মুদ্রা ব্যবস্থা হিসাবে টাকার আগমন
আজ থেকে আনুমানিক খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৬ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য বিনিময় ব্যবস্থার প্রচলন শুরু হয়। মেসোপটেমিয় সভ্যতার ফোনিশিয়ান জাতিগোষ্ঠীর হাত ধরে এটির যাত্রা শুরু হয়। বিনিময় ব্যবস্থার মাধ্যমে তারা উৎপাদিত খাদ্য শস্য বিক্রি করত। পরবর্তীতে ব্যবিলনিয়রা বিনিময় ব্যবস্থাকে আরও উন্নত করে। তারা দ্রব্য আদান-প্রদান করতো খাবার, অস্ত্র এবং বিভিন্ন সরঞ্জাম বিনিময় করে। খ্রিস্টের জন্মের আনুমানিক ৩ হাজার বছর আগে সুমেরিয়রা ভূট্টা বা গম বিক্রির জন্য প্রথম ধাতব মুদ্রার ব্যবহার করে। এরপর খ্রিস্টের জন্মের ৭ শ বছর পূর্বে লিডিয়ায় বর্তমান তুরস্কে রূপা ও সোনার সংকর দিয়ে তৈরি মুদ্রার প্রচলন শুরু হয়। অর্থাৎ বর্তমান পশ্চিম তুরস্ক যাকে পূর্বে লিডিয়া নামে ডাকা হতো তারাই প্রথম পশ্চিমা জগতে মুদ্রা ব্যবস্থার পরিচয় ঘটান।
কাগুজে মুদ্রার বা নোটের প্রচলন শুরু হয় বর্তমান চীন দেশে। ট্যাঙ রাজার রাজত্বকালে (৬১৮-৯০৭ সাল)। এই কাগুজে মুদ্রা প্রচলনের আরও ৬শ বছর আগে চীনারা গাছের বাকল থেকে কাগজ তৈরির কৌশল রপ্ত করেছিল। কাগজ তৈরির গোড়ার দিকে সরাসরি গাছের বাকল ব্যবহার করা হত বলে কাগজ ভারী ছিল। কিন্তু এরপর গাছের বাকলের পরিবর্তে কাণ্ডের নরম অংশ কেটে কাগজ তৈরি করতে লাগলো তারা। এতে কাগজ আগের চেয়ে হালকা হয় ফলে লেখা আরও স্পষ্ট হয়।
আরও পড়ুন: কিডনি রোগ আছে কি-না বোঝার উপায়
চীনা বিনিময় ব্যবস্থার ধারণাটি ছিল অর্থ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে একটি মাইলফলক। ট্যাঙ রাজত্বের শেষের দিকে কাগুজে মুদ্রার আগমন ঘটলে দেশটির বণিকরা দলে দলে তাদের সকল স্বর্ণ-রৌপ্য মুদ্রা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা করতে থাকে। ওই আমলে চালু করা কাগুজে মুদ্রার নোটকে বলা হতো হেকান। এদিকে মুদ্রা ব্যবস্থা সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য চীনের মিং রাজাদের রাজত্বকালে অর্থ মন্ত্রণালয় গঠন করা হয়। মিংদের আমলে চালু করা অর্থ মন্ত্রণালয় নিয়ে আসে নতুন নোট ব্যবস্থা। অর্থাৎ এখনকার নোটের মতো তখনকার চীনে ভিন্ন ভিন্ন ছয়টি নোট বাজারে ছাড়া হয়।
ইউরোপের কাছে তখনও কাগজের নোট পরিচিত নয়। তখন তাদের কাগজের ধারণাই ছিল না।যুক্তরাষ্ট্রে ১৭৬০ সালে প্রথম ডলার ছাপানো হয় এবং তা সর্বজন কর্তৃক গৃহীত হয়। এরপর ইউরোপেও কাগুজে নোটের প্রচলন শুরু হয়। কেননা উত্তর আমেরিকার উপনিবেশিক সরকারগুলো ছিল ইউরোপীয়ান। ইউরোপের সরকার ব্যবস্থাও এই মুদ্রা ব্যবস্থা চালু করে।
এদিকে ভারতীয় উপমহাদেশে ইংরেজদের হাত ধরে সর্বপ্রথম কাগজের নোটের প্রচলন শুরু হয়। সেই লক্ষ্যে ১৮৬১ সালে সর্বপ্রথম মুদ্রা আইন পাস করানো হয়। এরপর ১৯৩৫ সালে ভারতের রিজার্ভ ব্যাংক প্রতিষ্ঠিত হয়।
আরও পড়ুন: কাঁচা মরিচের স্বাস্থ্য উপকারিতা
তবে ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি স্বাধিন বাংলাদেশের মুদ্রা হিসাবে টাকার প্রচলন শুরু হয়। তার আগে ভারতীয় উপমহাদেশ এবং পাকিস্তানের অধীনে থাকাকালীন রুপি ব্যবহার করা হত। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি রুপির একপাশে ‘বাংলা দেশ’ এবং অপর পাশে ইংরেজিতে ‘বাংলা দেশ’ লেখা রাবার স্ট্যাম্প ব্যবহার করা হতো।
তবে ‘টাকা’ শব্দটি এসেছে সংস্কৃত ভাষা থেকে। সংস্কৃত শব্দ ‘টঙ্ক’, যার অর্থ রৌপ্যমুদ্রা। পরবর্তী সময়ে মুদ্রার নাম দেয়া হয় টাকা। আগে যেকোনো ধরনের মুদ্রা বা ধাতব মুদ্রা বোঝাতে টাকা শব্দটির প্রচলন ছিল। অর্থাৎ টাকা দিয়ে সব সময়ই অর্থকে বোঝানো হয়েছে। চতুর্দশ শতকের শুরুতে বাংলায় এর প্রচলন শুরু হয়। বাংলা ভাষার একটি অংশ হিসেবে সব ধরনের কারেন্সি বা নোট বা মূলধন বোঝাতে টাকা শব্দের ব্যবহার ছিল।
বর্তমানে বাংলাদেশের গাজীপুরে অবস্থিত টাকশালে (দ্য সিকিউরিটি প্রিন্টিং প্রেস) ব্যাংক নোট ছাপা হয়। টাকশালে ব্যাংক নোট ছাড়াও রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ দলিল, ব্যাংকের চেক বই, বিশ্ববিদ্যালয়ের সনদ থেকে শুরু করে আরো গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র অত্যন্ত নিরাপত্তার সাথে ছাপানো হয়।