ইন্টারভিউ বোর্ডে সফল হতে অনুসরণ করুন ২০ ‘স্মার্ট টেকনিক’
সফলতার প্রথম ধাপই হলো ইন্টারভিউ। বর্তমান সময়ে চাকরির বাজার যেন সোনার হরিণ। অনেকে সম্পন্ন করেও চাকরির পেছনে হন্যে হয়ে ছুটছেন, অনেকে আবার চাকরির জন্য নির্বাচিত হয়ে লিখিত পরীক্ষাও দেন এরপর ভাইভা বা ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে বাদ পরে যান।
চাকরির ইন্টারভিউতে বেশিরভাগ প্রার্থীরা মানসিক চাপে ভোগেন। কিন্তু আপনি যখন এই চাপ অনুভব করবেন তখনই সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া আপনার জন্য কঠিন হয়ে পড়বে। এ কারণেই ইন্টারভিউ বোর্ডে প্রার্থীরা তালগোল পাকিয়ে ফেলেন। তাই আগে থেকেই বেশ কিছু বিষয় সর্তক হতে হবে। এসব নিয়েই আজকের আয়োজন। কিছু স্মার্ট টেকনিক অনুসরণ করে আপনিও ইন্টারভিউ বোর্ডে হয়ে উঠুন আত্মবিশ্বাসী।
ইন্টারভিউ বোর্ডে যে ভুলগুলি পরিহার করা উচিৎ
১. দেরিতে উপস্থিত হওয়াঃ সরি, আমি দেরি করে এসেছি সময়ানুবর্তিতার গুরুত্ব সম্পর্কে নতুন করে বলার কিছু নেই। দেরি করে যাওয়াটাই একটা বড় ত্রুটি, অজুহাত দেখানোটা আরও বড় ভুল। যথাযথ সময়ে ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত হওয়া আপনার সময়নিষ্ঠতার পরিচায়ক। এজন্য দেরিতে উপস্থিত হলে ইন্টারভিউ গ্রহণকারীদের কাছে প্রথমেই আপনার একটি নেতিবাচক ধারণা জন্মাতে পারে। কর্তৃপক্ষ নিশ্চয়ই চাইবে না, আপনি দেরি করে অফিসে আসবেন। চেষ্টা করুন হাতে একটু সময় নিয়ে যাত্রা শুরু করার, যাতে নির্ধারিত সময়ের আগে আপনি ইন্টারভিউ বোর্ডে উপস্থিত থাকতে পারেন।
২. যথাযথ পোশাক না পরাঃ ইন্টারভিউর সময় যথাযথ ও মার্জিত পোশাক পরা খুব জরুরি একটি বিষয়। মানানসই পোশাক না পরলে আপনি নিজের মধ্যে আত্মবিশ্বাসী মনোভাব ফুটিয়ে তুলতে ব্যর্থ হবেন, যা পুরো ইন্টারভিউ জুড়ে আপনার দুর্বলতার প্রকাশ ঘটাবে।
৩. দৃষ্টিকটু অঙ্গভঙ্গি করাঃ ইন্টারভিউর একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো মার্জিত, ভদ্র এবং নম্র স্বভাব বজায় রাখা। ইন্টারভিউ চলাকালীন আপনার চলাফেরা এবং অঙ্গভঙ্গি সাবলীল এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ হওয়া আবশ্যিক। তাই ইন্টারভিউয়ের সময়ে এমন কোন অঙ্গভঙ্গি করা যাবে না, যা দেখতে দৃষ্টিকটু এবং অভদ্রতার সামিল।
৪. সঠিকভাবে প্রশ্নের উত্তর না দেয়া: প্রশ্নোত্তর পর্ব চলার সময় প্রার্থী হিসেবে আপনাকে দৃঢ়তার সাথে সকল প্রশ্নের উত্তর দিতে হবে। আপনার উত্তর হওয়া চাই স্পষ্ট, সাবলীল এবং যুক্তিসঙ্গত। উত্তর দেয়ার সময় আমতা আমতা করা কিংবা স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে না বলতে পারা আপনাকে অন্য প্রার্থীদের তুলনায় পিছিয়ে রাখতে পারে।
৫.কোম্পানি সম্পর্কে ধারণা না রাখা: কোম্পানি সম্পর্কে ধারণা না রেখে ভাইভা দিতে গেলে চাকরি না হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। কারণ চাকরিদাতারা আপনার দক্ষতার পাশাপাশি যে জিনিস দেখে তা হলো তাদের কোম্পানি সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা রয়েছে কিনা? সেই কারণে দক্ষতার পাশাপাশি কোম্পানি সম্পর্কে ধারণা থাকা প্রয়োজন।
৬. প্রশ্ন এড়িয়ে যাওয়াঃ প্রশ্নকর্তার প্রশ্ন কখনো এড়িয়ে যাওয়া উচিত নয়। চেষ্টা করুন সব প্রশ্নের উত্তর দেবার। প্রশ্নটি সম্পর্কে যতটুকু ধারণা আছে, তা সাবলীল ও স্পষ্টভাবে গুছিয়ে বলুন। কোন প্রশ্নের উত্তর একদমই জানা না থাকলে “Sorry, I don’t know” অথবা “দু:খিত, আমি জানি না” বলে উত্তর দিন।
৭. বর্তমান বা আগের চাকরি সম্পর্কে নিন্দা করাঃ ইন্টারভিউর সময় কোন অবস্থাতেই বর্তমান কিংবা আগের কোন চাকরি বা চাকরিদাতার নামে নিন্দা করা উচিত নয়। বরং চাকরি ছাড়ার একটি যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করুন।
৮. অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস দেখানোঃ একজন প্রার্থী হিসেবে ইন্টারভিউ বোর্ডে অবশ্যই আপনাকে আত্মবিশ্বাসী ও দৃঢ় ব্যক্তিত্বের পরিচয় দিতে হবে। তবে কোন অবস্থাতেই অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস প্রদর্শন কাম্য নয়। এতে আপনার প্রতি বিরূপ ধারণা জন্মাতে পারে প্রশ্নকর্তার।
৯. মিথ্যা বলা বা ভুল তথ্য দেয়াঃ ইন্টারভিউ বোর্ডে নিজের অভিজ্ঞতা, যোগ্যতা, ব্যক্তিগত বিষয় ইত্যাদি সম্পর্কে মিথ্যাচার করা বোকামির সামিল। এসব বিষয়ে ভুল তথ্য দিলে পরবর্তীতে আপনার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করতে পারে। গুরুতর ক্ষেত্রে চাকরি হারানোর সম্ভাবনাও রয়েছে।
১০. বারবার ক্ষমা চাওয়াঃ ইন্টারভিউ চলাকালীন ঘন ঘন “sorry” বা “দুঃখিত” শব্দটি ব্যবহার করলে আপনার সামগ্রিক মূল্যায়ন ও গ্রহণযোগ্যতায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। এছাড়া নিজের অভিজ্ঞতা কিংবা যোগ্যতায় কোন ঘাটতি থাকলে সেটি সম্পর্কে বারবার ক্ষমা চাওয়া বা নিচু মনোভাব প্রকাশ করা আপনার দৃঢ় ব্যক্তিত্ব প্রকাশের অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে।
১১. বর্তমান বা আগের চাকরি সম্পর্কে নিন্দা করাঃ ইন্টারভিউতে কোনোভাবেই বর্তমান কিংবা আগের কোনো চাকরি বা চাকরিদাতার নামে নিন্দা করা উচিত নয়। বরং চাকরি ছাড়া বা ছাড়তে চাওয়ার যুক্তিসঙ্গত কারণ উল্লেখ করুন।
১২. প্রশ্নকর্তার কথায় মনোযোগ না দেয়া অথবা তাকে কথা বলার মাঝখানে থামিয়ে দেওয়াঃ প্রশ্নকর্তার কথা মনোযোগ দিয়ে না শুনলে অথবা তাকে কথা বলার মাঝে থামিয়ে দিলে প্রশ্নকর্তা বিরক্ত হতে পারেন। ইন্টারভিউ চলার সময় একজন প্রার্থীর উচিত প্রশ্নকর্তার সব কথা সতর্কভাবে শোনা ও তার কথা পুরোপুরি শেষ হবার পর উত্তর দেয়া।
১৩. ভুল অনুমান করাঃ ইন্টারভিউতে প্রশ্নকর্তার কোনো প্রশ্নের প্রেক্ষিতে ভুল অনুমান করা ক্ষতিকর। সময় নিন। ভালো করে বুঝুন তিনি কি জিজ্ঞেস করছেন। অনুমান না করে বরং তার কাছ থেকে আবার প্রশ্নটি জেনে নিয়ে তারপর উত্তর দিন।
১৪. প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আনতে ভুলে যাওয়া: প্রয়োজনীয় কাগজপত্র আনতে ভুলে যাওয়ার কারণেও চাকরির সুযোগ হারান অনেক প্রার্থী। তাই সিভি ও শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদসহ প্রয়োজনীয় কাগজপত্র নিতে কখনোই ভুল করা যাবে না।
১৫. আপনি কোম্পানির জন্য কী করতে পারবেন যা অন্য কেউ পারবে না: আপনার মধ্যে ইউনিক কী রয়েছে তা জানার চেষ্টা করে কোম্পানি। আপনি বলতে পারেন আপনার মধ্যে আপনার অভিজ্ঞতা, প্রযুক্তিগত দক্ষতা এবং গ্রাহকদের সঙ্গে সফল আদানপ্রদানের ক্ষমতাই আপনাকে অন্যদের থেকে আলাদা করেছে।
১৬. আমাদের কাছ থেকে কত স্যালারি আপনি আশা করেন: নিশ্চিন্ত থাকুন এই প্রশ্নটি আপনার দিকে ধেয়ে আসবেই। এর উত্তর দেওয়ার জন্য অবশ্যই কোম্পানির বর্তমান আর্থিক অবস্থা, আপনার অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষাগত যোগ্যতার কথা মাথায় রাখবেন।
১৭. আপনি কেন এখানে কাজ করতে চান: ভুল করেও যেন বলে বসবেন না যে আপনার চাকরির খুব দরকার তাই। বরং বলা উচিত আপনি কম্পানির গুড উইলস ও আগের কাজকর্ম সম্বন্ধে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। এই কোম্পানি সেই দিক থেকে সম্পূর্ণ আপনার পছন্দ মতো।
১৮. অকারণ প্রশ্ন করা: অনেক চাকরিপ্রার্থী অকারণ প্রশ্ন করে থাকেন। এটি চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক বড় অন্তরায়। কারণ অকারণ প্রশ্ন করলে চাকরিদাতারা বিরক্ত হন।
১৯. নিজেকে অযোগ্য হিসেবে উপস্থাপন না করা: অনেক সময় চাকরিপ্রার্থীরা আত্মবিশ্বাসের অভাবে বোর্ডে নিজেকে অযোগ্য প্রমাণ করে বসেন। ফলে চাকরিপ্রার্থী সম্পর্কে শুরুতেই চাকরিদাতাদের নেতিবাচক ধারণা জন্মে। এর কারণে চাকরি পাওয়া সম্ভব হয় না।
২০.হাসুন: হাসিমুখ হল একটা বিশ্বস্বীকৃত ভঙ্গি যা দ্বারা আপনি সহজেই বোঝাতে পারেন আপনি দিলখোলা মানুষ এবং আপনি এখানে আসতে পেরে খুশি। তাই দরজায় প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই মুখে হাসি রাখুন, হাসিমুখে প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিন।
আরও পড়ুন: স্কলারশিপ নিয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করুন ব্রিস্টল ইউনিভার্সিটিতে
ইন্টারভিউয়ের সময় কী কী করা উচিত নয় তা মুখে বলা খুবই সহজ, কিন্তু মুখের কথার বাইরে আপনি ইন্টারভিউয়ারের সামনে ঠিক কীভাবে আচরণ করছেন, বা কেমন প্রতিচ্ছবি তৈরি করছেন, সেটা আপনার চাকরি পাওয়া বা হারনোর পথ অনেকটাই সহজ করে দিতে পারে।
ইন্টারভিউয়ের সময় যে কাজগুলো আপনার ভাবমূর্তি নষ্ট করতে পারে
১. অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস: আত্মবিশ্বাসকে অহংকারের সাথে মিলিয়ে ফেলবেন না! যদি আপনার বিশ্বাস থাকেও যে আপনি সব প্রার্থীর চেয়ে বেশি যোগ্যতাসম্পন্ন, তবুও ইন্টারভিউ রুমে প্রবেশ করার সময় এ রকম চিন্তা ভুলেও মাথায় আসতে দেবেন না। বার বার নিজেকে স্মরণ করিয়ে দিন যে আত্মবিশাস এবং অহংকার দু’টো সম্পূর্ণ ভিন্ন জিনিস!
২. ইন্টারভিউ বহির্ভূত কার্যকলাপ: ইন্টারভিউ দেয়ার সময় আপনার ফোন ব্যবহার করা, কিংবা হাতের কলমটি নিয়ে আঁকিবুঁকি করা, বা আপনার চুল ও চেহারার কোন অংশ নিয়ে খেলা থেকে সম্পূর্ণ বিরত থাকুন। এই কাজগুলো স্পষ্টভাবেই বর্জনীয় বলে আমরা সবাই জানি, কিন্তু অনেকেই অবচেতন মনে এই কাজগুলো করে থাকেন, আর বুঝতেই পারেন না যে তারা নিজেদের বিব্রত করছেন।
৩. ছটফটে ভাব: প্রায় বেশির ভাগ কঠিন প্রশ্নের মুখে বিচলিত হয়ে পড়েন ও ছটফট করেন। এ ধরণের অস্থিরতা প্রকাশ করা, ঘন ঘন হাতের আঙুল বা পা ঠোকানো ইত্যাদি থেকে বিরত থাকার জন্য অনুশীলন নিন। এতে করে নিয়োগকারীদের সামনে আপনার উদ্বিগ্নতাই শুধু প্রকাশ পায় না, একই সাথে ইন্টারভিউ বোর্ডের মনোযোগও আপনার থেকে বিক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে। তবে আপনি নিশ্চয়ই একেবারে শক্ত ও আঁটসাঁট হয়ে থাকবেন না।
ইন্টারভিউয়ের সময় বর্জনীয় আরও কিছু বিষয়
* ইন্টারভিউয়ের সময় চুইং গাম, ক্যান্ডি বা কোন ধরণের খাবার মুখে রাখবেন না।
* আপনার হাতগুলোকে পকেটে ভরে বা লুকিয়ে রাখবেন না।
* হঠাৎ মনোযোগ বিচ্ছিন্ন না করে দিয়ে মনোযোগ ধরে রাখুন।
* আঙুল, হাত বা কলম দিয়ে শব্দ করা বা অস্থিরভাবে পা নাচাবেন না, ইত্যাদি।
* আপনার সিভিতে থাকা উক্তিগুলোর চেয়ে আপনার কাজ, শারীরিক ভাষা ও আত্মবিশ্বাসই আপনার হয়ে সুপারিশ করার ক্ষমতা রাখে বেশি। অতএব ইন্টারভিউয়ের সময় এই সহজ ব্যাপারগুলো সুন্দর ভাবে মেনে চললেই আপনি নিজেকে নিয়োগকারীদের সামনে পরিপূর্ণ ভাবে প্রকাশ করতে পারবেন।
আত্মবিশ্বাসের অভাব এবং নেতিবাচক আচরণের কারণেও অনেকে বাদ পড়ে যান। মনে রাখবেন, পেশাদার জায়গায় গিয়েছেন। ফলে, ব্যক্তিগত কথাবার্তা যত দূর সম্ভব বাদ দিন। যাঁরা ইন্টারভিউ নিচ্ছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ আপনার পূর্ব-পরিচিত হতেই পারেন। কিন্তু সেটা যেন প্রকাশ না-পায়। চাকরির ইন্টারভিউ দিতে গিয়ে অনেকেই নিজেকে ঠিকমতো উপস্থাপন করতে পারেন না। কেউ ভয় পেয়ে যান।