের প্রিয়। তাইতো, বৃষ্টি আর তার পছন্দের দুটি মাসের একটি আগস্টেই সেখানে গিয়েছিলাম। তবে, ততদিনে তিনি আর আমাদের মাঝে ছিলেন না। যখন গেলাম তারও ১০ বছর পূর্বে এই বৃষ্টির দিনেই তিনি পরপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন।

দিনটি ছিল আগস্টের ১১ তারিখ। সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের (গবি) ভেটেরিনারি এন্ড এনিমেল সায়েন্সস অনুষদের ‘বি’ গ্রুপের ইন্টার্ন ডাক্তারদের গাজীপুর পর্বের শেষ দিন। গাজীপুর চৌরাস্তায় অবস্থিত এজি এগ্রো পোল্ট্রি ল্যাবে ছিল ১ সপ্তাহের ইন্টার্নশিপ। যাই হোক, ইন্টার্র্নির সুবাদে আমরা যেখানেই যায় না কেন সেখানকার বিখ্যাত, দর্শনীয় কিংবা ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখে কালের সাক্ষী হওয়ার চেষ্টা করি। তারই অংশ হিসবে আমাদের মাথায় ঘুরপাক খায় আমরা এখানকার কোন জায়গাটায় যাবো। পরিকল্পনাটা আমার মাথা থেকেই আসলো এবারের গন্তব্য হবে নুহাশপল্লী। ৬ জনের দলে সবাই রাজী। কিছু ভাবান্তর না করেই ছুটে চলা।

আরও পড়ুন: ঢাকায় বসছে এবারের প্রোগ্রামিংয়ের বিশ্বকাপ, উদ্বোধন মঙ্গলবার

চৌরাস্তা হতেই প্রচুর গাড়ী যাতায়াত করে গাজীপুর-ময়মনসিংহ মহাসড়কে। আমরা ময়মনসিংহগামী ইমাম পরিবহণের একটি বাসে উঠে পড়লাম। ১২ কিলোমিটার রাস্তায় ৩০ টাকা ভাড়া দিয়ে নেমে পড়লাম গাজীপুরের হোতাপাড়া নামক স্থানে। সেখানেই বেশ বড় করেই বোর্ডে লেখা নুহাশপল্লীর গতিপথ। হ্যাঁ, এবার সে দিকেই ছুটতে হবে। জায়গাটার নাম পিরুজালী। গাজীপুরের নির্জন জঙ্গলে। জনপ্রতি ৩০টাকা হারে একটি সিএনজি ঠিক করে উঠে পড়লাম লেখকের স্বপ্নের জায়গার উদ্দেশ্যে। কিছুদূর এগুতেই বুঝলাম লেখক কেন এটিকে এতো পছন্দ করেন। রাস্তার দু পাড়ে জঙ্গল, মাঠ-ঘাট, দুর দিগন্তে পানির ঢেউতে মিশে যাওয়া জমি যেন নিয়ে যায় রোমাঞ্চকর গন্তব্যে। এবার ৮ কিলোমিটারের মুগ্ধতা ভরানো রাস্তা কখন শেষ হলো টেরই পেলাম না। চলে এলাম ঠিক নুহাশ পল্লীর গেটে। সিএনজি থেকে নামতেই অনুভূতি হলো লেখকের পায়ের ধুলো, মাটির ঘ্রাণ, জঙ্গলের সৌন্দর্য। উঁচু, নিচু ছোটখাটো পাহাড়ের মতো ঢিবির উপর দাঁড়িয়ে থাকা বড় বড় শীল, গজারি গাছগুলো মাথা উঁচু করে যেন বলছে এসো, এসো স্মৃতি আর অনুভূতির রাজ্যে।

কয়েক কদম গেলেই মেইনগেট। আমরা অরণ্যঘেরা রাস্তায় হাঁটছি আর সূর্যের আলো বৃক্ষরাজির পাতা ভেদ করে যেন সৃষ্টি করছে রোদের মহনীয় খেলা। গেটের পাশেই দুয়েকটা দোকান যেখানে হুমায়ূন সমাচার, বিচিত্র আয়না, চিরুনি, পাখা, ক্যাপ কতকিছু। আছে জনপ্রিয় বাঙালি খাবার ফুচকা, চটপটিসহ নানা পদ। এগুলোর মোহে আবদ্ধ হওয়ার থেকে যেন তাড়া দিচ্ছিল ঘুমন্ত লেখককে দেখার। তাই তো দেরী না করেই এক একজন টিকেট কাটলাম ২০০ টাকা দরে।

ভিতরে ঢুকতেই চোখে পড়লো অর্গানিক শৈলীতে নকশা করা এবড়োথেবড়ো সুইমিং পুল। ভালোবাসার আকৃতিতে তৈরি এই পুলে নাকি সাঁতার কেটেছিলেন বিখ্যাত লেখক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও। জাদুকরদের স্পর্শ করতে আমারও নামতে ইচ্ছে হলো খুব। তবুও মনকে হার মানতে হলে অতিরিক্ত জামাকাপড়ের কাছে। তার পাশেই মায়ের হাত ধরে থাকা ছেলের ভাস্কর্য প্রমাণ করে মধুর কোন দৃশ্য আর ভালোবাসার সম্পর্ককে। একটু সামনেই হুমায়ূন আহমদের আবক্ষ মূর্তি। সেখানে কিছুক্ষণ বসে মন হারালো জাদুকরের জাদুতে। তার একটু দূরেই বৃষ্টি বিলাস। লেখকের উপন্যাসের মতোই এই বাংলো সত্যিই জীবন্ত। যেটা নিয়ে যাবে কোন এক স্নাত অনুভূতিতে। ঠিক উল্টোদিকে প্রাকৃতিক দাবার বোর্ড। এটা যেন জীবনের দাবা খেলার মতোই। কাঠের তৈরি হাতি-ঘোড়া, নৌকা আর সিমেন্ট-বালির সাদা-কালো বোর্ড যেন বাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। আর সেই বাস্তবতায় বন্দী হয়ে তার পিছনেই তিনটি পুরনো লিচুগাছ নিয়ে একটি ছোট্ট বাগান রয়েছে। যে বাগানে শুয়ে আছে জনপ্রিয় সাহিত্যিক।

আড়াইশত প্রজাতির ঔষধি, ফল-ফুল, বিলুপ্তপ্রায় সবুজ গাছের ‘নন্দন কাননে’ তিনি সৃষ্টি করেছেন এক অনন্য ভাবনার জগত। শানবাঁধানো দীঘি নিলাবতি, তার ওপর নারিকেল গাছের দ্বীপ, পাশে ভূত বিলাস, পদ্ম পুকুর, মৎসকন্যা আর রাক্ষসের আবক্ষ মূর্তি, ডিমপাড়া সাদা-সবুজ প্রাগৈতিহাসিক ডাইনোসর, বই হাতে শুয়ে থাকা বালিকা, ফল হাতে দাঁড়িয়ে থাকা রমণী, ব্যাঙের ছাতা, কাদামাটি ও টিন দিয়ে তৈরি করা শুটিং স্টুডিও। শতশত কবুতর ও তাদের থাকার ঘর, শেফালি গাছের নীচে একটি নামাজ ঘর, সুদৃশ্য তিনটি বাংলো, মাটির ঘর, সবুজ উদ্যান সব কিছু দেখতে দেখতে কখন সন্ধ্যা হলো টেরই পেলাম না।

সূর্যের গোধূলি পড়তে না পড়তে নিরাপত্তা রক্ষীদের তাড়া। এবার ফিরতে হবে। ক্লান্ত শরীর সুবৃহৎ দুটি দোলনায় একটিতে দুলতে দুলতে মন আকঁড়ে ধরলো স্বপ্নের ৪০ একরে। পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য থেকে বাংলার সাহিত্যও সংস্কৃতিকে যিনি শক্ত হাতে পার্থক্য করে তুলতে পেরেছেন তাঁর স্মৃতিগুলো যেন কিছুতেই বাড়ি ফিরতে চাইছে না। তবুও বিদায় নিতে হবে যেমনটা নিয়েছেন সমাহিত প্রিয় লেখকও। তাই, কথার জাদুকরকে আর বেশিসময় ধরে রাখতে পারিনি। অন্ধকার ভেদ করে বাসায় ফেরত আসলাম ঠিকই তবে, পিছনে পড়ে রইল আলোকিত স্মৃতি যা সর্বদা অম্লান।


সর্বশেষ সংবাদ