কোচিং না করেও বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া সম্ভব!
চলমান এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের টার্গেট করে রাজধানীসহ সারাদেশের বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষাকেন্দ্রিক কোচিং সেন্টারগুলো তাদের মহাপরিকল্পনা সাজিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে চলমান এইচএসসি পরীক্ষা শেষে শিক্ষার্থীরা কেন্দ্র থেকে বের হলেই তাদের হাতে ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে কোচিংয়ের লিফলেট। জাহির করা হচ্ছে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব। অভিভাবক, শিক্ষার্থীদের ফোন নম্বর নিয়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ে যোগাযোগের পাশাপাশি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলোতেও চলছে চটকদার সব বিজ্ঞাপন। আইন ভঙ্গ করে বিভিন্ন স্থানে টানানো হচ্ছে পোস্টার বিলবোর্ড। যাতে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কত শিক্ষার্থী এসব কোচিং করার কারণে চান্স পেয়েছে রয়েছে তার খতিয়ান। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিতে কোচিং সত্যিকার অর্থে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিকাংশ প্রশ্নই আসে উচ্চ মাধ্যমিকের বই থেকে। এছাড়া ইংরেজি, বাংলার বেসিক থেকেও বড় অংশ প্রশ্ন করা হয়। ফলে দুই এক মাসের কোচিং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় কোনো কাজে আসে না। এটা একেবারেই নিষ্প্রয়োজন। শিক্ষার্থীদের উচিত বেশি বেশি করে উচ্চ মাধ্যমিকের বই এবং বেসিক জ্ঞানের দিকে নজর দেয়া।’
আরেফিন সিদ্দিক আরো বলেন, ‘মানবিক বিভাগ থেকে সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্নকে অনেকেই মনে করে থাকে বাইরে থেকে করা হয়। কিন্তু মানবিক বিভাগের সাধারণ জ্ঞানের অর্ধেকই থাকে ঐতিহাসিক, সামাজিক বিষয়ের ওপর; যা আমাদের মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের বইয়েই রয়েছে। এর বাইরে সাম্প্রতিক কিছু বিষয় আসে। যার জন্য পত্রপত্রিকা পড়াই যথেষ্ট।’
শিক্ষা সংশ্লিষ্টরাও বলছেন, বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংগুলো চলছে এক ধরনের অসত্য তথ্যের ওপর ভর করে। কোচিংগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে এমনভাবে নিজেদের কর্মকান্ড তুলে ধরে যা থেকে একজন শিক্ষার্থী মনে করতে বাধ্য যে কোচিং করা ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু বড় ও গুরুত্বপূর্ণ অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন যেহেতু মূল বই থেকে আসে সেহেতু এসব কোচিংয়ের কোন প্রয়োজন আছে বলেও মনে করেন না তারা। একই সঙ্গে কিছু ছোট বিশ্ববিদ্যালয় যারা মূল বইয়ের বাইরে থেকে প্রশ্ন করছে তাদেরকে মূল বই থেকে প্রশ্ন করতে উৎসাহিত করার কথাও বলছেন শিক্ষা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা।
রাজধানীর ফার্মগেটের লিজেন্ড কোচিংয়ের ভর্তির দায়িত্বপ্রাপ্ত একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘আমাদের কোচিংয়ে যারাই ভর্তি হয় তারাই কোথাও না কোথাও চান্স পায়।’ কিন্তু ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন যেহেতু উচ্চ মাধ্যমিকের বই এবং বেসিক থেকে আসে সেহেতু কোচিংয়ে আলাদা কি করানো হয় এমন প্রশ্নে ওই কর্মকর্তা বলেন, ‘বই এবং বেসিকের থেকে আসলেও সেটি সহজে ও সুন্দরভাবে আমরা শিক্ষার্থীদের সামনে তুলে ধরি। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ ভালো প্রতিষ্ঠানের মেধাবীরা আমাদের এখানে ক্লাস নেয়ায় অনেক শিক্ষার্থীই নিজেদের প্রতিভা সম্পর্কেও আত্মবিশ্বাসী হয়ে ওঠে। এ কারণে কোচিংয়ে ভর্তি ছাড়া ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া কষ্টকর।’
বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী ও তাদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, অসংখ্য কোচিংয়ের এসব চটকদার প্রচারণায় তারা কোনটি সঠিক আর কোনটি ভুল তা নিয়ে দ্বিধায় পড়ে গেছেন। কিছু অভিভাবক জানিয়েছেন, সন্তানদের পরীক্ষা দিতে নিয়ে যাওয়ার পর এসব কোচিং সেন্টারের লোকজন এসে তাদের সঙ্গে যেসব কথা বলেছে, তাতে তারা এখন মনে করছেন- কোচিং না করিয়ে সন্তানদের বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি করা অসম্ভব।
যদিও একাধিক বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভর্তি পরীক্ষার অধিকাংশ প্রশ্নই আসে উচ্চ মাধ্যমিকের বই থেকে। অর্থাৎ এইচএসসি পরীক্ষায় যারা তাদের মূল বই ভালো করে পড়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষাতেও তারাই ভালো করবেন বলে দাবি তাদের। শুধু মানবিক বিভাগে বাইরে থেকে কিছু সাধারণ জ্ঞানের প্রশ্ন সংযোজন করা হয় বলেও জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ।
তথ্যমতে, রাজধানী ঢাকার ফার্মগেট, মৌচাক, যাত্রাবাড়িসহ বিভিন্ন স্থানে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিংয়ের রমরমা বাণিজ্য চলে। ফার্মগেটের কয়েকটি স্থান ঘুরে দেখা যায়, সাইফুর্স, লিজেন্ড, ইউসিসি, ইউনিএইডসহ বিভিন্ন কোচিংয়ের বিলবোর্ড ঝুলছে। মাত্র গত বছরই অবৈধ বিলবোর্ড স্থাপনের জন্য ঢাকা সিটি করপোরেশন কয়েকটি কোচিংয়ের ট্রেড লাইসেন্স বাতিল করে। এর পরও এ ধরনের বিলবোর্ড স্থাপন বন্ধ হয়নি।
ফার্মগেটের ইউসিসি কোচিংয়ের সামনে গিয়ে দেখা যায় বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনিকে অভিনন্দন জানিয়ে বিশাল বড় করে বিলবোর্ড টানানো হয়েছে এর সামনে। এর আগে বিভিন্ন সময় কোচিংটিতে গিয়ে দেখা গেছে. বিভিন্ন প্রভাবশালী মন্ত্রীর সঙ্গে কোচিং মালিকের তোলা ছবি বড় করে টানানো রয়েছে। মূলত বিভিন্ন কর্মসূচিতে গিয়ে মন্ত্রীদের সঙ্গে ছবি তুলে তা দিয়ে এ ধরনের বাণিজ্য ইউসিসি ছাড়াও অন্য একাধিক কোচিংও করে আসছে। সবে এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে আসা শিক্ষার্থী ও তাদের সহজ সরল অভিভাবকদের বস্নাকমেইল করে নিজেদের মালিক ও কোচিংয়ের প্রভাব বুঝাতেই এ ধরনের ছবি টানানো হয় বলে জানা গেছে।
এবার এইচএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে এমন একজন শিক্ষার্থী এনামুল হক নোবেল বলেন, ‘প্রতিদিনই পরীক্ষা শেষ করে বের হওয়া মাত্রই বিভিন্ন কোচিংয়ের লোকেরা হাতে একটি করে কাগজ ধরিয়ে দেয়। এসব কাগজের প্রতিটিতেই দেখি তাদের কোচিং থেকেই প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয়সহ প্রথম বিশ জনের পনেরো জনই তাদের কোচিং থেকে চান্স পেয়েছে। প্রতিটি কোচিংয়ের একই রকমের বিজ্ঞাপন দেখে অবাক হই। আমার কয়েকজন বন্ধু এরই মধ্যে কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছে। তারা জানিয়েছে কোচিংয়ে ভর্তি না হলে নাকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়া যায় না। আমি আমার পরিবারে জানিয়েছি। কিন্তু এখনো কিছু বলেনি।’