মৎস্যবিজ্ঞানে পড়ব কেন?
নদীমাতৃক দেশ বাংলাদেশ। নদীকে কেন্দ্র করে দেশের মানুষের একাংশ জীবিকা নির্বাহ করে। স্বাদু পানির মাছ উৎপাদনে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান এখন তৃতীয়। মাছ উৎপাদনে বিশ্বের দরবারে তৃতীয় অবস্থানে পৌঁছাতে ভূমিকা রেখেছেন দেশের মৎস্যবিজ্ঞান বিভাগের গবেষক ও দক্ষ জনবল।
নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য সময়োপযোগী গবেষণা, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে প্রয়োজন মৎস্য বিজ্ঞানে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনবলের। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, দাতা বা উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা, ব্যাংক বা অর্থলগ্নীকারী প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে ওঠা শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহেও রয়েছে ফিশারীজ সংশ্লিষ্ট কাজের সুযোগ। এছাড়াও মৎস্য সম্পদ আহরণ ও উৎপাদন ক্ষেত্র, বিভিন্ন মৎস্য ও মৎস্য-জাত দ্রব্য উৎপাদন ও রপ্তানি প্রতিষ্ঠান, মৎস্য চাষ ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণে ব্যবহৃত নানাবিধ উপকরণ উৎপাদন সংশ্লিষ্ট শিল্পকারখানার বিস্তৃতির ফলে মৎস্য খাতে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থানের যা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সরকারি সংস্থাসমূহ-
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা/অফিস সমূহে ফিশারীজ গ্রাজুয়েটদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদ গবেষণা কেন্দ্র (বিএফআরআই) ও এর শাখা ও উপকেন্দ্রসমূহ, বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র (বিএফডিসি) ও এর শাখা কেন্দ্রসমূহ, বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (বিএআরসি বা বার্ক), ফিশারীজ ও ফিশারীজ সংশ্লিষ্ট একাডেমী ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
এছাড়াও মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়কে সহায়তাকারী বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা/দপ্তরসমূহে ফিশারীজ গ্রাজুয়েটদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়, যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় সেচ, পানি উন্নয়ন ও বন্যা মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, শিল্প মন্ত্রণালয়, অর্থ মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, শিপিং মন্ত্রণালয় প্রভৃতি
বেসরকারি সংস্থাসমূহ-
দেশের বিভিন্ন এনজিও এর নানা ধরণের আত্মনির্ভরশীল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম একটি খাত হচ্ছে ফিশারীজ। বিভিন্ন মাছের একক ও মিশ্র চাষ, নার্সারি ব্যবস্থাপনা, বাওরে মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন ইত্যাদি। এই সকল খাতে ফিশারীজ গ্রাজুয়েটের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশ রুরাল এ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি (ব্রাক), প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র, গ্রামীণ ব্যাংক, আরডিআরএস, বাঁচতে শেখা, টিএমএসএস ও এসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট (আশা)।
আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ-
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও ফিশারীজ বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে যেখানে ফিশারীজ গ্রাজুয়েটের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন- ওয়ার্ল্ড ফিস সেন্টার, ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি), ফাও (এফএও), ইউএনডিপি, কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ, কারিতাস বাংলাদেশ, নেচার, কনজারভেসন মুভমেন্ট, এশিয়ান ওয়েটল্যান্ড ব্যুরো, ডানিডা (ডিএএনআইডিএ), সোসাইটি ফর কনসারভেসন অব নেচার অ্যান্ড এনভায়রনমেন্ট (এসসিওএনই), ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেসন অব নেচার অ্যান্ড ন্যাচারাল রিসোর্স (আইইউসিএন), সাউথ এশিয়া পার্টনারশিপ বাংলাদেশ (এসএপি)।
ব্যক্তিগত খাতসমূহ-
ব্যক্তি পর্যায়ে গড়ে ওঠা নিম্নে প্রদত্ত শিল্পসমূহে যোগদান করা যেতে পারে- মৎস্য খামার, মৎস্য হ্যাচারি, মৎস্য খাদ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানি ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসমূহ
প্রকল্প ও প্রোগ্রামসমূহ-
স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রোগ্রামে ফিশারীজ গ্রাজুয়েটদের অংশ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। যেমন- সরকারী অর্থায়নে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রোগ্রামসমূহ, আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের (ডিএফআইডি, ইউএস এইড, ডানিডা ইত্যাদি) উদ্যোগে বাস্তবায়িত প্রকল্প ও প্রোগ্রামসমূহ।
ব্যাংকে চাকরির সুযোগ-
বিভিন্ন ব্যাংকের ফিশারীজ বিষয়ক ঋণপ্রদানের সেকশনে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন- বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক, সোনালী ব্যাংক, অগ্রণী ব্যাংক, রূপালী ব্যাংক, জনতা ব্যাংক, সমবায় ব্যাংক, কর্মসংস্থান ব্যাংক।
আত্মকর্মসংস্থানের সুযোগ-
দেশে বি.এস.সি. ফিশারীজ (অনার্স) ডিগ্রী অর্জনের পর একজন ফিশারীজ গ্রাজুয়েট নিজেই তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন। অর্থ যোগানোর জন্য দেশের বিভিন্ন ব্যাংকসমূহে ঋণের সুযোগও রয়েছে। প্রথমে স্বল্প পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর সে প্রচেষ্টাকে বৃহৎ পরিসরে বর্ধিত করে নিশ্চিতভাবেই অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও ফিশারীজ গ্রাজুয়েটের পক্ষে সম্ভব।
হ্যাচারি ও রেণু উৎপাদন, পোনা ও টেবিল-সাইজ মৎস্য উৎপাদন, মুক্তা উৎপাদন, কাঁকড়া উৎপাদন, রঙিন মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন, মৎস্য খাদ্য উৎপাদন, মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ, মৎস্য সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম (যেমন- জাল) উৎপাদন, চাষকৃত পুকুর/দিঘীতে মৎস্য শিকার প্রতিযোগিতা আয়োজন, মৎস্য পর্যটন (ফিশারীজ হটস্পট যেমন- সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, হাকালুকি হাওর, চলন বিল, মেঘনার ইলিশ অভয়াশ্রম ইত্যাদি স্থানে ফিশারীজকে গুরুত্ব দিয়ে পরিদর্শনের আয়োজন। আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোর্স অনুযায়ী শিক্ষা সফরের আয়োজন) মৎস্য রোগ প্রবণ এলাকায় মৎস্য ক্লিনিক স্থাপন ও অনলাইন মৎস্য তথ্য কেন্দ্র পরিচালনা প্রভৃতি।
বিদেশে উচ্চ শিক্ষা ও কর্মসংস্থান-
দেশের বাইরেও মৎস্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একজন ফিশারীজ গ্রাজুয়েট যোগ দিতে পারেন। ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিসহ উচ্চশিক্ষা (যেমন- এম.এস., এম.ফিল., পি-এইচ.ডি., ডি.এস-সি. ইত্যাদি) গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত গল্ফ ও আফ্রিকা অঞ্চলের দেশসমূহে মৎস্য চাষ ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে মৎস্য পেশাজীবীর চাহিদা রয়েছে। বিভিন্ন দেশে মৎস্য ও মৎস্য-জাত দ্রব্য আমদানি-রপ্তানি প্রতিষ্ঠানে যেমন কাজের সুযোগ রয়েছে তেমনি ক্ষুদ্র পরিসরে এজাতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মাধ্যমে আত্মকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা সম্ভব।
লেখক: শিক্ষার্থী, ফিশারীজ অ্যান্ড মেরিন বায়োসায়েন্স বিভাগ, যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়