যে কাজে রিজিকের বরকত কমে যায়
অনেকেই আছেন ভাল আয়- উপার্জন করার পরও তাদের অভাব কাটছে না। সব সময় অভাব অনটন লেগেই আছে। অনেকে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেও সুখের দেখা পাচ্ছেন না। সবকিছুতেই একটা নাই নাই অবস্থা। তার আসল কারণ তাদের রিজিকের বরকত আর নাই। অর্থাৎ মন্দ কাজ করার ফলে সেসব মানুষের রিজিকের বরকত অনেকটা উঠে গেছে।
মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মানুষের রিজিকে বরকত দান করেন। এ বিষয়ে পবিত্র আল কোরআনের সূরা সাবার ৩৬ নম্বর আয়াতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন,
“قُلۡ اِنَّ رَبِّیۡ یَبۡسُطُ الرِّزۡقَ لِمَنۡ یَّشَآءُ وَ یَقۡدِرُ وَ لٰکِنَّ اَکۡثَرَ النَّاسِ لَا یَعۡلَمُوۡنَ”
“তুমি বল, নিশ্চয় আমার রব যার জন্য চান রিজিক সম্প্রসারিত করে দেন এবং সংকুচিতও করে দেন কিন্তু অধিকাংশ, লোক তা জানে না।” (সূরা সাবা : ৩৬)
বিভিন্ন নেক আমলের মাধ্যমে মানুষ রিজিকের বরকত লাভ করে। মহান আল্লাহ রিজিকে বরকত দিলে একদিকে যেমন অল্পতে তৃপ্তি পাওয়া যায়, অন্যদিকে বরকত না দিলে প্রচুর ধন-সম্পদের মধ্যেও সুখ পাওয়া যায় না। পবিত্র আল কোরআনের সূরা আল মূলকের ১ ও ২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন,
‘تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَى كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ’ এবং ‘الَّذِي خَلَقَ الْمَوْتَ وَالْحَيَاةَ لِيَبْلُوَكُمْ أَيُّكُمْ أَحْسَنُ عَمَلًا وَهُوَ الْعَزِيزُ الْغَفُورُ’
“বরকতময় তিনি যার হাতে সর্বময় কর্তৃত। আর তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।’ এবং ‘যিনি মৃত্যু ও জীবন সৃষ্টি করেছেন যাতে তিনি তোমাদেরকে পরীক্ষা করতে পারেন যে, কে তোমাদের মধ্যে আমলের দিক থেকে উত্তম।” (৬৭:১,২)
ইসলামি চিন্তাবীদদের মতে, বিভিন্ন মন্দ কাজের কারণে মানুষের রিজিকের বরকত কমে যায়। চলুন জেনে নেই যেসব কাজ করলে মানুষের রিজিকের বরকত কমে:
পাপ কাজ করা: মানুষ বিভিন্ন পাপ কাজে লিপ্ত থাকলে তার উপর আল্লাহর তরফ থেকে শাস্তি স্বরুপ নানা রকমের আজাব-গজব নাজিল হয়। মানুষের রিজিকের বরকত কমে যায়। পবিত্র আল কোরআনের সূরা আরাফের ৯৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেছেন,
‘وَلَوْ أَنَّ أَهْلَ الْقُرَى آَمَنُوا وَاتَّقَوْا لَفَتَحْنَا عَلَيْهِمْ بَرَكَاتٍ مِنَ السَّمَاءِ وَالْأَرْضِ وَلَكِنْ كَذَّبُوا فَأَخَذْنَاهُمْ بِمَا كَانُوا يَكْسِبُونَ’
"যদি জনপদ বা শহরগুলোর অধিবাসীরা ঈমান আনতো এবং আল্লাহ্কে ভয় করতো, আমি অবশ্যই তাদের জন্য আকাশ ও পৃথিবীর (সকল) কল্যাণ উন্মুক্ত করে দিতাম। কিন্তু তারা (আমার নিদর্শন বা সত্যকে) প্রত্যাখ্যান করেছিলো। সুতরাং তাদের কু-কর্মের জন্য আমি তাদের (শাস্তির) অন্তর্ভুক্ত করেছি।" (৭:৯৬)
ধোঁকা দেওয়া: মানুষেকে ধোঁকা দিলে কিংবা তাদের সঙ্গে প্রতারণা করলে রিজিকের বরকত কমে যায়। পবিত্র হাদিস গ্রন্থ সহিহ বোখারির বর্ণনায় এসেছে নবী হযরত মোহাম্মদ (সাঃ) বলেন, “ক্রেতা-বিক্রেতা যতক্ষণ পরস্পর বিচ্ছিন্ন না হয়, ততক্ষণ তাদের এখতিয়ার থাকবে (ক্রয়-বিক্রয় সম্পন্ন কিংবা বাতিলের)। যদি তারা সত্য বলে এবং (পণ্যের) অবস্থা ব্যক্ত করে, তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ে বরকত হবে। আর যদি মিথ্যা বলে এবং (পণ্যের) দোষ গোপন করে তাহলে তাদের ক্রয়-বিক্রয়ের বরকত মুছে ফেলা হয়।” (সহিহ বোখারি: ২০৭৯)
আরও পড়ুন: রমজান মাসে ফজিলত বাড়ানোর উপায়
পণ্যের দোষ-ত্রুটি গোপন করে তা বিক্রি করা ক্রেতাকে ধোঁকা দেওয়ার নামান্তর। এই কারণে মানুষের রিজিকের বরকত উঠে যায়। এদিকে পবিত্র সহিহ মুসলিমের আরেকটি হাদিসে এসেছে, নবি করিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘোষণা দিয়েছেন, “যে ব্যক্তি ধোঁকা দেয় বা প্রতারণা করে সে আমাদের (মুসলিমদের) অন্তর্ভূক্ত নয়।” ( সহিহ মুসলিম)
এটি একটি হারাম ও অনৈতিক কাজ। প্রতারণার জন্য মানুষকে অনেক দুঃখ-কষ্ট ভোগ করতে হয়। দেশের প্রচলিত আইনেও এটিকে জঘন্য সামাজিক অপরাধ হিসাবে গণ্য করা হয়। রাষ্ট্রীয় আইনের ৪১৫ ও ৪২০ ধারায় এ অপরাধটিকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ ছাড়াও আইনের ৪০৬, ৪০৮ এবং ৪০৯ নম্বর ধারায় বিশ্বাস ভঙ্গের অপরাধে শাস্তির বিধান রয়েছে।
কথায় কথায় কসম খাওয়া: কিছু মানুষ নিজের কথাকে বিশ্বাস করানোর জন্য অন্যের সঙ্গে কথায় কথায় কসম খায়। কারণে অকারণে কসম খায়। কিন্তু যারা মিথ্যা কসম কাটে তারা বড় ধরনের পাপ কাজ করে থাকেন। এজন্যও মানুষের রিজিকের বরকত কমে যায়। পবিত্র হাদিস গ্রন্থ সহিহ মুসলিমে বর্ণিত আছে নবী করিম (সা.) বলেন, “তোমরা ক্রয়-বিক্রয়ে অধিক কসম করা থেকে সাবধান থেকো। কেননা নিশ্চয়ই তাতে (মিথ্যা কসমে) বিক্রি বেশি হয় কিন্তু পরে (বরকত) ধ্বংস করে।” (সহিহ মুসলিম: ২৭৯৩)
সুদের ব্যবসা: ধন-সম্পদ বাড়ানোর জন্য মানুষ সুদের কারবার করে থাকেন। কিন্তু সুদের বিনিময় করলে মানুষের রিজিকের বরকত চলে যায়। এ সম্পর্কে পবিত্র আল কোরআনের সূরা বাকারার ২৭৬ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা বলেছেন, “আল্লাহ সুদকে নিঃশেষ করেন ও সদকায় প্রবৃদ্ধি দান করেন।” (সূরা বাকারা: ২৭৬)
আরও পড়ুন: আল্লাহর নৈকট্য লাভে তাহাজ্জুদ নামাজ সর্বোত্তম—নিয়ম ও ফজিলত
শুকরিয়া আদায় না করা: মহান আল্লাহতায়ালার অসংখ্য নিয়ামতে আমরা সবাই বেঁচে আছি। তার মধ্যে রিজিক হল অন্যতম নিয়ামত। এসব নিয়ামতের শোকরিয়া আদায় না করলে বরকত ও কল্যাণ লাভ করা যায় না। পবিত্র আল কোরআনের সূরা ইবরাহিমের ৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন,
“وَ اِذۡ تَاَذَّنَ رَبُّکُمۡ لَئِنۡ شَکَرۡتُمۡ لَاَزِیۡدَنَّکُمۡ وَ لَئِنۡ کَفَرۡتُمۡ اِنَّ عَذَابِیۡ لَشَدِیۡدٌ”
“যদি তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার করো, তা হলে আমি অবশ্যই তোমাদের বেশি বেশি করে দেব। আর যদি অকৃতজ্ঞ হও, তাহলে (মনে রেখো) নিশ্চয়ই আমার শাস্তি অত্যন্ত কঠোর।” (সূরা ইবরাহিম: ৭)
অর্থাৎ, নিয়ামতের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আমাদেরকে মহান আল্লাহ অধিক পুরস্কারে পুরস্কৃত করবেন। অপরদিকে, নিয়ামতের অকৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলে আল্লাহ অত্যন্ত অখুশি হন। এ জন্য তিনি অকৃতজ্ঞদের কঠিন শাস্তি দেয়ার ঘোষণা দিয়েছেন।
কৃপণতা: কৃপণতা মানুষকে গুনাহর দিকে ধাবিত করে। তাই মানুষের ইহকালীন ও পরকালীন দুই জীবনেই লোকসানের শিকার হয়। পবিত্র হাদিস গ্রন্থ সুনানে আবু দাউদে বর্ণিত আছে, নবী করিম (সা.) বলেছেন, “তোমরা কৃপণতার ব্যাপারে সাবধান হও। কেননা তোমাদের পূর্ববর্তীরা কৃপণতার কারণে ধ্বংস হয়েছে। অর্থলোভ তাদের কৃপণতার নির্দেশ দিয়েছে, ফলে তারা কৃপণতা করেছে। তাদের আত্মীয়তা ছিন্ন করার নির্দেশ দিয়েছে, তখন তারা তা-ই করেছে এবং তাদের পাপাচারে প্ররোচিত করেছে, তখন তারা তাতে লিপ্ত হয়েছে।” (সুনানে আবু দাউদ: ১৬৯৮)
অসন্তুষ্ট থাকা: মানুষের রিজিকের মালিক মহান আল্লাহতায়ালা। আল্লাহপ্রদত্ত রিজিকের ওপর সন্তুষ্ট থাকলে রিজিকের বরকত হয়। এর বিপরীতে ওই রিজিকের ওপর সন্তুষ্ট না থাকলে রিজিকের বরকত উঠে যায়। পবিত্র হাদিস সংকলন গ্রন্থ মুসনাদে আহমাদের বর্ণনায় এসেছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “আল্লাহ বান্দাকে প্রদত্ত জিনিসের মাধ্যমে পরীক্ষা করে থাকেন। আল্লাহ তার জন্য যা নির্ধারণ করেছেন, তাতে যদি সে সন্তুষ্ট থাকে, তাহলে আল্লাহ তাতে বরকত দান করেন এবং তাকে বৃদ্ধি করে দেন। আর যদি সন্তুষ্ট না থাকে তাহলে তাতে বরকত দেন না।” (মুসনাদে আহমাদ: ২০২৭৯)
আরও পড়ুন: এই গরমেও আরামে থাকার উপায়
অপচয় ও অপব্যয়: অযথা টাকা-পয়সা বা সম্পদ খরচা করাটা অপচয় ব্যতিত আর কিছু নয়। এটা মানুষের বদ অভ্যাস। এ বদ অভ্যাসের কারণে তার মধ্যে চুরি করা, অন্যের সম্পদ আত্মসাৎ, ঘুষ গ্রহণ ইত্যাদি মন্দ স্বভাব চলে আসে। এ জন্য ইসলামে এসব মন্দ কাজ পরিহার করতে বলা হয়েছে। এ প্রসঙ্গে মহান আল্লাহতায়ালা পবিত্র আল কোরআনের সূরা আরাফের ৩১ নম্বর আয়াতে উল্লেখ করেছেন,
“یٰبَنِیۡۤ اٰدَمَ خُذُوۡا زِیۡنَتَکُمۡ عِنۡدَ کُلِّ مَسۡجِدٍ وَّ کُلُوۡا وَ اشۡرَبُوۡا وَ لَا تُسۡرِفُوۡا ۚ اِنَّهٗ لَا یُحِبُّ الۡمُسۡرِفِیۡنَ”
“তোমরা খাও ও পান করো। কিন্তু অপচয় করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ অপচয়কারীদের ভালোবাসেন না।” (সূরা আরাফ: ৩১)
যাকাত না দেওয়া: ইসলামের পাঁচটি মৌলিক স্তম্ভের মধ্যে যাকাত অন্যতম একটি স্তম্ভ। আমরা জানি যাকাত আদায় করা ফরজ। কিন্তু তা জানার পরও অনেকে আদায় করেন না। ফলে জাগতিক ও পরকালীন জীবনে দুর্ভোগ পোহাতে হয়। পবিত্র হাদিস গ্রন্থ সহিহ ইবনে মাজাতে উল্লেখ আছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যখন কোনো জাতি যাকাত আদায় করে না তখন আসমান থেকে বৃষ্টি বন্ধ করে দেওয়া হয়। যদি ভূপৃষ্ঠে চতুষ্পদ জন্তু ও নির্বাক প্রাণী না থাকত তাহলে আর কখনও বৃষ্টি হতো না।’ (ইবনে মাজা: ৪০১৯)
সম্পদের হক হচ্ছে যত বেশি সম্ভব যাকাত দেওয়া। এ হক আদায় না করলে সম্পদে বরকত নষ্ট হয়, মানুষের রিজিকের বরকতও কমে যায়।
অবৈধ উপায়ে উপার্জন: যে ব্যক্তি হারাম উপায়ে আয় উপার্জন করে তার রিজিকের বরকত কমে যায়। পবিত্র হাদিস গ্রন্থ সহিহ মুসলিমে এসেছে, হযরত রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যে ব্যক্তি সংগত পন্থায় সম্পদ অর্জন করে তাকে বরকত দান করা হয়। আর যে ব্যক্তি অসংগত পন্থায় সম্পদ অর্জন করে সে এমন ব্যক্তির মতো যে আহার করে, কিন্তু তৃপ্ত হয় না।” (সহিহ মুসলিম: ১০৫২)
হালাল উপার্জনের বিষয়ে পবিত্র আল কুরআনের সূরা আনকাবুতের ১৭ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন,
“ إِنَّمَا تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ أَوْثَانًا وَتَخْلُقُونَ إِفْكًا إِنَّ الَّذِينَ تَعْبُدُونَ مِنْ دُونِ اللَّهِ لَا يَمْلِكُونَ لَكُمْ رِزْقًا فَابْتَغُوا عِنْدَ اللَّهِ الرِّزْقَ وَاعْبُدُوهُ وَاشْكُرُوا لَهُ إِلَيْهِ تُرْجَعُونَ”
“সুতরাং তোমরা আল্লাহর কাছে রিজিক তালাশ কর, তার ইবাদত কর এবং তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর। তারই কাছে তোমাদের ফিরে যেতে হবে।” (সূরা আনকাবুত : আয়াত ১৭)
আমাদের রিজিকের বরকত অব্যাহতভাবে পাবার জন্য উপরে উল্লেখিত কাজগুলো পরিহার করে চলতে হবে।