আল্লাহর নৈকট্য লাভে তাহাজ্জুদ নামাজ সর্বোত্তম—নিয়ম ও ফজিলত

আল্লাহর নৈকট্য লাভে রাতের শেষভাগে তাহাজ্জুদ নামাজ সর্বোত্তম
আল্লাহর নৈকট্য লাভে রাতের শেষভাগে তাহাজ্জুদ নামাজ সর্বোত্তম   © প্রতীকী ছবি

পবিত্র কুরআনে সূরা জারিয়াতের ৬৫ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি মানুষ এবং জিনকে একমাত্র আমার ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি।’ তাই আল্লাহর নৈকট্য লাভের জন্য তাঁর ইবাদত করা একান্তই জরুরি। আল্লাহর ইবাদতের অন্যতম একটি ফরজ ইবাদত নামাজ। যার মাধ্যমে বান্দা তাঁর প্রভুর প্রিয় পাত্র হতে পারে।

পবিত্র কুরআন ও হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, ফরজ নামাজের পর সকল সুন্নাত ও নফল নামাজের মধ্যে তাহাজ্জুদ নামাজের বরকত ও ফজিলত সবচেয়ে বেশি। যার মাধ্যমে বান্দা তাঁর প্রভুর আরো বেশি নৈকট্য লাভ করতে পারে। তাই রাসূল (স.) নিজে নিয়মিত তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করার পাশাপাশি সাহাবিদের এ বিষয়ে তাগিদ দিতেন।

মুসলিম ও তিরমিজি শরীফের হাদীসে তাহাজ্জুত নামাজকে ফরজ নামাজের পর সর্বোত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। আবু হোরায়রা (রা:) থেকে বর্ণিত রাসূল (সা.) বলেছেন, ‘আমি রাসূলুল্লাহ (সাঃ)-কে বলতে শুনেছি, ফরজ নামাজের পর সবচেয়ে উত্তম নামাজ হলো তাহাজ্জুদের নামাজ।’

তাহাজ্জুদের সময় আল্লাহ তাঁর বান্দার দোয়া কবুল করেন। মুসলিম ও মেশকাত (১০৯ পৃঃ) শরীফের হাদিসে বর্ণিত হয়েছে রাসূল (স.) বলেছেন, প্রত্যেক রাতের এক-তৃতীয়াংশে আল্লাহ দুনিয়ার আসমানে নেমে বান্দাদেন উদ্দেশ্যে বলেন, তোমাদের কে আছো, আমাকে ডাকবে! আমি তার ডাকে সাড়া দেব। কে আমার কাছে কিছু চাইবে! আমি তাকে তা দেব, কে আমার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করবে! আমি তাকে ক্ষমা করে দেব।

তাহাজ্জুদ অর্থ- ঘুম থেকে জাগা এবং নামাজ অর্থ- প্রার্থনা করা। সুতরাং মধ্যরাতে ঘুমা থেকে জেগে প্রভুর সান্নিধ্যে একান্ত প্রার্থনা করাই মূলত তাহাজ্জুদ নামাজের উদ্দেশ্য। তাহাজ্জুদকে সালাতুল লাইল-ও বলা হয়। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হওয়ার আগে নবী করিম (স.)-এর উপর তাহাজ্জুদ আদায় ফরজ ছিল। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হলে এটি নফল ইবাদতে পরিণত হয়। তবে এ নামাজের বরকত ও ফজিলত অন্য সব সুন্নত ও নফল নামাজের চেয়ে অনেকগুণ বেশী।

রাতের শেষ অংশে তাহাজ্জুদ পড়া সর্বোত্তম

তাহাজ্জুদ নামাজের সময় মূলত এশার নামাজের পর থেকেই শুরু হয়। তবে রাতের শেষ তৃতীয়াংশে এ নামাজ পড়া উত্তম। কিন্তু কারো মধ্যরাতে ঘুম থেকে উঠার সমস্যা থাকলে এশার নামাজের পর এবং বিতরের আগে দুই রাকাত সুন্নত নামাজ পড়ে নেওয়া জায়েজ আছে। মূলত তাহাজ্জুদের মূল সময় রাত ২টা থেকে শুরু হয়ে সুবহ সাদিক তথা ফজরের আযানের আগ পর্যন্ত থাকে। এ সময়ে তাহাজ্জুদ আদায় করা সর্বোত্তম।

কুরআনে রাতের শেষ অংশে তাহাজ্জুদ পড়াকে উত্তম বলে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা রাসূল (স.) কখনো মধ্যরাতে, কখনো তার কিছু আগে অথবা পরে ঘুম থেকে উঠতেন এবং আসমানের দিকে তাকিয়ে সূরা আলে-ইমরানের শেষ রুকুর কয়েক আয়াত পড়ার পর মেসওয়াক ও ওযু করে নামজ আদায় করতেন।

তাহাজ্জুদে সূরা-কেরাত দীর্ঘ করা উত্তম

তাহাজ্জুদ নামাজ‌ পড়ার কোন ধরাবাঁধা নিয়ম নেই। কেননা এ নামাজ একটি নফল ইবাদত। যা অন্য নামাজের মতোই দুই রাকাত দুই রাকাত করে পড়া যায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাহাজ্জুদ নামাজ পড়ার ক্ষেত্রে তাই করতেন। তিনি কখন ২ রাকাত, কখনো ৪ রাকাত, কিংবা কখনো ৮ রাকাত ও ১২ রাকাত এ নামাজ আদায় করতেন। কিন্তু কেউ যদি এ নামাজ ২ রাকাত আদায় করেন, তাহলেও তার তাহাজ্জুদ আদায় হবে। কেউ ১২ রাকাত আদায় করলে, তাও আদায় হয়ে যাবে।

বিভিন্ন বর্ণনা মতে, এ নামাজ ২ রাকাত থেকে ২০ রাকাত পর্যন্ত পড়া যায়। হজরত ইবনে আব্বাস (রা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি এশার পর দুই বা ততোধিক রাকাত নামাজ পড়ে নেয়, সে হবে তাহাজ্জুদের ফজিলতের অধিকারী।’

যে কোনো সুরা দিয়েই এ নামাজ পড়া যায়। তবে রাসূল (স.) যথাসম্ভব বড় সূরা তিলাওয়াত করতেন। এমনকি রুকু ও সেজদাও দীর্ঘ করে একান্ত নিবিষ্ট মনে তাহাজ্জুদ নামাজ আদায় করতেন। তাই লম্বা কেরাতে তাহাজ্জুদ আদায় করা উত্তম। কেরাত উঁচু বা নিচু উভয় আওয়াজে পড়া জায়েজ আছে। তবে কারও কষ্টের কারণ হলে চুপিচুপি পড়া কর্তব্য।

আরো পড়ুন: ইসলামে তওবার বিধান এবং এর দরজা কখন বন্ধ হবে?

তাহাজ্জুদে রাসূল (স.) এর দোয়া

বোখারি, মুসলিম ও মেশকাত শরীফের হাদিসে উল্লেখ রয়েছে, গভীর রাতে তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তে উঠে প্রিয় নবী হযরত মোহাম্মদ (সা.) সুরা আল-ইমরানের শেষ পর্যন্ত পড়তেন। তিনি মহান প্রভুর দরবারে বিনীত চিত্তে ফরিয়াদ করে বলতেন, ‘হে আমাদের প্রতিপালক! এসব তুমি অনর্থক সৃষ্টি করনি। পবিত্রতা তোমারই জন্য। আমাদেরকে তুমি জাহান্নামের শাস্তি থেকে বাঁচাও।’

রাসূল (স.) বলতেন, ‘হে প্রতিপালক! নিশ্চয়ই তুমি যাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ কর, তাকে অপমানিত কর। আর যালিমদের জন্য কোন সাহায্যকারী নেই। হে আমাদের প্রভু! আমরা ঈমান আনার জন্য একজন আহ্বানকারীকে আহ্বান করতে শুনে ঈমান এনেছি।’

তিনি প্রার্থনা করতেন, ‘হে আমাদের পালনকর্তা! তুমি আমাদের সকল গোনাহ মাফ করে দাও। আমাদের সকল দোষ-ত্রুটি দূর করে দাও। আর নেক লোকদের সঙ্গে আমাদের মৃত্যু দাও।’

পাপ মুক্তিতে তাহাজ্জুদ নামাজ

পাপের কুলশতা মুক্ত হতে তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব ও ফযীলত অপরিসীম। সকল পাপ মুক্তির জন্য গভীর রাতে পরম দয়ালু অসীম করুণাময় আল্লাহর নিকট সিজদায় অবনত হয়ে গভীর অনুশোচনায় তওবা করে ফরিয়াদ করলে, আল্লাহ বান্দার সকল পাপ মুছে দেন। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে ক্ষমা করে রহমতের হাত বাড়িয়ে দেন। তারাই আল্লাহ কাছে প্রিয় বান্দা।

সূরা আল ফুরকান-এর ৬৪ নম্বর আয়াতে আল্লাহ ঘোষণা করেন, ‘আল্লাহর প্রিয় বান্দা তারা, যারা তাদের রবের দরবারে সিজদা করে এবং দাঁড়িয়ে থেকেই রাত কাটিয়ে দেয়।’

আবু দাউদ, নাসায়ী ও মেশকাত (১০৯ পৃঃ) শরীফের হাদিসে তাহাজ্জুদ আদায়কারীর উপর আল্লাহর রহমাত বর্ষণের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ মর্মে রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি রাত্রে ঘুম থেকে জেগে তাহাজ্জুদের নামায পড়ে এবং সে তার স্ত্রীকেও ঘুম থেকে জাগিয়ে নামায পড়ায় এমনকি সে যদি জেগে না উঠে, তবে তার মুখে খানিকটা পানি ছিটিয়ে দেয়, তাহলে তার প্রতি আল্লাহ রহমত বর্ষণ করে থাকেন। অনুরুপ কোন মহিলা যদি রাত্রিকালে জাগ্রত হয়ে তাহাজ্জুদ নামায পড়ে এবং সে তার স্বামীকে নামাযের জন্য জাগায়, এমনকি স্বামী না জাগলে স্ত্রী তার মুখে পানি ছিটিয়ে তার ঘুম ভাঙ্গিয়ে দেয়, তাহলে তার প্রতিও আল্লাহর রহমত বর্ষিত হতে থাকে।

আরো পড়ুন: আল্লাহ হাফেজ-এর উৎপত্তি কোথায়, কখন, কীভাবে?

ইসলামের প্রাথমিক যুগে কুফর সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে মুসলমানদের বিজিত হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা ছিল তাহাজ্জুদ নামাজ। কেননা গভীর রাতে তাঁরা আল্লাহ তায়ালার দরবারে চোখের পানি ফেলে ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে পবিত্র কোরআনে সূরা আলে ইমরানে ১৭ আয়াতে আল্লাহ বলেন, ‘তারা ছিল কঠিন পরীক্ষায় পরম ধৈর্যশীল, অটল-অবিচল, সত্যের অনুসারী, পরম অনুগত। আল্লাহর পথে ধন-সম্পদ উৎসর্গকারী এবং রাতের শেষ প্রহরে আল্লাহর কাছে ভুলত্রুটির ক্ষমাপ্রার্থী।'

সুতরাং আল্লাহ প্রিয় বান্দা হয়ে তাঁর নৈকট্য লাভ করতে তাহাজ্জুদ নামাজের গুরুত্ব অনেক বেশি। কেননা তাহাজ্জুদ বান্দাকে তাঁর রবের প্রিয় পাত্রে পরিণত করে।


সর্বশেষ সংবাদ