লিখিত পরীক্ষায় যত এগিয়ে থাকবেন, ক্যাডার হওয়ার সম্ভাবনা তত বেশি
আপনারা যারা ৪৩তম ও ৪৪তম বিসিএস লিখিত দেবেন, প্রথমেই তাদেরকে অভিনন্দন। বিসিএসের এই বন্ধুর পথে পরিশ্রমের প্রথম ধাপটি আপনারা ইতোমধ্যে অতিক্রম করেছেন। এবার ক্যাডার হওয়ার ক্ষেত্রে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ- লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে যাচ্ছেন আপনারা। আপনাদের জন্য শুভকামনা।
আমি স্বয়ং বিসিএস বা অন্য কোনো জব প্রস্তুতির জন্য ব্যক্তিগতভাবে কারো কাছে পরামর্শ নেইনি, কিন্তু ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে ক্যাডারদের অভিজ্ঞতার গল্প ও তাদের পরামর্শগুলো নিয়মিত দেখতাম। আমার এত পথ পাড়ি দেয়ার পেছনে সেসব লেখার অনেক বড় অবদান রয়েছে, যা আমি অস্বীকার করতে পারবো না। এজন্য আমারও নিজের মাঝে তৈরি হওয়া এক ধরনের দায়বদ্ধতা থেকেই আপনাদের জন্য লিখছি।
বিসিএসের প্রিলিমিনারি পাস আপনাকে বিসিএসের মূল প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার সুযোগ করে দেয় মাত্র। প্রিলির নম্বর আপনার ক্যাডার হওয়ার ক্ষেত্রে ন্যুনতম কোনো ভূমিকা রাখতে পারে না। ৯০০ (বোথ ক্যাডারে ১১০০) নম্বরের লিখিত যুদ্ধে আপনি যত এগিয়ে থাকবেন, আপনার ক্যাডার হওয়ার সম্ভাবনা ততই বাড়বে। যদিও ভাইভার ভূমিকাও এখানে অনেক।
একটি ভালো লিখিত পরীক্ষা আপনাকে মানসিকভাবে অনেক শক্তি যোগাবে, যা আপনার আগামীকে উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর করতে ভূমিকা রাখবে। তাই যতটা ভালো করা সম্ভব, সেটা লিখিত পরীক্ষাতে করুন। আমি প্রতিটি বিষয়ে আলাদা আলাদা করে প্রশ্নভিত্তিক লেখা লিখবো। আজ সামগ্রিক বিষয়ের উপর কিছু পরামর্শ রইলো, আশা করি আপনাদের কাজে লাগবে।
খাতায় উপস্থাপন ও ভাষা-দক্ষতা
লিখিত পরীক্ষায় সবচেয়ে ভালো নম্বর তোলা সম্ভব সুন্দর ও গোছানো একটা প্রস্তুতি ও তার সুষম উপস্থাপনের মাধ্যমে। আপনি অনেক পড়েও যদি পরীক্ষার খাতায় তা ঠিকভাবে উপস্থাপন করতে না পারেন, ফলাফল শূন্য! এখানে প্রশ্নোত্তর কাঠামো অনেকটা পূর্বানুমিত বিধায় আপনি চাইলেই পরীক্ষার আগে অনেকটা অনুমান করে নিতে পারবেন প্রশ্নের ধরন কেমন হচ্ছে এবং আপনার উত্তরের কৌশল ঠিক কেমন হবে। বুদ্ধিদীপ্ত ও ভিন্নধর্মী উপস্থাপনা আপনাকে ১০০-এর মধ্যে ৬৫-৭০ এবং ২০০-এর মধ্যে ১২০-১৫০ পর্যন্ত পেতে সাহায্য করবে, যা ক্যাডার প্রাপ্তির জন্য উপযুক্ত নম্বর। আর এর জন্য প্রয়োজন আপনার উপস্থাপনের অসাধারণ কিছু কৌশল।
পরীক্ষক জানেন না আপনি দেখতে কেমন, তিনি জানেন না আপনি কত বিশাল জ্ঞানের অধিকারী, তিনি আপনাকে বোঝার চেষ্টা করবেন শুধুই আপনার খাতায় আপনি কি লিখেছেন, আপনার হাতের লেখার সৌন্দর্য, উপস্থাপনের কৌশল আর ব্যবহৃত ভাষার মাধুর্য দেখে।
আরও পড়ুন: ছাত্রনেতা থেকে পুলিশ ক্যাডার শাস্ত্রী
দেখুন, প্রতিটি মানুষই কথা বলে। কিন্তু কারও কারও কথা আমাদের মন ছুয়ে যায় শুধু তাদের অসাধারণ কিছু শব্দের ব্যবহারের কারণে। আপনারা দেখবেন, ছাত্রলীগে অসংখ্য নেতাকর্মী আছে, অথচ একমাত্র সাদ্দাম হোসাইনের বক্তব্যই সবার কাছে দশে দশ পায়। আপনার খাতাটাকেও করতে হবে সেরকম- যেন যিনি খাতাটা দেখছেন, তার কাছে মনে হয় এই খাতাটা একটু আলাদা।
এখানে সবকিছুর উপস্থাপন আর দশটা খাতা থেকে ভিন্ন। খাতায় আপনার ভাষা হোক প্রাঞ্জল, সহজবোধ্য কিন্তু মাধুর্য মণ্ডিত। আপনার লেখা পাঠে যেন সাহিত্যের সুবাস পাওয়া যায়, বিশেষত বাংলা পরীক্ষায়। ইংরেজিতে কাঠিন্য পরিহার করে সহজবোধ্য বাঙালির ইংলিশে লিখবেন। বাক্য গঠনে ভুল করবেন না। নীল কালিতে কোটেশন ব্যবহার করবেন।
নম্বর ও প্রশ্নানুযায়ী সময় বণ্টন
লিখিত পরীক্ষার নম্বর বণ্টন পূর্বঘোষিত বিধায় আমরা জানি ঠিক কোন প্রশ্নের জন্য কত নম্বর। পরীক্ষার সময়ও যেহেতু নির্দিষ্ট, আমাদের প্রথম কাজ হলো প্রতিটি নম্বরের জন্য সময়ের সুষ্ঠু বণ্টন নিশ্চিত করা। এই সময় বণ্টনে হেরফের করলে আপনাকে বেশ কিছু নম্বর ছেড়ে আসতে হবে, যা বড় ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
তাই পরীক্ষার আগেই বিগত প্রশ্নগুলো নিয়ে বসুন। সময়ের হিসেব করে প্রতিটি নম্বরের বিপরীতে সময় বরাদ্দ করুন। বরাদ্দকৃত সময়ে আপনি কতটুকু লিখতে পারবেন, কত তথ্য দিতে পারবেন সেসব নিজেই ফিক্স করুন। তাহলে আর আপনার কাউকে জিজ্ঞেস করতে হবে না যে, আপনি ৫ নম্বরের জন্য কয় পেজ লিখবেন।
দেখুন, ১০০ নম্বরের ৩ ঘন্টার পরীক্ষায় আপনি প্রতি নম্বরের বিপরীতে পাবেন ১.৮ মিনিট, অর্থাৎ ৫ নম্বরের বিপরীতে পাচ্ছেন ৯ মিনিট। আবার ২০০ নম্বরের ৪ ঘন্টার পরীক্ষায় আপনি প্রতি নম্বরের বিপরীতে ১.২ মিনিট করে পাঁচ নম্বরের জন্য পাবেন ৬ মিনিট।
অর্থাৎ প্রতিটি পরীক্ষায় আপনার সময় বণ্টন পরিবর্তন হতে বাধ্য। আবার এমনও না যে প্রতিটি প্রশ্নেই আপনাকে সমান সমান সময় দিতে হচ্ছে। একটি প্রশ্নে সময় বাঁচলে তা অন্যটিতে দিতে পারবেন। বড় প্রশ্নগুলোর জন্য সময়ের বরাদ্দ বাড়াতে হবে। এজন্য প্রতিটি বিষয়ের ক্ষেত্রে প্রতিটি প্রশ্ন আলাদা আলাদাভাবে খাতায় লিখে হিসেব করে টাইম ম্যানেজমেন্ট করুন। মনে রাখবেন, লিখিত পরীক্ষায় প্রতিটি মুহূর্ত গুরুত্বপূর্ণ। একটা সেকেন্ডও নষ্ট করার সুযোগ নেই।
ডাটা-চার্ট ও ম্যাপ
বাজারের অনেক বই-বেচুয়া আছে, যারা তাদের বইয়ে অসংখ্য অপ্রয়োজনীয় ডাটা, চার্ট আর ম্যাপের জঞ্জাল ভরাট করে রেখে আপনাকে আত্মস্থ করতে অনেকটা বাধ্য করে। এদের বয়ান শুনে আপনার মনে হবে লিখিত খাতায় দুইটা চার্ট, চারটা ম্যাপ আর দশটা লোগো এঁকে আসতে পারলেই বুঝি হয়ে গেল। এসব করতে যাবেন না। ডাটা ব্যবহার করুন, তবে অপ্রয়োজনীয়ভাবে নয়।
রাশিয়া-ইউক্রেন সম্পর্কে প্রশ্নের উত্তরে বিশাল ছক একে দুই দেশের অসংখ্য বিষয়ে তুলনা দিয়ে পৃষ্ঠাভরে ম্যাপ না একে নিজের প্রাঞ্জল ভাষায় শিরোনামসহ ঘটনাটি সম্পর্কে প্রশ্নে যা চেয়েছে, সেটাই বিস্তারিত বিশ্লেষণের চেষ্টা করুন। উপাত্ত উপস্থাপন ভালো কাজ, তবে মুখস্ত উপাত্ত দেয়ার চেয়ে বিশ্লেষণের দক্ষতা প্রকাশ আপনাকে এগিয়ে রাখবে।
আপনার ছক পরীক্ষকের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও তিনি আসলে খোঁজেন আপনার পরিস্থিতি বিশ্লেষণের সক্ষমতা কতটুকু। সিলেবাসের নির্দেশনায়ও সেটাই বলা আছে। মুখস্ত একটা চার্ট লিখে আর বিদঘুঁটে একটা ম্যাপ এঁকে ভালো নম্বর আশা করবেন না। ডাটা দিলে সোর্সসহ উল্লেখ করুন। কোনো মিথ্যা বা বানোয়াট তথ্য দিবেন না, কোনোভাবেই না। ম্যাপ আঁকলে সুন্দর করে আঁকুন নতুবা পরিহার করুন।
মনে রাখবেন এটা সিভিল সার্ভিসের সিলেকশন এক্সাম, কোনো ফাজলামির জায়গা নয় যে কয়েকটা রেখা টেনেই বললাম এটা আফগানিস্তান আর ওটা পাকিস্তান। বাংলাদেশের ম্যাপ আঁকলে অবশ্যই সুন্দরভাবে আঁকবেন। পরীক্ষার খাতায় সরকারের লোগো বা মুজিববর্ষ লোগো ব্যবহারের কোনো প্রয়োজন নেই। মনে রাখবেন, এসবের সামান্য বিকৃতিও আপনার স্বপ্নের সমাপন ঘটাতে পারে।
আমার ৪০তম বিসিএসের খাতায় এসবের ন্যুনতম কোনো ব্যবহার ছিল না। না কোনো চার্ট, না ম্যাপ, না লোগো। আমি বিশ্লেষণধর্মী লেখায় বিশ্বাসী, সেভাবেই লিখেছি। যেহেতু ফলাফল আপনাদের সামনে, তাই এসব নিয়ে অতিমাত্রায় টেনশনে ভুগবেন না। আপনার খাতাটা হোক ঠিক পত্রিকার বুদ্ধিদীপ্ত একটা সম্পাদকীয় কলামের মত।
উত্তরের আঙ্গিক
উত্তর করুন ‘টু দি পয়েন্ট’। অযথা অতিরিক্ত, অতিরঞ্জিত কোনো কিছুই লেখার সময় পাবেন না। উপরন্তু এরকম লিখতে গেলে আপনার পারা প্রশ্নের উত্তর করতে গিয়েও একসময় হিমশিম খেতে হবে। প্রশ্নে যা চেয়েছে, সেটার মধ্যেই আপনার উত্তর সীমাবদ্ধ রাখুন। ৭ মার্চ বা ছয়দফা অথবা স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে আপনি জানেন বলে সব লিখতে যাবেন না। যে প্রশ্নের উত্তর খুব ভালো জানেন, সেগুলোও অযথা বড় করবেন না। ঠিক বরাদ্দকৃত সময়ের মধ্যে যতটুকু লেখা সম্ভব, ততটুকুই লিখুন।
একটা প্রশ্নে বেশি সময় দিয়ে ফেললে, পরীক্ষা শেষে দেখবেন ২০-৩০ নম্বর না লিখেই চলে আসতে হচ্ছে। প্রতিটি উত্তরের আকারের মধ্যে সামঞ্জস্য রাখার চেষ্টা করুন। সমান নম্বরের প্রশ্নে একটা দুই পেজ, আরেকটা পাঁচ পেজ লিখবেন না।
আগে প্রশ্ন বুঝে দেখুন, ঠিক কোন দিকটা টাচ করলেই উত্তর হয়ে যাবে। খাতায় আপনার কোনো রাজনৈতিক পক্ষপাত দেখাবেন না, নির্মোহ-নিরপেক্ষ ইতিহাস লিখুন। কেননা আপনি জানেন না আপনার খাতা কার হাতে পড়বে। তাই নিরপেক্ষতা বজায় রাখুন। আপনার মতামত চাওয়া প্রশ্নগুলোতে এমনভাবে উত্তর লিখুন যেন আপনি শুধু পরীক্ষার্থী না, বাস্তবেই একজন সরকারি কর্মকর্তা।
আরও পড়ুন: বিসিএস লিখিত: কমন না পড়লেও লিখে আসার দক্ষতাটা জরুরি
ব্যক্তিগত কার্যক্রম
মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। অধিক উত্তেজনা সবসময়ই ক্ষতির কারণ। কারও সাথে আলাপ-আলোচনা করে লেখার পরিকল্পনা করবেন না। নিজের ক্ষতি তো করবেনই, এতে অন্যদেরও ক্ষতিই হবে। পরীক্ষার হলে গিয়ে আপনাকে নতুন সার্কেল বানাতে হবে না, যতটুকু পারা যায় চুপচাপ থেকে পরীক্ষা দিন। পানির ব্যবস্থা রুমের সামনেই থাকবে, বোতল না নেয়াই ভালো। এতে দূর্ঘটনার সম্ভাবনা কমে যায়।
খাতায় দাগ টানা থাকবে, স্কেলিং অপ্রয়োজনীয়। এডমিট কার্ড ছাড়া আর কোনো কাগজ প্রয়োজন নেই। কেন্দ্র চাইলে ন্যাশনাল আইডি সাথে রাখুন। অনাকাঙ্ক্ষিত জটিলতা এড়াতে পারবেন। সাথে চকলেট বা চুয়িংগাম রাখতে পারেন।
ওএমআর ভালোভাবে পূরণ করুন। নিজের ভুলে সব হারাতে যেন না হয়। অবশ্য লিখিত খাতা ম্যানুয়াল চেকিং হয়। তাই সামান্য ভুলে অতিমাত্রায় দিশেহারা হবেন না, ভয়ের কিছু নেই। আমার বাংলা খাতার ওএমআরের যেখানে দাগ দিতে বারণ করে, সেটা ছিড়ে গেছিলো। যেহেতু এরপরও রেজাল্ট পেয়েছি, ধরে নেয়া যায় সমস্যা হয়নি।
লেখক: সহকারী পুলিশ সুপার চতুর্থ তম, ৪০তম বিসিএস