ক্যারিয়ারের জন্য অপরাধ বিষয়ে পড়াশোনার এডভেঞ্চার অন্যরকম

  © টিডিসি ফটো

পড়াশোনা যদি হয় অপরাধ বিষয়ে তবে এডভেঞ্চার যেন কয়েকগুণ বেড়ে যায়। সাইবার ক্রাইম, টেরোরিজম, মার্ডারের মতো ক্রাইম যেমন ভয়াবহ তেমনই চ্যালেঞ্জিং। দেশের প্রেক্ষাপটে উচ্চশিক্ষায় লেখাপড়ার বিষয় যখন অপরাধ তখন কৌতূহলী হওয়া স্বাভাবিক। ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স এমন একটি ডিপার্টমেন্ট যা বাংলাদেশের মাত্র ৩টি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা, সামাজিক ও আইন অনুষদের এই বিভাগ ক্রিমিনোলজি নামে বিএসএস ডিগ্রি দিলেও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স (সিপিএস) নামে বিএসসি ডিগ্রি দেয়।

অবাক করা বিষয় হলো, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম ক্রাইম সেক্টরের একাডেমিক ডিপার্টমেন্ট। ২০০৩ সালে মাভাবিপ্রবির সাবেক ও প্রথম উপাচার্য ড. ইউসুফ শরীফ আহমেদ এই ডিপার্টমেন্ট প্রতিষ্ঠা করেন।

স্কুল-কলেজ জীবনের পড়াশোনা গতানুগতিক মনে হলেও বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সিলেবাস রীতিমতো এডভেঞ্চারে ভরপুর। যেমন- সাইবার ক্রাইম, ক্রাইম ম্যাপিং, ইনভেস্টিগেশন, ফরেনসিক সায়েন্স, মেডিকেল জুরিসপ্রুডেন্স, ক্রিমিনোলজিকাল রিসার্চ, ক্রিমিনাল সাইকোলজি, পুলিশ স্টাডিজ, পেনোলজি, বায়োকেমিস্ট্রি, মনোগ্রাফ, পুলিশ ব্যবস্থাপনা, ফৌজদারি কার্যবিধি ও আইনের মতো চ্যালেঞ্জিং অনেক বিষয়ে পড়াশোনার পাশাপাশি গবেষণার সুযোগ রয়েছে। সম্প্রতি স্বাস্থ্যখাতে গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখায় ডিপার্টমেন্টটির সহযোগী অধ্যাপক নুরজাহান খাতুন এওয়ার্ড পেয়েছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঝে সমঝোতা স্মারক রয়েছে যার মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় দুটি যৌথভাবে সেমিনার-ওয়ার্কশপের মতো বিভিন্ন প্রোগ্রাম আয়োজন করে থাকে। মাভাবিপ্রবির ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের সাবেক শিক্ষার্থীদের অনেকেই বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স ডিপার্টমেন্টে শিক্ষকতা করছেন।অপরাধ বিষয়ে বিশেষায়িত এই ডিপার্টমেন্ট মাভাবিপ্রবিতে প্রথম প্রতিষ্ঠার প্রায় এক দশক পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রম শুরু করে। এছাড়া ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ডিপার্টমেন্ট চালু রয়েছে।

ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের ফিল্ডট্রিপ সাধারণত বাংলাদেশ পুলিশের ক্রিমিনাল ইনভেস্টিগেশন ডিপার্টমেন্ট (সিআইডি),ঢাকাস্থ ফরেনসিক ল্যাব, সারদা পুলিশ একাডেমি,চট্টগ্রাম কোস্ট গার্ড, শিশু উন্নয়ন সংস্থা, ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার, বাংলাদেশ প্রিজন,পুলিশ স্টাফ কলেজসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থায় হয়ে থাকে। বই-কলমের গতানুগতিক পড়াশোনার বাইরে ফিল্ডট্রিপগুলো শিক্ষার্থী হিসেবে হাতে কলমে শেখার সুযোগ তৈরি করে দেয়। ডিপার্টমেন্টটি দীর্ঘ যাত্রা পাড়ি দিলেও দেশের অনেক শিক্ষার্থীর কাছেই একেবারে নতুন। পেশাগত জীবনে প্রবেশের আগে অপরাধ ও নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলোতে দক্ষতা অর্জন করতে হয় এই বিভাগের শিক্ষার্থীদের।

বাংলাদেশের অপরাধ জগতের ভয়াবহতা অনুধাবন করে চাকরির বাজারের জন্য ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের প্রস্তুত করা হয়। কানাডা,আমেরিকা ও ইউরোপের দেশগুলোতে এই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের ব্যাপক চাহিদার পাশাপাশি বাংলাদেশ পুলিশের সাথে একচ্ছত্রভাবে কাজ করে এই ডিপার্টমেন্ট। বাংলাদেশ সোসাইটি অব ক্রিমিনোলজি এন্ড ভিক্টিমোলজি (বিএসসিভি) এবং সাউথ এশিয়ান সোসাইটি অব ক্রিমিনোলজি এন্ড ভিক্টিমোলজি (এসএএসসিভি) এর সদস্য মাভাবিপ্রবির ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট। নতুন ডিপার্টমেন্ট হিসেবে দেশি-বিদেশি গবেষণা সংস্থা ও ইনস্টিটিউটে ইন্টার্নশিপ করার সুযোগ পাচ্ছে এখানকার শিক্ষার্থীরা। আইসিডিডিআরবিসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থায় বিশেষ ভূমিকা রাখতে পারা এই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের জন্য সুন্দর ক্যারিয়ারের দ্বার উন্মোচন করে দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির আগে অনেক শিক্ষার্থীর স্বপ্ন থাকে ডাক্তার কিংবা ইঞ্জিনিয়ারের মতো সম্মানীয় অনেক পেশায় ক্যারিয়ার করার।কিন্তু এইচএসসির পর থেকে আমি একরকম ঠিক করে নিয়েছিলাম ক্রাইম সেক্টরে ক্যারিয়ার গড়ার। কারণ দেশ ও দেশের বাইরে অপরাধ মাথাচাড়া দিয়ে ওঠার আগে তা নিয়ন্ত্রণে রাখা জরুরি।আমাদের সুন্দর ভবিষ্যতের জন্য আজকের তরূণ প্রজন্মের দায়িত্ব চ্যালেঞ্জিং এরকম সেক্টরে এগিয়ে আসা। ক্যারিয়ার হিসেবে ক্রিমিনোলজি ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করা অনেক মজার এবং প্রতিনিয়ত নতুন কিছু শেখা যায়।সমাজে অপরাধ রুখে দিতে প্রাতিষ্ঠানিক ও গঠনমূলক পদ্ধতিতে আমাদের অনেক ক্লাস দেশের নামিদামি বিচারক, আইন প্রণেতা ও পুলিশের উর্ধতন কর্মকর্তারা নিয়ে থাকেন। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনেই পেশাগত ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করা মানুষদের সান্নিধ্য পাওয়া শিক্ষার্থীদের জন্য সৌভাগ্যের। এছাড়া আমাদের ফ্যাকাল্টি ও সম্মানিত অধ্যাপকবৃন্দ দেশ ও বিদেশে গবেষণার পাশাপাশি ক্রাইম সেক্টরে অসামান্য অবদান রাখছেন। সম্প্রতি মাভাবিপ্রবি ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স ডিপার্টমেন্টের সহযোগী অধ্যাপক ইশতিয়াক আহমেদ তালুকদার তুরস্ক জাতীয় পুলিশ একাডেমিতে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন।

ইন্টাররিজিওনাল ক্রাইম এন্ড জাস্টিস রিসার্চ ইউনিট নামে জাতিসংঘের স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান থাকায় আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে জায়গা করে নিয়েছে এই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা।এছাড়া ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস অব ড্রাগ এন্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি), ইন্টারপোল, ইউনিসেফ, ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন, ইন্টারন্যাশনাল মাইগ্রেশন অর্গানাইজেশন, ট্রান্সপেরেন্সি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠনে সিকিউরিটি এক্সপার্ট হওয়ার সুযোগ রয়েছে এই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের।বাংলাদেশের জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এর পাশাপাশি আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থায় অদূর ভবিষ্যতে এই ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীরা মেধার স্বাক্ষর রাখবে তা বলাই বাহুল্য। ক্রাইম সম্পর্কিত এই ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স ডিপার্টমেন্ট মূলত ইউরোপের আধুনিক দেশগুলোর অপরাধ নির্মূলের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত করা হয়।দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে বাংলাদেশের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ডিপার্টমেন্ট চালুর মধ্য দিয়ে দেশেই মেধাবি ক্রাইম এক্সপার্ট ও ক্রিমিনোলজিস্ট তৈরি হওয়া সময়ের অপেক্ষা। বাংলাদেশের ঢাবি, চবি ও মাভাবিপ্রবির পাশাপাশি হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজের মতো বিশ্বখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ডিপার্টমেন্টে পড়ার সুযোগ রয়েছে। আমার দেশেই এই ডিপার্টমেন্টে পড়াশোনা করতে পেরে আমি গর্বিত।

লেখক: কনটেন্ট ক্রিয়েটর ও শিক্ষার্থী,
ক্রিমিনোলজি এন্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
ই-মেইল: turag6739@gmail.com