ঈদের দিন যে উপায়ে কাটাবেন
রমজানের ৩০ দিন সিয়াম সাধনা করার পর এসেছে পবিত্র ঈদ উল ফিতর। শাওয়াল মাসের চাঁদ অর্থাৎ সূর্যাস্তে একফালি নতুন চাঁদ দেখা গেলে পরদিনই ঈদ ঘোষণা করা ইসলামী শরিয়তের বিধান। সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশের আকাশে শাওয়াল মাসের চাঁদ দেখা গেছে। তাই আজ মঙ্গলবার মুসলমানদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব পবিত্র ঈদুল ফিতর উদযাপিত হবে।
দিনটি মুসলমানদের সবচেয়ে বড় দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে অন্যতম। তাই বিশ্বজুড়ে মুসলমানরা নানা রকম উৎসাহ উদ্দীপনায় এ দিনটি উদযাপন করে থাকেন। ঈদ প্রতি বছরই মুসলমানদের জীবনে খুশির বারতা নিয়ে আসে।
ঈদে ধনী-দরিদ্র নির্বিশেষে সবাই কোলাকুলি, সালাম ও শুভেচ্ছা বিনিময়ের মাধ্যমে আনন্দ ভাগ করে নেন। মহানবী হযরত মোহাম্মদ (সা:) এদিন সবার সঙ্গে ঈদের আনন্দ শেয়ার করতেন। তাহলে চলুন যে উপায়ে ঈদের দিনটি কাটাবেন তা জেনে নেই।
ঈদের দিন কাটাবেন যে উপায়ে
> ঈদের চাঁদ দেখা অত্যন্ত আনন্দের ও গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ চাঁদের হিসাবেই ঈদ পর্ব শুরু হয়। তাই রমজানের শেষদিকে চাঁদের খবর নিতে সবাইকে উৎসুক দেখা যায়। আমাদের প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামও ঈদের চাঁদ দেখার জন্য উৎসুক থাকতেন। পবিত্র হাদিস গ্রন্থ তিরমিজি ও মিশকাত শরীফের বর্ণনায় এসেছে, চাঁদ দেখা মাত্র তিনি এই দোয়া পড়তেন:
اَللهُ اَكْبَرُ اَللَّهُمَّ أَهِلَّهُ عَلَيْنَا بِالْأَمْنِ وَ الْاِيْمَانِ وَالسَّلَامَةِ وَ الْاِسْلَامِ وَ التَّوْفِيْقِ لِمَا تُحِبُّ وَ تَرْضَى رَبُّنَا وَ رَبُّكَ الله
উচ্চারণ : ‘আল্লাহু আকবার, আল্লাহুম্মা আহিল্লাহু আলাইনা বিল আমনি ওয়াল ঈমানি ওয়াস্সালামাতি ওয়াল ইসলামি ওয়াত্তাওফিকি লিমা তুহিব্বু ওয়া তারদা রাব্বুনা ওয়া রাব্বুকাল্লাহ।’
অর্থ : ’আল্লাহ মহান, হে আল্লাহ! এ নতুন চাঁদকে আমাদের নিরাপত্তা, ঈমান, শান্তি ও ইসলামের সঙ্গে উদয় কর। আর তুমি যা ভালোবাস এবং যাতে তুমি সন্তুষ্ট হও, সেটাই আমাদের তাওফিক দাও। আল্লাহ তোমাদের এবং আমাদের প্রতিপালক।’
> আজ ঈদ আর এই ঈদে সবাইকে জানাই- ‘ঈদ মোবারক : তাকাব্বালাল্লাহু মিন্না ওয়া মিনকুম’। ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় করা সুন্নাত। রমজানের রোজা পালনের পর মুসলিম উম্মাহর আজ খুশির দিন।
> ঈদের দিনের আনন্দ যেন আমাদেরকে ওয়াক্তের নামাজ থেকে গাফেল করে না দেয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। রোজাদারের প্রকৃত আনন্দই হবে ঈদের দিনেও ওয়াক্তের নামাজ জামাতের সঙ্গে আদায় করা। পবিত্র হাদিস গ্রন্থ বুখারি ও মুসলিমের বর্ণনায় এসেছে, হজরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, যদি তারা ইশা ও ফজর নামাজের মধ্যে কী আছে তা জানতো তবে হামাগুড়ি দিয়ে হলেও এ দুটি নামাজের জামায়াতে উপস্থিত হতো।
> ঈদের দিন মহানবী (সা.) সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতেন এরপর গোসল করে সুগন্ধি মেঁখে উত্তম পোশাক পরিধান করতেন। ঈদুল ফিতরে তিনি মিষ্টি খাবারও খেতেন। ঈদগাহে যাওয়া-আসায় ভিন্ন রাস্তা ব্যবহার করতেন। ঈদগাহে গিয়ে অতিরিক্ত ছয় তাকবিরের সঙ্গে দুই রাকাত নামাজ আদায় করতেন। নামাজ শেষে তিনি মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে খুতবা প্রদান করতেন। ঈদুল ফিতরের খুতবায় ঈদের করণীয় কাজ এবং ঈদুল ফিতরের গুরুত্ব বর্ণনা করতেন। তিনি সবাইকে ঈদের শুভেচ্ছা জানাতেন। গরিব-দুঃখীদের খোঁজখবর নিতেন। ছোটদের ভালবাসতেন।
> ঈদের তাকবির: ঈদের চাঁদ তথা শাওয়ালের চাঁদ দেখার পর প্রথম সুন্নাত কাজ তাকবির পড়া। এ তাকবির ঈদের দিন নামাজের সময় পর্যন্ত পড়তে হয়। তাহলো-
১. হজরত ইবনে মাসউদ রাদিয়া্ল্লাহু আনহু তাকবির পাঠ করে বলতেন-
اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر لَا اِلَهَ اِلَّا اللهُ وَاللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَروَلِلهِ الْحَمْد
উচ্চারণ : ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবার, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু ওয়াল্লাহু আকবার আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’
২. হজরত ইবনে আব্বার রাদিয়াল্লাহু আনহু বলতেন-
اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَر اَللهُ اَكْبَروَلِلهِ الْحَمْد اَللهُ اَكْبَر وَأَجًلُّ اَللهُ اَكْبَر عَلَى مَا هَدَانَا
উচ্চারণ : ‘আল্লাহু আকবর, আল্লাহু আকবার, আল্লাহু আকবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ আল্লাহু আকবার ওয়া আঝাল্লু আল্লাহু আকবার আলা মা হাদানা।’
৩. অন্য এক বর্ণনায় এভাবে তাকবিরে পাঠের কথা এসেছে-
اَللهُ اَكْبَرْ كَبِيْراً اَللهُ اَكْبَر كَبِيْراً اَللهُ اَكْبَروَ أَجَلُّ اَللهُ اَكْبَر وَلِلهِ الْحَمْد
উচ্চারণ : ‘আল্লাহু আকবার কাবিরা, আল্লাহু আকবার কাবিরা, আল্লাহু আকবার ওয়া আঝাল্লু, আল্লাহু আবর ওয়া লিল্লাহিল হামদ।’
আরও পড়ুন: ১৪ জেলার যেসব এলাকা আজ ঈদ উদযাপিত হচ্ছে
> ঈদের আগে ফিতরা আদায় করা: ঈদের পূর্বে প্রত্যেক মুসলমান নর-নারী, শিশু এমনকি সদ্য জন্মলাভকারী শিশুর জন্যও নির্ধারিত ফিতরা আদায় করা জরুরি। ফিতরার টাকা দিয়ে গরিব, অসহায় দুঃস্থগণ অন্যান্যদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ করে থাকে। যেহেতু ফিতরার টাকা দিয়ে দুঃস্থ অসহায়গণ ঈদ করেন, তাই ঈদের কিছুদিন আগে এ টাকা আদায় করা সবচেয়ে উত্তম।
এ ফিতরা ঈদের নামাজের আগেই আদায় করা উচিত। কেননা গরিব রোজাদার যেন ফিতরার অর্থ দিয়ে ঈদের খুশিতে অংশগ্রহণ করতে পারে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
ফিতরা দেয়া কারও ওপর কোনো প্রকার অনুগ্রহ নয়। এটা আমাদের জন্য ইবাদতের অংশ। এমনকি যে ব্যক্তিকে ফিতরার সাহায্য দেয়া হয়, তার নিজের পক্ষ থেকেও ফিতরা দেয়া কর্তব্য।
> ঈদগাহে হেঁটে যাওয়া: ঈদের দিন নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া। যদি ওজর থাকে তা ভিন্ন কথা। কেননা ঈদের নামাজ আদায়ের জন্য ঈদগাহে পায়ে হেঁটে যাওয়া সুন্নাত। তারপর এক পথে গিয়ে অন্য পথ ধরে ফিরে আসা সুন্নত। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদের দিনে পথ বিপরীত করতেন। (বুখারি)
> পবিত্র ঈদ উপলক্ষে ঈদী বা ঈদের উপহার বিতরণ করা মুসলমানদের মধ্যে চালু হয়ে আসছে। ঈদের খুশিতে আত্মীয়-অনাত্মীয় পরস্পরকে তোহফা বিনিময় করে থাকে, এটি একটি ভাল রীতি। এতে পরস্পরের আন্তরিকতা সৃষ্টি হয়, ভ্রাতৃত্বের বন্ধন সুদৃঢ় হয়। কাপড়-চোপড়, দ্রব্যাদি, টাকা-পয়সা ইত্যাদি ঈদের তোহফা হিসাবে বিতরণ করা হয়ে থাকে।
অনেকে তৈরি খাবার, মিষ্টি বিতরণ করে থাকেন। অনেকে বাড়ি বাড়ি ঘুরে কুশলাদি বিনিময় ও তোহফা বিতরণ করে থাকেন। আর এসবের মাঝেই একজন আল্লাহপ্রেমিক খুঁজে পায় তার রবের স্বাক্ষাত।
> ঈদের নামাজ: ঈদের নামাজের মাধ্যমেই ঈদের প্রকৃত আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। ঈদের সব প্রস্তুতি মূলতঃ আল্লাহ তাআলার উদ্দেশ্যে শুকরিয়াস্বরূপ দুই রাকাআত নামাজ পড়ার মাধ্যমে। সকাল-সকাল খোলা মাঠে অথবা মসজিদে এই দুই রাকাআত নামাজ আদায় করতে হয়।
ঈদের নামাজে আজান ও আকামত নেই। দুই রাকাআত নামাজে অতিরিক্ত ৬ তাকবির (আল্লাহু আকবার) দিতে হয়। প্রথম রাকাআতে তাকবিরে তাহরিমা ও ছানা পড়ার পর সুরা ফাতেহার আগে অতিরক্তি ৩ তাকবির (আল্লাহু আকবার) দিতে হয়। তারপর যথারীতি ১ম রাকাআত সম্পন্ন করে দ্বিতীয় রাকাআতে সুরা ফাতেহা ও কেরাত পড়ার পর রুকুর আগে ৩ তাকবির (আল্লাহু আকবার) দিতে হয়। তার পর যথারীতি নামাজ সম্পন্ন করতে হয়।
> নামাজের পর খুতবা শোনা: ঈদের নামাজ জামাআতে আদায়ের পর খুতবা বাধ্যতামূলক শুনতেই হবে এমন কথা নেই। তবে খুতবা শুনা সওয়াবের কাজ। কারণ দুই খুতবায় আল্লাহর গুণগান, প্রশংসা, তাকবির পাঠ করা হয়। তা শ্রবণ করলে এবং পাঠ করলে অধিক সওয়াব পাওয়া যায়। হাদিসে এসেছে, হজরত আব্দুল্লাহ বিন সায়েব রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে ঈদ উদযাপন করলাম। যখন তিনি ঈদের নামাজ শেষ করলেন, তখন বললেন, আমরা এখন খুতবা দেব। যার ভাল লাগে সে যেন বসে আর যে চলে যেতে চায় সে যেতে পারে। (আবু দাউদ)
> ঈদের নামাজে যাওয়ার আগে খাবার বা মিষ্টান্ন খাওয়া: রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঈদ-উল- ফিতরের দিন কিছু খেজুর না খেয়ে বের হতেন না। কোনো কোনো বর্ণনা এসেছে তিনি বিজোড় সংখ্যায় খেঁজুর খেতেন। সুতরাং ঈদ-উল-ফিতরের দিনে নামাজ আদায় করতে যাওয়ার আগে খেজুর, মিষ্টান্ন বা খাবার গ্রহণ করা।
প্রসঙ্গত, করোনা মহামারির কারণে গত দু’বছর সংক্রমণ আতঙ্ক ও বিধিনিষেধের মধ্যেই মানুষ নিয়ন্ত্রিত জীবন যাপন করেছে। সংক্রমণরোধে বন্ধ ছিল রেল, দূরপাল্লার বাস ও লঞ্চ চলাচল। এর প্রায় দুই বছর পর করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ায় গত ২২ ফেব্রুয়ারি থেকে তুলে দেয়া হয় বিধিনিষেধ। এতে করে নতুন স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে আসে এবারের রমজান মাস। সেই সঙ্গে বছর ঘুরে আবার এসেছে মুসলমানদের প্রিয় ঈদ উৎসব। এইবার প্রিয়জনদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করতে প্রায় ১ কোটি লোক রাজধানী ঢাকা ছেড়েছেন। এ কারণে এখন ঢাকার রাস্তায় নেই আগের মত চিরাচরিত যানজট। শহরের রাস্তাগুলোতে অনেকটা নীরবতা বিরাজ করছে। চলছে হালকা যানবাহন।