অনলাইনে যেভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল করবেন
দেশে আগে থেকেই অনলাইনে আয়কর দেওয়ার সুযোগ থাকলেও এবারই প্রথমবারের মতো কয়েকটি এলাকা ও খাতের জন্য অনলাইনে রিটার্ন জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। গত ২২ অক্টোবর এ সংক্রান্ত এক বিশেষ আদেশ জারি করে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড। এই আদেশের ফলে এখন থেকে ঢাকার দুটি এবং গাজীপুর ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের আয়কর সার্কেলগুলোর সব সরকারি কর্মচারী এবং দেশের সকল তফসিলি ব্যাংকের কর্মীদের ইলেকট্রনিক মাধ্যমেই তাদের রিটার্ন দাখিল করতে হবে। এছাড়া টেলিকম সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান ও কয়েকটি বহুজাতিক কোম্পানির কর্মীদেরও বাধ্যতামূলকভাবে আসতে হবে এই প্রক্রিয়ার অধীনে।
আয়কর যাদের জন্য প্রযোজ্য
এনবিআরের নিয়ম অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তির বার্ষিক আয় ৩ লাখ ৫০ হাজার টাকার বেশি হলে তাকে আয়কর দিতে হবে। তবে নারী ও ৬৫-ঊর্ধ্ব নাগরিকদের করমুক্ত আয়ের সীমা চার লাখ টাকা। আর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এটি পাঁচ লাখ টাকা। এছাড়াও পূর্ববর্তী কর মূল্যায়ন, শহরে বাসস্থান, গাড়ির মালিকানা, নির্দিষ্ট কিছু পেশার সদস্যপদ, ব্যবসা পরিচালনা এবং দরপত্র বা নির্বাচনে অংশগ্রহণের জন্যও আয়কর পরিশোধ করতে হয়। এটি নিবন্ধিত কোম্পানি ও এনজিওগুলোর ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
করদাতা সনাক্তকরণ নম্বর (টিআইএন) থাকলে করযোগ্য আয় থাকুক বা না থাকুক, আয়কর রিটার্ন দাখিল করতেই হবে। করযোগ্য আয় না থাকলে শূন্য রিটার্ন দাখিল করা যাবে। সেটা না করলে আইনে শাস্তি ও জরিমানার বিধান আছে।
প্রয়োজনীয় কাগজপত্র
কর দেওয়ার সময় প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ইটিআইএন, জাতীয় পরিচয় পত্রের (এনআইডি) ফটোকপি, বিস্তারিত ঠিকানা এবং আগের বছরের রিটার্নের নথি প্রয়োজন হবে। একাধিক আয়ের উৎস থাকলে তার কাগজপত্র, বিনিয়োগের বিবরণ, সম্পত্তির তথ্য এবং করমুক্ত আয়ের সার্টিফিকেট অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
যেভাবে ধাপে ধাপে অনলাইনে রিটার্ন দাখিল করবেন
টিআইএন (করদাতা শনাক্তকরণ নাম্বার) সনদধারী প্রতিটি বাংলাদেশি নাগরিকের জন্য প্রতিবছর আয়কর রিটার্ন দাখিল করা বাধ্যতামূলক। বয়স ১৮ অতিক্রম করলে টিআইএন সদন নেওয়াও বাধ্যতামূলক। কেউ যখন টিআইএন-এর জন্য আবেদন করবে,তখন কর দাখিলের জন্য একটি নির্দিষ্ট এলাকা বরাদ্দ করা হবে। প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিয়ে আয় বিবরণী জমা দিতে হবে। এরপর নিজে গিয়ে অথবা কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট আঞ্চলিক কর অফিসে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে হবে।
ই-রিটার্ন সিস্টেমে নিবন্ধন
অনলাইনে আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে চাইলে প্রথমে এনবিআরের ওয়েবসাইটে নিবন্ধন করতে হবে। নিবন্ধন করতে, ওয়েবসাইটের ই-রিটার্ন শাখায় ক্লিক করুন।
সেখানে ‘সাইন আপ’ অপশনে গিয়ে প্রথম বক্সে আপনার টিআইএন নাম্বার লিখুন। দ্বিতীয় বক্সে আপনার জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকা বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে নিবন্ধিত মোবাইল নাম্বারটি লিখুন (প্রথম শূন্য বাদ দিয়ে)। এরপর ক্যাপচা কোড দিয়ে ‘ভেরিফাই’ বাটনে ক্লিক করুন। ফোনে আসা ওটিপি ব্যবহার করে আপনার ফোন নাম্বারটি নিশ্চিত করুন। সবশেষে ই-রিটার্ন সিস্টেমে লগ ইন করতে একটি পাসওয়ার্ড ঠিক করুন।
ধাপ ১: ই-রিটার্ন সিস্টেমে প্রবেশ
একবার নিবন্ধন করা হয়ে গেলে এরপর আপনি ওয়েবসাইটে গিয়ে আপনার টিআইএন, পাসওয়ার্ড এবং ক্যাপচা দিয়ে সাইন ইন করতে পারবেন। এরপর একটি ড্যাশবোর্ড পাবেন। এর বাম দিকে থাকা ‘রিটার্ন সাবমিশন’ অপশনে ক্লিক করতে হবে।
ধাপ ২: কর যাচাইয়ের তথ্য
ই-রিটার্ন ফরমের শুরুতেই থাকবে ‘ট্যাক্স অ্যাসেসমেন্ট ইনফরমেশন’। সেখানে আয়কর সংক্রান্ত যাবতীয় তথ্য– রিটার্ন স্কিম, আয়ের সাল ও উৎস দিতে হবে। আয় যদি করমুক্ত হয়, তাহলে আয়ের পরিমাণের পাশাপাশি 'রেসিডেন্ট স্ট্যাটাস' দিতে হবে।
ধাপ ৩: আয়ের বিবরণ
এই পর্যায়ে, ‘হেডস অফ ইনকাম’-এ গিয়ে আপনার বিভিন্ন আয়ের উৎস দিন। এখানে আপনার বেতন, নিরাপত্তা সুদ, বাড়ি-সম্পত্তি থেকে আয়, কৃষি আয়, ব্যবসা থেকে আয়, মূলধন লাভ এবং অন্যান্য উৎস থেকে আয় অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন।
যদি আপনার বেতন আপনার আয়ের একমাত্র উৎস হয়, তাহলে ‘স্যালারি’ অপশনে ক্লিক করুন। এর বাইরে আয় থেকে থাকলে ‘ইনকাম ফ্রম আদার সোর্সেস’ অপশনে ক্লিক করুন। সেখানে অন্যান্য যেসব উৎস থেকে আয় করে থাকেন, তাতে ক্লিক করুন।
এরপর ‘সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউ’ অপশনে ক্লিক করে পরবর্তী ধাপে যান।
ধাপ ৪: অতিরিক্ত তথ্য
এই ধাপে একটি ড্রপডাউন মেনু থেকে আপনার প্রাথমিক আয়ের উৎসের স্থান ঠিক করবেন। সেখানে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের মতো অনেকগুলো অপশন থাকবে।
আপনি যদি যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা, প্রতিবন্ধী বা প্রতিবন্ধী ব্যক্তির আইনি অভিভাবক হয়ে থাকেন, সেটিও এখানে অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। এছাড়া, বিনিয়োগের জন্য আপনি করমুক্তির দাবিদার কি না এবং আপনি কোনো সংস্থার শেয়ারহোল্ডার পরিচালক কি না, তা 'হ্যাঁ' বা 'না'-এর মাধ্যমে উত্তর দেবেন।
ধাপ ৫: আইটি ১০বি পূরণ
যদি আপনার সম্পূর্ণ সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখ টাকা বা তারচেয়ে বেশি হয়, তাহলে আপনাকে অবশ্যই স্টেটমেন্ট ফর্মের ব্যয় বিভাগটি পূরণ করতে হবে। এজন্য 'আইটি১০বি ফর্ম' পূরণ করতে হবে। সম্পদের পরিমাণ ৪০ লাখের কম হলে তা পূরণ করতে হবে না। এক্ষেত্রে, আপনার ও আপনার পরিবারের বার্ষিক খরচের হিসেব দিতে হবে।
এরপর 'সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউ' অপশনে ক্লিক করে পরবর্তী ধাপে যান।
ধাপ ৬: আয়ের বিবরণ
অন্যান্য উৎস থেকে আসা আয়, বৈদেশিক আয় বা কর-অব্যাহতিপ্রাপ্ত আয়ের বিবরণ দিন। বেতন বা করযোগ্য বিনিয়োগ ছাড়া অন্যান্য উৎস থেকে আসা আয়ের তথ্য দিতে আপনি ড্রপডাউন মেনুতে বিভিন্ন অপশন পাবেন।
'এনি আদার ইনকাম' অপশনে ক্লিক করলে সেখানে আপনার অন্য আয়ের উৎস, অর্থ প্রদানকারী কর্তৃপক্ষ, প্রাপ্ত সর্বশেষ আয়ের তারিখ ও পরিমাণ, এবং সংশ্লিষ্ট ব্যয়ের হিসেব দিতে হবে। এসব তথ্য দেওয়ার পর আপনার নেট আয়ের হিসেব দেখানো হবে।
আবার 'সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউ' অপশনে ক্লিক করে পরবর্তী ধাপে যান।
ধাপ ৭: বিনিয়োগ বিভাগ
আপনি যদি বর্তমানে জীবন বীমা প্রিমিয়াম, ডিপোজিট প্রিমিয়াম সার্ভিস (ডিপিএস), অনুমোদিত সঞ্চয়পত্র, সাধারণ প্রভিডেন্ট ফান্ড, বেনেভোলেন্ট ফান্ড, গ্রুপ বীমা প্রিমিয়াম, অনুমোদিত স্টক বা শেয়ার, কিংবা অন্যান্য ক্যাটাগরিতে বিনিয়োগ করে থাকেন, সেগুলো এখানে উল্লেখ করবেন।
ধরুন আপনি যদি 'ডিপিএস' অপশনে ক্লিক করেন, তাহলে সেখানে ব্যাংকের নাম, অ্যাকাউন্ট নাম্বার এবং জমাকৃত অর্থের পরিমাণ দিতে হবে। এভাবে অন্যান্য অপশনে গেলেও আপনাকে বিস্তারিত তথ্য দিতে হবে।
আবার 'সেভ অ্যান্ড কন্টিনিউ' অপশনে ক্লিক করে পরবর্তী ধাপে যান।
ধাপ ৮: ব্যয়
এই বিভাগে, মোট আয়ের বিপরীতে আপনার মোট ব্যয় পর্যালোচনা করতে পারবেন। এখানে বিভিন্ন খাতে ব্যয়ের বিভাগ থাকবে। খাদ্য, পোশাক, বাসস্থান (পরিবহন, গৃহস্থালি, ইউটিলিটিসহ), বাচ্চাদের শিক্ষা এবং অন্য কোনো ব্যয়ের খাত থাকলে তা অন্তর্ভুক্ত করতে পারবেন। এই বিবরণগুলো পূরণ করলে আপনার বকেয়া করের হিসেব দেওয়া হবে।
ধাপ ৯: কর এবং পেমেন্ট
এখানে আপনি ইতোমধ্যে কোনো উৎস কর এবং অগ্রিম কর প্রদান করে থাকলে তার হিসেব দিতে পারবেন। এই হিসেব দেওয়ার পর আপনার মোট প্রদেয় করের পরিমাণ স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমে যাবে। আপনার আয়ের উপর কোনো কর বকেয়া না থাকলে আপনার প্রদেয় করের পরিমাণ হবে শূন্য। একে 'শূন্য রিটার্ন' বলা হয়।
ধাপ ১০: রিটার্ন ভিউ
'অনলাইন রিটার্ন' অপশনে ক্লিক করলে আপনি রিটার্ন ফর্মটি দেখতে পাবেন। তার নিচে 'ইয়েস' অপশনে ক্লিক করলেই আপনার রিটার্ন চলে যাবে। কোনো তথ্য নিয়ে সন্দেহ থাকলে আপনি 'নো' অপশনে ক্লিক করতে পারেন এবং আবার সব তথ্য দেখে নিতে পারেন।
ধাপ ১১: রসিদ ডাউনলোড করুন
আয়কর রিটার্ন সফলভাবে জমা হয়, তাহলে আপনাকে অভিনন্দন জানিয়ে একটি বার্তা লেখা দেখবেন। সেখানে আপনি একটি রেফারেন্স আইডি ডাউনলোড করার অপশন পাবেন। সেটি ডাউনলোড করে অনলাইনেই আপনি আয়কর রিটার্ন দাখিল করতে পারেন। অথবা সেটি প্রিন্ট করে আয়কর অফিসে পাঠাতে পারেন।
এই প্রক্রিয়াটি জটিল মনে হলে এখান থেকে ডান পাশে নিড হেল্প অপশনে চাপ দিন। এছাড়া বিডিটেক্স এবং শাপলা ট্যাক্সের মতো অনেক অনলাইন প্লাটফর্ম ও অ্যাপ্লিকেশন আছে, যেগুলো আপনাকে আয়কর রিটার্ন দাখিলে সাহায্য করবে।