বাবা-মায়েদের যে ভুলগুলো প্রতিবন্ধক হতে পারে শিশুর বেড়ে ওঠায়
যোগ্যতাসম্পন্ন ও সৎ প্রজন্ম ভবিষ্যতে গড়ার কাজ শুরু হয় পরিবার থেকে। পরিবার হলো প্রজন্ম গড়ার সূতিকাগার আর পিতা-মাতারা হলেন তার কারিগর। এ পরিবারের অন্যতম একটি গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হলো সন্তান লালন-পালন। বাবা-মায়েদের স্বপ্ন, সন্তান বড় হয়ে একদিন সমাজে তাদের মর্যাদা বাড়িয়ে দেবে। আর সন্তানের ভালোর জন্য চাই বাড়তি যত্ন। তার খাওয়া-দাওয়া, ঘুম, স্বাস্থ্য, পড়ালেখা, বিয়েশাদি- সে এক মহাযজ্ঞের আয়োজন যেন! সব মা-বাবাই চান, তার সন্তানের পরবর্তী জীবনে সুখ আর সমৃদ্ধিতে ভরে উঠুক।
অনেক সময় দেখা যায়, বাবা-মার সীমাহীন যত্ন আর দেখভাল সত্ত্বেও, অনেক শিশুই বড় হয়ে ব্যক্তিগত জীবনে তেমন সফলতা পায় না। আবার প্রচণ্ড অভাব-অবহেলার মধ্যে জন্ম নিয়েও বহু ছেলেমেয়ে একসময় নিজের ক্ষুদ্র গণ্ডি পেরিয়ে বড় সফলতার দেখা পায়।
এ পার্থক্যের পেছনে শিশুর প্রতি প্রতি বাবা-মায়ের দৈনন্দিন আচরণগুলো কাজ করে। তাদের কিছু ভুল আচরণের কারণে সেই যত্ন যেতে পারে বিফলে, সন্তানের জীবন হতে পারে ব্যর্থতামণ্ডিত। চলুন জেনে নিই, এমন কিছু ভুল আচরণ সম্পর্ক—
কর্তৃত্ব ফলানো
কোনো বাবা-মায়ের ইচ্ছা থাকে না যে, তার সন্তান বড় হয়ে ব্যর্থ একজন মানুষে পরিণত হোক। তারা সবসময়ই চান, তাদের সন্তানটি নিরাপত্তা পেয়েই বড় হোক। নিরাপত্তা নিয়ে চিন্তা ভালো, বিশেষ করে আপনার সন্তান যখন শিশু। তখন সত্যিকার অর্থেই বাড়তি নিরাপত্তার প্রয়োজন হয়।
কিন্তু সন্তান যখন ক্রমাগত বড় হতে থাকে, তখন তার নিরাপত্তা নিয়ে আগের মতো ভাবার কিছু থাকে না। এটা একটা ভারসাম্যপূর্ণ আচরণ, কারণ সে যত বড় হয়ে ওঠে, ততই নিজের নিরাপত্তার ব্যাপারগুলো বুঝে নিতে শেখে। কিন্তু অনেক বাবা-মা ‘নিরাপত্তা’র নামে সন্তানের ব্যক্তিগত জীবনেও হস্তক্ষেপ শুরু করেন।
টেনেসি বিশ্ববিদ্যালয় ২০১১ সালের এক সমীক্ষায় দেখিয়েছে, ছোটবেলা পার করার পরও যেসব শিশু কড়া নিরাপত্তার চাদরের ভেতর রয়ে যায়, তারা পরবর্তী জীবনে আত্মকেন্দ্রিক, অত্যধিক সচেতন, অল্পতেই ভেঙে পড়ার মতো পর্যায়গুলো পার করে। ছোট থেকে সিদ্ধান্ত নেয়ার মানসিকতা গড়ে না ওঠায় সে পদে-পদে ভুল সিদ্ধান্ত নেয়। অন্যদের মতো তার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস থাকে না। যেগুলো তার পুরো জীবনকে প্রভাবিত করে।
বকাঝকা এবং অভিশাপ
শিশু সন্তানকে বকাঝকা করা আমাদের সমাজে খুবই প্রচলিত একটি চিত্র। এটা সত্যি যে, বাবা-মা সন্তানের ভালো চান বলেই সন্তানের কর্মকাণ্ড নিয়ে চিন্তিত হন। ছোট অবস্থায় তারা দুষ্টুমি করবেই, তাদের তাদের প্রকৃতি বা খেলাধুলার ধরনই এমন। তাই মাঝেমাঝে তারা হয়তো এমন কিছু করে বসে, যা আপনার সহ্যের সীমাকে ছাড়িয়ে যায়।
আপনি দ্বিতীয়বার না ভেবে বলে বসেন, “অনেক হয়েছে; আজ তোর একদিন কি আমার একদিন”! এই বলে যা বলার বলে ফেলেন! অনেক বাবা-মায়ের বদভ্যাস হচ্ছে একটু এদিক-ওদিক হলেই সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে বসেন। এটা খুবই বাজে একটি ব্যাপার। আপনিই সন্তানের ভালো চান, আবার রেগে গিয়ে বলছেন, “তুই জীবনে কিছু করতে পারবি না”!
আপনার উচ্চারিত শব্দগুলো তাকে শুধরে না দিয়ে আরও একগুঁয়ে করে দিতে পারে, আপনার সাথে সন্তানের মানসিক দূরত্ব তৈরি করতে পারে, তার ভেতর পরামর্শ না নেওয়ার মানসিকতা তৈরি করে দিতে পারে। গবেষণায়ও এমন ব্যাপারগুলো বারবার উঠে এসেছে।
আরও পড়ুন: সর্দি-কাশি হলে খাবেন যেই খাবারগুলো
মারধর করা
সন্তানকে শাসন করার অসংখ্য উপায় থাকতে পারে। কিন্তু শাসনের নামে গায়ে হাত তোলা আপনার শিশুর জন্য ভালো কিছু বয়ে আনবে না। উন্নত বিশ্বে শিশুদের শিষ্টাচার শেখানো, পড়াশোনায় মনোযোগী করে তোলা, বাবা-মায়ের অনুগত করে গড়ে তোলার জন্য দারুণ সব পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
শিশু যদি কথা না শুনতে চায়, তবে তার চাহিদার কথা শুনে নেওয়া জরুরি। শিশুরা শারীরিক গঠনে এমনিতেই দুর্বল, তাই অল্প গায়ে হাত তোলাতেও গুরুতর শারীরিক জখমের আশঙ্কা যেমন থাকে; তেমনি প্রহারজনিত কারণে শিশুর মানসিক জগতেও আসে বড় ধরনের আঘাত। একটা সময় দেখবেন, আপনার শিশু তার ব্যাপারগুলো আপনার কাছে প্রকাশ করছে না, যেগুলো স্বাভাবিকভাবে আপনাকেই জানানোর কথা।
টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা প্রায় ৫০ বছরের গবেষণায় প্রায় দেড় লক্ষ শিশুর ওপর গবেষণা করে দেখেছেন, যেসব শিশুদের শারিরীকভাবে শাস্তি দেওয়া হতো, তারা পরবর্তীতে পরিবেশ, পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে তেমন সফল হয়নি। তাছাড়া পরিপূর্ণ মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কারণে অবসাদ, ভুল সিদ্ধান্ত গ্রহণ, অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও রয়েছে প্রচুর।
ইলেকট্রনিক পণ্য ব্যবহারে অসচেতনতা
যেসব বাবা-মায়েরা ইলেকট্রনিক জিনিসের প্রতি বেশি আসক্ত, তাদের সন্তানদের ভেতর পরবর্তীতে মানসিক বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। পরিবর্তিত পরিবেশের সাথে খাপ খাওয়াতে না পারা, অমনোযোগিতা, আলস্য- এসব শিশুদের ভেতর জেঁকে বসে। বাবা-মায়েরা শিশুকে যথেষ্ট সময় না দিলে তাদের কথা শিখতে দেরি হয়। গবেষণায় দেখা গেছে, যেসব শিশুদের বাবা-মায়েরা টিভি, স্মার্টফোনে আসক্ত, তাদের সন্তানের ভাষাগত দক্ষতা গড়ে উঠতে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে।
বাবা-মার ফোন বা ইলেকট্রনিক পণ্যে আসক্তি সন্তানের উপর ফেলতে পারে বিরূপ প্রভাব। কেবল বাবা-মা এগুলো থেকে দূরে থাকলেই হবে না, নিশ্চিত করতে হবে, সন্তানও যাতে এগুলা থেকে দূরে থাকে। বিশেষ করে বয়স দু’ বছর না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে টিভি, স্মার্টফোন-এগুলো থেকে দূরে রাখতে হবে।
ঘুমানোর সময় নির্ধারণ
বাড়ন্ত শিশুদের মস্তিষ্কের কার্যকারিতা নির্ভর করে তাদের ঘুমের পরিমাণের উপর। বিশেষ করে সঠিক সময়ে ঘুমাতে যাওয়া শিশুদের শেখার ক্ষমতা ও মনোযোগ, অনিয়মিত সময়ে ঘুমাতে যাওয়া শিশুদের চেয়ে বেশি। ইংল্যান্ডের একদল গবেষক সম্প্রতি এমন তথ্য প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বেশিরভাগ পরিবারেই শিশুদের ঘুমানোর জন্য নির্দিষ্ট কোনো সময় নির্ধারণ করা হয় না। বিশেষ করে আমাদের যৌথ পরিবারগুলোতে এই সমস্যা আরও বেশি।
আপনার সন্তানের সুন্দর ভবিষ্যত নিশ্চিত করতে হলে, আপনাকেই আগে জানতে হবে, তাকে কীভাবে লালন-পালন করতে হবে। নিজেদের বাস্তবতা ও সীমাবদ্ধতাগুলো জানিয়ে দিতে হবে, যাতে সে মানসিকভাবে নিজেকে ক্রমাগত বদলাতে থাকা পৃথিবীতে টিকে থাকার জন্য তৈরি করে নিতে পারে। আপনার ব্যবহার আর শেখানো বিষয়গুলোই তার পরবর্তী জীবনের পাথেয়।