১২০-১৩০ নম্বরের মধ্যেও সেইফ যদি নেগেটিভ মার্কিং বেশি না হয়
দরজায় কড়া নাড়ছে ৪৪তম প্রিলিমিনারি পরীক্ষা। আমি আমার আগের কয়েকটা লেখায় বারবার বলেছি স্ট্র্যাটেজি সেট করে পড়ার কথা। তখন অনেকেই জানতে চেয়েছিলেন এই ‘স্ট্র্যাটেজি’টা কী। ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি, স্ট্র্যাটেজি একেকজনের জন্য একেকরকম। কারণ সবার বেসিক, স্ট্রেংথ, উইকনেস, পড়ার ধরণ একরকম না। তারপরও যেহেতু প্রিলি সামনে, কিছু আইডিয়া শেয়ার করার জন্য এই পোস্ট।
প্রিলির আগে শেষ মুহূর্তে কী কী পড়তে হবে এই বিষয়ক প্রচুর ভালো ভালো পোস্ট আছে। আমি সেই নিয়ে পোস্টের সংখ্যা আরেকটা বাড়াতে চাই না। আমি আজ বলবো প্রিলির আগের শেষ দুই সপ্তাহে কী কী পড়বেন না।
তার আগে বলি, ছোটবেলায় মাংস চোর খেলা খেলেছেন? নব্বই দশকের বাচ্চা হলে খেলার কথা। যাই হোক, প্রিলিমিনারি পরীক্ষা হচ্ছে সেই মাংস চোর খেলা। এখানে মাংস হল কাট মার্কস, চোরটা আপনি। আপনার প্রতিপক্ষ দলের খেলোয়াড় হল প্রশ্নপত্র। আপনার কাজ হবে কোনমতে কাটমার্ক টুকু (১১৫-১২০) বগলদাবা করে যতদ্রুত প্রতিপক্ষের দাগ মানে পরীক্ষা হল থেকে বের হয়ে আসা!
এরবেশি সময় প্রতিপক্ষের সীমানায় থাকতে গেলেই বিপদ, প্রতিপক্ষ হাত-পা বেঁধে ওখানেই আপনাকে আউট করে দিবে। তেমনি বেশি মার্কসের লোভে পড়ে বেশি দাগাতে যাবেন, প্রশ্নপত্রও আপনাকে নেগেটিভ মার্কিং এর জালে জড়িয়ে প্রিলির যাত্রা ওখানেই শেষ করে দিবে। গেইম ওভার। এই মাংস চুরির টেকনিক নিয়ে আজকের লেখা।
পড়ার স্ট্র্যাটেজি
পড়ার স্ট্র্যাটেজি সেট করার প্রথম টার্গেট হল কী কী পড়বো না সেটা বাদ দেয়া। ২০০ তে ২০০ পেয়ে পাশ করা যে কথা, ১২০ পেয়ে পাশ করাও একই কথা। প্রিলির মার্কস তো আর যোগ হচ্ছে না। তাহলে বেশি কেন পড়বো?
কী পড়বেন না
কারেন্ট এফেয়ার্স: প্রিলিমিনারি পরীক্ষার জন্য এই বস্তুটা পড়ার কোনই প্রয়োজন নেই। ইউক্রেনে রাশিয়া কয়টা বিস্ফোরণ করলো বা রাশিয়ার এম্বাসেডরকে পোল্যান্ডে কোন ব্র্যান্ডের রঙ মাখানো হল এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত না জানলেও হবে। এইসব বিশ্লেষণ রিটেনের খাতায় যত লিখবেন ততই লাভ। কিন্তু প্রিলিতে ১২০ মার্কস পাওয়ার জন্য কারেন্ট এফেয়ার্স জানার দরকার নেই। বিগত বছরের প্রশ্ন ঘাটলে দেখবেন সাম্প্রতিক বিষয়াবলি থেকে ৫-৬ টার বেশি প্রশ্ন কখনোই আসেনি। ৫-৬ মার্কস পাওয়ার জন্য এই মুহূর্তে সময় অপচয় করার কোন প্রয়োজন আছে?
সাধারণ জ্ঞান: সিলেবাস দেখলে যে কারোর মাথা ঘুরাতে বাধ্য। বিশাল সিলেবাস, কমন পড়ার চান্স ফিফট-ফিফটি। সাধারণ জ্ঞান এমনই এক অসাধারণ বিষয় যেটা আপনি আগামী ৬ মাস টানা পড়েও গ্যারান্টি দিয়ে বলতে পারবেন না যে আপনি আদৌ কিছু কমন পাবেন কিনা। আবার কপাল ভালো থাকলে কিছু না পড়েও আপনার জানা জিনিস থেকে কমন পেয়ে যেতে পারেন। আর এই শেষ মুহূর্তে এসে এই বিশাল সিলেবাসে হাবুডুবু খাওয়ার তো মানেই হয় না। তারপরও যদি আপনার খুব অপরাধবোধ হতে থাকে সাধারণ জ্ঞান দেখে না গেলে, আপনার প্রিয় ডাইজেস্টটা থেকে কয়েকটা টপিক চোখ বুলিয়ে যেতে পারেন-
--বাংলাদেশের প্রাচীন ইতিহাস
-- মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস (১৯৪৭-৭১)
-- বাংলাদেশের সংবিধান
-- বাংলাদেশের সম্পদ (কৃষিজ, খনিজ, বনজ)
-- বাংলাদেশের নদ-নদী
-- আন্তর্জাতিক সংস্থা, তাদের সদর দপ্তর, প্রতিষ্ঠাকাল
-- আন্তর্জাতিক বিখ্যাত চুক্তি
-- বিখ্যাত প্রণালী
নৈতিকতা ও সুশাসন: সময় অপচয় করার ইচ্ছা না থাকলে এই জিনিস টা পরীক্ষার আগে আর না দেখাটাই ভালো। পড়লেও যা, না পড়লেও তা। আমি কখনো এ জিনিস পড়িনি, তাও ৫-৬ টা অনায়াসে দাগিয়ে চলে আসছি। এই টপিক টা টোটালি আপনার কমনসেন্সের উপর নির্ভর করে। আপনি অপশন দেখে হালকা সেন্স খাটালেই বুঝতে পারবেন উত্তর কোনটা হওয়া উচিত। তারপরও একান্তই না বুঝলে আন্দাজে দাগাবেন না। Just skip that question.
আরও পড়ুন: প্রিলি শুধুই ন্যূনতম কাট মার্কস তুলে নিরাপদে উতরে যাওয়ার পরীক্ষা
মানসিক দক্ষতা: ভয় পাবেন না। এটা আমি বাদ দিতে বলবো না। তবে পড়তে না করবো। যেটা করবেন তা হল, অন্যান্য পড়া পড়তে পড়তে যখন ক্লান্ত লাগবে বা একঘেয়ে লাগবে তখন বিগত বছরের প্রশ্নগুলো নিয়ে মানসিক দক্ষতার পার্টটুকু সলভ করবেন। কাজ যা হওয়ার এতেই হয়ে যাওয়ার কথা।
পরীক্ষার স্ট্র্যাটেজি
পরীক্ষার হলের দুই ঘণ্টার স্ট্র্যাটেজি পড়ার স্ট্র্যাটেজির চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ভালো প্রিপারেশন নিয়েও পরীক্ষা হলের একটা ভুল কর্মকাণ্ড আপনার পুরো পরিশ্রমে পানি ঢেলে দিতে পারে। আমি আমার কিছু টিপস শেয়ার করছি-
• পরীক্ষার দুই ঘণ্টাকে দুইভাগে ভাগ করুন। প্রথম এক ঘন্টার মধ্যে চেষ্টা করবেন ২০০টা প্রশ্ন অন্তত একবার কাভার করতে। প্রথম প্রচেষ্টায় শিওর হয়ে যতগুলো দাগাতে পারবেন ঠিক ততটাই দাগাবেন। এই পর্যায়ে কোন সেকেন্ড থট দিবেন না। যেটা সামান্যতম কনফিউজিং মনে হয় সেটাও দাগাবেন না। যেগুলা উত্তর করবেন প্রশ্নপত্রে মার্ক করে রাখুন। ওগুলোতে আর দ্বিতীয়বার ফিরে তাকাবেন না।
• এবার খুব দ্রুত ৩০ সেকেন্ডের মধ্যে গুণে ফেলুন কয়টা দাগাতে পারলেন। যদি ১০০+ হয়ে যায়, Congratulations in advance! যদি ৯০-১০০ এর কাছাকাছি হয়ে যায়, আপনি পথে আছেন। সেকেন্ড হাফে খেলে দিতে হবে। যদি ৮০-৯০ এর মাঝে হয়, একটু টেনশন এর ব্যাপার বৈ কি, তবে হাল ছাড়া যাবে না। আর এর নিচে হলে এবার দৈব সহায়!
আরও পড়ুন: উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে বিসিএস প্রস্তুতি, ম্যাজিস্ট্রেট হলেন নওশীন
• পরের এক ঘন্টা আরও গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এবার আপনার মাথা খেলাতে হবে আরও বেশি। কমনসেন্স এপ্লাই করতে হবে বেশি। এবার প্রশ্নপত্রে যেগুলো মার্ক করা নাই, মানে প্রথম ঘণ্টায় উত্তর করেন নাই ওগুলাতে ফেরত যান। যে বিষয়গুলোতে আপনার দখল বেশি সেগুলো আগে দেখেন। যেগুলো ফিফটি-ফিফটি মনে হচ্ছিল, দুইটা অপশনের মধ্যে কনফিউজড ছিলেন সেগুলো বেশি করে দেখেন। মানসিক দক্ষতা যেগুলো প্রথমে পারেন নি, সেগুলো আবার চেষ্টা করেন। ম্যাথ যেগুলো পারেন নাই, আবার করেন। গ্রামার যেটা মনে আসছিল না আবার দেখেন মনে আসে কিনা। কিন্তু যেটা একদমই কস্মিনকালেও পড়েন নি বা দেখেন নি বা কমনসেন্স খাটিয়েও লাভ হচ্ছে না এরকম কিছু ভুলেও আন্দাজে দাগাবেন না। না মানে না! এভাবে দেখবেন আরও ২৫-৩০ টা দাগানো হয়ে গিয়েছে। এবার থামেন।
• আবার গুণেণ। ১৪০-১৫০ টা হয়ে গেলে প্রশ্নটা উল্টায়ে চুপচাপ বসে ঘুমান। আপনার মাংস চুরি শেষ৷ আর বেশি টাইম দিলে আপনি ধরা।
• ১৩০-১৪০ হলে মোটামুটি সেইফ, কিন্তু চাইলে কিছু রিস্ক নিতে পারেন। কত রিস্ক নিবেন সেটা আপনিই ঠিক করেন। সংখ্যা টা যেন খুব বেশি না হয়।
• ১২০-১৩০ এর মধ্যে হলেও সেইফ যদি আপনার নেগেটিভ মার্কিং খুব বেশি না হয়। মানে আপনি যদি আগের গুলো খুব শিউর শট দাগিয়ে থাকেন এবং সেগুলো সঠিক হয়। কিন্তু নেগেটিভ মার্ক বেশি হয়ে গেলে সমস্যা। আপনাকেই বুঝতে হবে এ যাত্রায় ১২০ এর আশেপাশে থাকতে হলে কী পরিমাণ রিস্ক আপনাকে আর নিতে হবে।
• সেকেন্ড হাফেও ১০০-১১০ এর উপরে উঠতে না পারলে কী হল ছেড়ে চলে যাবেন? খেলতে আসছেন যখন, বাঁশি না বাজা পর্যন্ত তো খেলা ছেড়ে চলে আসা যাবে না তাই না? তাহলে বড় একটা নিঃশ্বাস নিয়ে সাথে আল্লাহর নাম নিয়ে শেষ ১৫-২০ মিনিট লেগে পড়েন। আপনার এবার হারানোর কিছু নাই, এক হিসাবে আপনিই সবচেয়ে রিস্ক ফ্রি! কাজেই যা জীবনে একবার হলেও কোনদিন পাতা উল্টিয়েছিলেন মনে পড়ে, সেটায় ফ্ল্যাশব্যাকে চলে যান, আর বিসমিল্লাহ বলে দাগান। চেষ্টা করেন ১৫০ টার আশেপাশে হলেও দাগাতে। ৫০ টা এভাবে দাগালে যদি ২০ টাও লেগে যায় তাও আপনি জিতেছেন।
• ওএমআর শিটে প্রতিটা, আই রিপিট, প্রতিটা গোল্লা ভরাটের সময় প্রশ্নের নাম্বারের সাথে উত্তরের নাম্বার মিলাবেন। আমি মুখে জোরে জোরে পড়ে মিলাতাম, যেমন ১৪ নং- ১৪ নং। তবে এত জোরেও না যে ইনভিজিলেটর শুনতে পায়! যেগুলো আপনি দাগাবেন না, ওই খালি বৃত্তে যেন আরেকটা উত্তর না ভরাট করে ফেলেন। এটা প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় করা সবচেয়ে কমন মিসটেক।
• কিছু প্রশ্ন আছে যেগুলো আপনাকে কাচ্চির আলুর মত কাছে ডাকবে, বলবে আমাকে দাগা আমাকে দাগা! কিন্তু সেগুলো আসলে কাচ্চির আলু না, গ্রেনেড বোমা। দাগাতে গেলেই গ্রেনেডের মত আপনার কাট মার্কস উড়ায় দিবে। তাদের চিনতে হবে। যতই আকর্ষণীয় লাগুক তাদের কাছে ঘেঁষা যাবে না। নিজের উপরে কনফিডেন্স রাখুন। মনে রাখবেন, আপনার জন্য যেটা কঠিন সেটা সবার জন্যই কঠিন। সবাই দাগায় ফেললো আমি পারলাম না, এই চিন্তা করে বেশি দাগাতে যাবেন না।
• ম্যাথ আর মেন্টাল এবিলিটি সবার শেষে দাগানোটাই ভালো। এটা অনেকবার বলা কথা। আমিও বললাম।
• প্রতিদিন দুই-একটা মডেল টেস্ট দিবেন। এতে পরীক্ষা হলে করা ভুলগুলো হবে না, আর আপনি নিজেই অনেক স্ট্র্যাটেজি আবিষ্কার করে ফেলবেন। এক্সাম হলে গিয়ে কনফিডেন্ট ফিল করবেন।
আজ এ পর্যন্তই। লেখাটা অনেক বড় হয়ে গেল। শেষ কথা বলে যাই, কোনভাবেই হাল ছাড়া যাবে না শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। হারার আগে হারা যাবে না। লেগে থাকুন, ফলাফল তার উপর ছেড়ে দিন।
We plan, and He plans.
Indeed He is the best of planners.
লেখক: সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ এন্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন এবং সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট (সুপারিশপ্রাপ্ত), ৪০তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার, মেধাক্রম-৬৪