যেভাবে প্রস্তুতি নিয়ে টানা চার বিসিএসের প্রিলি পাস করেছি
৪৬তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি পরীক্ষার আসন বিন্যাস ও পরীক্ষা পরিচালনার নির্দেশনা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)। মঙ্গলবার (২৩ এপ্রিল) পিএসসির ওয়েবসাইটে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হয়। আগামী শুক্রবার ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, সিলেট, রংপুর ও ময়মনসিংহ কেন্দ্রে সকাল ১০টা থেকে ১২টা পর্যন্ত একযোগে এই পরীক্ষা হবে।
এ পরীক্ষায় কীভাবে ভালো প্রস্তুতি নেওয়ায় যায়— সে সম্পর্কে জানিয়েছেন টানা চার বিসিএসের প্রিলি পাস করা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মো. আরিফ হোসাঈন। সর্বশেষ তিনি ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডার সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন। প্রশাসন ক্যাডারে আরিফের অবস্থান ছিল ৪র্থ। তিনি নিজে কীভাবে প্রস্তুতি নিয়ে টানা চার বিসিএসের প্রিলি পাস করেছেন, জানিয়েছেন সে অভিজ্ঞতার কথা। অন্যরাও কীভাবে ভালো করতে পারেন, দিয়েছেন সে পরামর্শও।
আমি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ২য় বর্ষের শেষের থেকে বিসিএসের প্রিলি প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। যেহেতু একটু আগেভাগেই শুরু করেছিলাম সেহেতু আমি পর্যায়ক্রমে একটি একটি করে বিষয় পড়ে শেষ করার কৌশল অবলম্বন করেছি।
চতুর্থ বর্ষের ইয়ার ফাইনাল পরীক্ষা দেওয়ার আগেই পুরো প্রিলি সিলেবাস দুইবার শেষ করতে পেরেছিলাম। হলের সিনিয়র ক্যাডার বড় ভাইদের পরামর্শক্রমে প্রথমেই আমি বিসিএস প্রিলি পরীক্ষার সিলেবাসটি সংগ্রহ করি এবং তাদের দেওয়া বুকলিস্ট ফলো করে পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন বিষয়ের বই কিনতে থাকি এবং পড়তে থাকি।
প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়ে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলে উঠেছিলাম তখন তথাকথিত কিছু সিনিয়রদের মুখে শুনেছিলাম বিসিএস ক্যাডার হওয়ার জন্য এক্সিলেন্ট অ্যাকাডেমিক ফলাফলের দরকার নেই। কিন্তু কালক্রমে বুঝতে পারলাম শক্ত অ্যাকাডেমিক ভিত্তি ছাড়া ভালো সিভিল সার্ভিস অফিসার হওয়া কঠিন।
তাই অ্যাকাডেমিক পড়াশোনা ও বিসিএস প্রস্তুতি একইসঙ্গে সমন্বয় করে করতে থাকলাম। যদিও উভয় দিকে ভালো করার জন্য আমাকে অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তথাপি দিনশেষে এটা একটা আত্মতৃপ্তির জায়গাও বটে।
দ্বিতীয় বর্ষ থেকে মাস্টার্স (থিসিস গ্রুপ) পর্যন্ত আমি চেষ্টা করেছি, আমার দিনের ২৪ ঘণ্টা অত্যন্ত ফলপ্রসূ উপায়ে ব্যয় করার। প্রতিদিন সকালে ক্লাসে যাওয়ার আগে চেষ্টা করতাম ইংরেজি পত্রিকা ও ভোকাবুলারির বই পড়তে। ডিপার্টমেন্টে যখন ক্লাস হতো না বা দুই ক্লাসের মাঝে গ্যাপ থাকতো তখন চেষ্টা করতাম আড্ডা দিয়ে সময় নষ্ট না করে ক্লাসরুমে বসে বিসিএসের বই পড়ার।
এমনকি যে ক্লাসগুলো ভালো লাগতো না সেসব ক্লাসে ক্লাস চলাকালীন লুকিয়ে লুকিয়ে বিসিএস প্রিলির বই পড়েছি।যেদিন ক্লাস থাকত না বা দুই ক্লাসের মাঝে বড় গ্যাপ থাকতো তখন হলে চলে আসতাম এবং সারা দুপুর বেলা শুয়ে শুয়ে বিভিন্ন রেফারেন্স বই, উপন্যাস, কবিতার বই প্রভৃতি পড়েছি।
পকেট খরচ চালানোর জন্য ২য় বর্ষ থেকেই নিয়মিতভাবে অনেক টিউশন করিয়েছি। টিউশনের পড়াকে নিজের পড়া মনে করে পড়তাম, কখনোই ফাঁকি দিতাম না। চেষ্টা করতাম এমন বিষয় পড়াতে যা আমার বিসিএস প্রস্তুতিতে সহায়ক হবে। যেমন: নবম- দশম, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণীর ম্যাথ, পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও আইসিটি।
বিসিএস প্রিলির ম্যাথ, আইসিটি ও বিজ্ঞানে আমার প্রস্তুতি শক্ত হয়েছিল বেশি বেশি টিউশন করানোর কারণে। হলের বন্ধুদের সাথে ও রুমমেটদের সাথে বিসিএস রিলেটেড বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতাম, যেমন- কে কোন বইটা পড়ল, কার কতটুকু পড়া শেষ, নেক্সট কী পড়বে এইসব।
ভেতরে ভেতরে সব সময়ই চেষ্টা করতাম অন্য সবার থেকে এগিয়ে থাকতে এবং এই প্রতিযোগিতামূলক মনোভাবই আমাকে অনেকখানি এগিয়ে দিয়েছে। সাধারণ জ্ঞান নিয়ে আমার ভীতি ছিল সবচেয়ে বেশি। কারণ আমি বিজ্ঞানের ছাত্র ছিলাম। তবে নিয়মিত বিভিন্ন রেফারেন্স বই, বোর্ড বই ও দৈনিক পত্রিকা পড়ার কারণে ধীরে ধীরে সাধারণ জ্ঞানের ভিত্তি গড়ে উঠেছিলো।
এছাড়াও ঘুরতে যাওয়ার পরিকল্পনা এমনভাবে করতাম যাতে করে বিভিন্ন ঐতিহাসিক স্থান, জাদুঘর দর্শনের মাধ্যমে ইতিহাস ভালোভাবে জানতে পারা যায়। ভূগোল ও পরিবেশ বিভাগের ছাত্র হওয়ার কারণে বিসিএস প্রিলির ভূগোল, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমার তেমন পড়াশোনা করতে হয়নি।
বাংলা ও ইংরেজি ব্যাকরণের ভিত্তি স্কুল ও কলেজ জীবন থেকেই আমার ভালো ছিল। তাই প্রথমেই বাংলা সাহিত্য ও ইংরেজি সাহিত্যের প্রস্তুতির ওপর সবচাইতে বেশি জোর দিয়েছিলাম। বিভিন্ন গাইড বই, রেফারেন্স বই পড়ার পাশাপাশি বিখ্যাত উপন্যাস, কাব্যগ্রন্থ/সাহিত্যকর্মগুলো হল লাইব্রেরি বা অন্যান্য উৎস থেকে সংগ্রহ করে নিয়মিত পড়তাম। যেগুলো প্রিলিতে ব্যাপক কাজে লেগেছে।
এছাড়াও যে সমস্ত বিষয় বুঝতে সমস্যা হতো ইউটিউবে বিসিএস সিলেবাস কেন্দ্রিক বিভিন্ন লেসনের মাধ্যমে সমাধান পেয়েছিলাম। আমি মুখস্থ বিদ্যার পরিবর্তে প্রচুর দেখা ও শোনার মাধ্যমে জ্ঞান অর্জনে আগ্রহী ছিলাম। তাই ইউটিউব ও পত্রিকাকে সর্বোত্তম রূপে ব্যবহার করার চেষ্টা করেছি। সবারই পড়ার ধরণ ও জীবনাচরণ যেহেতু একই নয় সেহেতু বিসিএস প্রস্তুতির গল্প সবারই ভিন্ন হবে। আমার বিসিএস প্রিলি প্রস্তুতি ছিল এক ধরনের সর্বাত্মক ও দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া।
নতুনদের উচিত প্রথমেই পিএসসির ওয়েবসাইট থেকে প্রিলি সিলেবাস ডাউনলোড করে সেটা পর্যবেক্ষণ করা এবং নিজের স্ট্রাটেজি ঠিক করা। বিগত বছরের প্রশ্নের ধারা দেখেই আপনাকে অনুমান করতে হবে জ্ঞানের কোন স্তর পর্যন্ত আপনার জানতে হবে এবং ধীরে ধীরে সেই স্তরে পৌঁছাতে হবে।
যে বিষয়ে আপনার জ্ঞানের ঘাটতি আছে সেটা দিয়েই প্রথমে প্রস্তুতি শুরু করা উচিত। এক্ষেত্রে একটা বিষয় মাথায় রাখতে হবে, সর্বোত্তম সময় ব্যবস্থাপনাও একটা ব্যাপার। কোন বিষয়ে আপনি কত সময় দেবেন এটা আপনাকে আগেই ঠিক করতে হবে এবং চেষ্টা করবেন সেই টাইমলাইনে মধ্যেই নির্দিষ্ট বিষয় বা টপিক একবার হলেও পড়ে শেষ করা।
আবার সব বিষয়ে যদি একসাথে পড়া শুরু করেন, তাহলে দেখা যাবে আপনি সবই পড়ে শেষ করেছেন ঠিকই কিন্তু কিছুই মনে রাখতে পারছেন না বা পরীক্ষায় ভুল দাগাচ্ছেন। সুতরাং, যেকোনো একটি বা দুইটি বিষয়ে নিরবচ্ছিন্ন পড়াশোনা করে তাতে গভীর জ্ঞান অর্জন করার পরই নতুন বিষয়ে সুইচ করবেন।
সর্বোত্তম প্রস্তুতির ক্ষেত্রে ভালো পাঠ্যপুস্তক নির্ধারণ করাও একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। সিনিয়র ক্যাডার ভাইয়া-আপুদের কাছ থেকে বুকলিস্ট সংগ্রহ করে অ্যাকাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি ধীরে ধীরে পড়া শুরু করা উচিত। তবে একই বিষয়ে বারবার বই পরিবর্তন করবেন না। দরকার হলে অন্য বইয়ের অতিরিক্ত তথ্য স্টিকি নোট ব্যবহার করে মূল বইয়ের সম্পর্কিত টপিকের সাথে যুক্ত করে রাখুন।
এছাড়াও পড়াশোনার পাশাপাশি যা পড়ছি তা বাস্তব জীবনেও যথার্থ উপলব্ধি জরুরি। এক্ষেত্রে সমমনা বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে ছোট গ্রুপ করে আলোচনা করলে প্রস্তুতি বেশি ফলপ্রসূ হবে। দরকার হলে নিজেরাই নিজেদের পরীক্ষা নিন।
বিসিএসে প্রিলিতে ২০০ নম্বরের প্রিলি পরীক্ষায় যেসব বিষয় পড়তে হয়— বাংলা ভাষা ও সাহিত্য; ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য; গণিত; মানসিক দক্ষতা; সাধারণ জ্ঞান (বাংলাদেশ বিষয়াবলি); সাধারণ জ্ঞান (আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি); নৈতিকতা, মূল্যবোধ ও সুশাসন; তথ্য ও প্রযুক্তি; সাধারণ বিজ্ঞান; ভূগোল, পরিবেশ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা।
বিসিএস প্রিলির জন্য কোচিং খুব একটা জরুরি নয়। একজন স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী হিসেবে কেউ যদি বাসায় বসে নিয়মিত পড়াশোনা করেন, তাহলে অনায়াসেই ভালো প্রস্তুতি সম্ভব। প্রস্তুতিতে ভালো সময় ও শ্রম দিতে হবে, এইটাই হলো মূল কথা। তবে কেউ যদি একা একা পড়তে না পারেন তাহলে কোচিংয়ের সবার সঙ্গে ভালো পড়াশোনা হবে বলে আমি আশা করি। এছাড়াও কোচিংয়ে পরীক্ষা দেওয়ার মাধ্যমে নিজের প্রস্তুতিকে যাচাই করার একটা সুযোগ পাওয়া যায়।