রসুনের স্বাস্থ্য উপকারিতা ও অপকারিতা
সকলের পরিচিত প্রাকৃতির গুণে ভরপুর এক উপাদান রসুন। রান্না ছাড়াও ভেষজ উপকরণ হিসেবে প্রাচীনকাল থেকেই রয়েছে রসুনের কদর। তবে রান্নার স্বাদ অটুট রাখতে রসুনের জুড়ি নেই। সহজে উৎপাদন ও প্রাপ্তিতার ফলে এ উপকরণের বহুবিধ ব্যবহার লক্ষণীয়। রসুনকে কেউ রান্নার মসলা হিসেবে, কেউ ভেষজ উপকরণ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
গবেষণা বলছে, রসুনের স্বাস্থ্য উপকারিতা অনেক। নিয়মিত রসুন খেলে শরীরের বহু উপকার হয়। চোখ ভাল রাখা থেকে শুরু করে যৌন দুর্বলতা নিরসন ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রসুন খুবই কার্যকর। কেননা রসুন রয়েছে -ম্যাঙ্গানিজ, ভিটামিন বি১ ও বি৬, ভিটামিন সি, সেলেনিয়াম, ফাইবার, ক্যালসিয়াম, তামা, পটাসিয়াম, ফসফরাস, আয়রন, ক্যালোরি, প্রোটিন এবং কার্বোহাইড্রেটসহ প্রয়োজনীয় প্রায় সব পুষ্টি উপাদান।
সম্প্রতি আমেরিকার ইউনিভার্সিটি অব কানেক্টিকাট স্কুল অব মেডিসিন রসুন নিয়ে একটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছে। প্রতিবেদনে সকালে খালি পেটে রসুন খাওয়ার বিভিন্ন উপকারিতার কথা তুলে ধরা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সকালে নিয়মিত খালি পেটে এককোয়া রসুন খেলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে যায়। কারণ রসুন খাওয়ার ফলে শরীরের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই শরীর চট করে ক্লান্ত হয় না। দেহ থেকে ক্ষতিকর টক্সিন উপাদান বের করে দিতে সহায়তা করে রসুন। আবার রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রেখে বহুল পরিচিত ডায়াবিটিস সমস্যার ঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। এমনকি যারা সারা বছর সর্দি-কাশির মতো সমস্যায় আক্রান্ত থাকেন, তারা নিয়মিত তিন সপ্তাহ খালি পেটে রসুন সেবনে এ থেকে মুক্তি পেতে পারেন।
আরও পড়ুন: এলাচের পুষ্টি উপাদান ও উপকারিতা
একটি গাড়ির ব্যাটারি প্ল্যান্টের কিছু কর্মীদের উপর করা চার সপ্তাহের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, রসুন রক্তে সীসার মাত্রা প্রায় ১৯% কমিয়ে দেয়। ফলে মাথাব্যথা এবং রক্তচাপসহ বিষাক্ততার অনেক ক্লিনিকাল লক্ষণও হ্রাস করেছে বলে জানা যায়। এছাড়া প্রতিদিন তিন ডোজ রসুন এমনকি উপসর্গ কমাতে ড্রাগ ডি-পেনিসিলামিনকে ছাড়িয়ে গেছে।
এছাড়াও বিভিন্ন গবেষণা চালিয়ে রসুনের উল্লেখ্যযোগ্য কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতার কথা জানতে পেরেছে গবেষকরা। গবেষণার তথ্যমতে-
* রসুন শরীরের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে। অ্যাথলেটিক পারফরম্যান্স উন্নত করতে রসুন কার্যকরী ভূমিকা রাখে। তাছাড়া ঐতিহ্যগতভাবেই প্রাচীন সংস্কৃতিতে ক্লান্তি কমাতে এবং শ্রমিকদের কাজের ক্ষমতা বাড়াতে রসুন ব্যবহৃত হতো। জানা যায়, প্রাচীন গ্রিসের অলিম্পিক ক্রীড়াবিদদের দেহের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য নিয়মিত রসুন দেওয়া হতো।
* রসুন সংক্রমক রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে দেহকে সুস্থ রাখে। গবেষণায় দেখা গেছে, নিয়মিত রসুন সেবনের ফলে দেহের ইমিউনিটি ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়। ফলে রোগব্যধি কম হয়। এমনকি অকাল বাধ্যক্য রোধ করতেও সহায়তা করে।
* হাড়ের সুস্থতা ও মহিলাদের মেনোপজ সমস্যায় রসুন খুবই কার্যকর। নিয়মিত রসুন সেবনে হাড়ের উন্নতি হয়। পক্ষান্তরে হাড় ক্ষয় রোধ করে। এছাড়া মহিলাদের ইস্ট্রোজেন হরমোন বাড়িয়ে হাড়ের ক্ষয় কমাতে পারে। এমনকি বৃদ্ধ বয়সে অস্টিওআর্থারাইটিস রোগ থেকে মুক্তি পেতে গুরুপূর্ণ ভূমিকা রাখে।
* ফুসফুসের সংক্রমণ প্রতিরোধে রসুন খুবই কার্যকর। কেননা ফুসফুসে বিভিন্ন ধরণের সংক্রমণ যেমন, অ্যালার্জি, ঠান্ডাজনিত সমস্যা কফ ও সর্দি-কাশি থেকে মুক্তি দেয়।
* প্রতিদিন সকালে খালি পেটে দুই কোয়া রসুন খেলে রক্ত সঞ্চালনক্ষমতা বৃদ্ধি পায়, যার দরুণ রক্ত বাধাগ্রস্ত হয়ে যেসব রোগের সৃষ্টি করে, তা আর হতে পারে না।
* রসুন পুরুষের যৌনক্ষমতা বাড়াতেও বেশ সহায়ক। পুরুষের যৌনক্ষমতা নানান কারণে কমে যেতে পারে, সে ক্ষেত্রে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে দুই কোয়া রসুন খেলে ধীরে ধীরে যৌনক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এটা নিয়ে মানুষের মধ্যে দুই ধরনের মতামত থাকলেও পুরুষের ক্ষমতার মূল উৎস হচ্ছে রক্তের সাবলীল গতি। রসুনে এই কাজ করে বলেই যৌনক্ষমতার কথা বলা হয়ে থাকে।
আরও পড়ুন: ডাবের পানির স্বাস্থ্য উপকারিতা
* অনেকের শরীরে বিভিন্ন জায়গায় ফোলা পিণ্ড থাকে, বাড়ে কমে না, ব্যথাও করে না, কিন্তু ফোলাটা মিশেও না, এমন ফোলা বা গোটা শরীর থেকে মুছে ফেলতে প্রতিদিন ছয়-আট কোষ রসুন সকালে খালি পেটে এবং দুপুর ও রাতে খাবার পর দুইটি করে রসুন কোষ খেলে ফোলাটা ধীরে ধীরে মিশে যাবে। অথবা দুই কোয়া রসুন হালকা করে ভেজে তা খেতে হবে।
* সেল ড্যামেজ রোধ করে ও ত্বককে মসৃণ রাখে। রসুনে উপস্থিত অ্যান্টি–অক্সিডেন্ট ‘সেল ড্যামেজ’ ও ‘এজিং’ রোধ করে। ব্রেনের সেল ড্যামেজ কম হয়ে আলঝেইমারস ও ডিমেনশিয়ার মতো রোগের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। এছাড়া ত্বকে বার্ধ্যকের ছাপ পড়তে দেয়না। এমনকি চেহারায় কোনো দাগ থাকলে কমে যায়।
তবে উপকারের পাশাপাশি রসুন সেবনের কিছু অপকারিতাও রয়েছে। শরীরের অনেক সমস্যার জন্যই রসুন খুব উপকারি। কারণ রসুন শুধু বিভিন্ন ধরণের রোগ দূরই করে না বরং, বিভিন্ন রোগের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। তবে সবার শরীরের জন্যই যে ভালো ফল নিয়ে আসবে তা কিন্তু নয়। রসুনের কিছু কিছু গুণের জন্য শারীরিক সমস্যা বেড়েও যেতে পারে। তাই এ সমস্যাগুলো থাকলে রসুন খাওয়া এড়িয়ে যেতে হবে-
যকৃতের সমস্যায়
রক্ত পরিশোধন, চর্বি ও প্রোটিন বিপাক, শরীর থেকে অ্যামোনিয়া অপসারণ ইত্যাদি হল যকৃতের অন্যতম কাজ। গবেষণা বলে, অতিরিক্ত রসুন সেবনের ফলে যকৃতে বিষক্রিয়া সৃষ্টি হতে পারে। কারণ রসুনে থাকা ‘অ্যালিসিন’ উপাদান যকৃতে বিষক্রিয়া তৈরির জন্য দায়ি।
ডায়রিয়া
খালি পেটে রসুন খেলে ডায়রিয়া হতে পারে। কারণ রসুনে আছে সালফার যা পেটে গ্যাস তৈরি করে এবং ডায়রিয়া হওয়ার পেছনে এর উল্লেখযোগ্য ভূমিকা থাকে।
আরও পড়ুন: লাউয়ে আছে যত উপকার
দৃষ্টিশক্তির সমস্যা
অতিরিক্ত রসুন খাওয়ার কারণে ‘হাইফিমা’ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অর্থাৎ ‘আইরিস’ ও ‘কর্নিয়া’র মাঝে রক্তক্ষরণ ঘটাতে পারে। ফলাফল হারাতে পারে দৃষ্টিশক্তি।
বমি ও বুক জ্বালাপোড়া
যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ক্যানসার ইনস্টিটিউটের প্রকাশিত গবেষণা অনুযায়ী, খালি পেটে তাজা রসুন সেবন করলে বুক জ্বালাপোড়া, বমিভাব ও বমি হতে পারে। হার্ভার্ড মেডিকাল স্কুলের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, রসুনের এমন কিছু উপাদান আছে যা জিইআরডি বা গ্যাস্ট্রোয়েসোফাজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ হওয়ার কারণ।
মুখে দুর্গন্ধ
রসুন বেশি খেলে মুখে দুর্গন্ধ হয়। এর প্রধান কারণ রসুনে থাকা সালফার।
গর্ভবতী নারী ক্ষেত্রে
গর্ভবতী নারীদের রসুন খাওয়া থেকে বিরত থাকা উচিত। কারণ এতে ‘লেইবার পেইন’ বা প্রসব বেদনা বেড়ে যেতে পারে। শিশুকে মাতৃ দুগ্ধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েদেরও রসুন থেকে দূরে থাকতে হবে কারণ তা দুধের স্বাদ পাল্টে দেয়।