অধ্যক্ষের দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতিতে ম্লান কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র
মাদারীপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রকে ঘিরে অনিয়ম আর দুর্নীতি জেঁকে বসেছে। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি বিদেশ পাঠানোর সরকারের মহৎ উদ্দেশ্যই ভেস্তে যেতে বসেছে কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমানের স্বেচ্ছাচারিতায়। বিভিন্ন খাতে (ট্রেডে) তরুণ-তরুণীরা অর্থ ও সময় ব্যয় করে কলেজ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে এলেও সেটি বাস্তবে কাজে আসছে না অধ্যক্ষের আত্মীয়করণ আর দুর্নীতির কারণে। এ নিয়ে কলেজের নানা পর্যায়ে অসন্তোষ রয়েছে।
জানতে চাইলে মাদারীপুরের জলা প্রশাসক মো. ওয়াহিদুল ইসলাম বলেছেন, কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মের বিষয়টি মন্ত্রণালয় থেকে আমাকে তদন্ত করে দেখার জন্য বলা হয়েছে, আমি শিগগিরই এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেব।
সূত্র জানায়, মাদারীপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমানের ফরিদপুরে একটি প্রাইভেট পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট রয়েছে। সেখানে তার স্ত্রী মাকসুদা আক্তার অধ্যক্ষ পদে দায়িত্ব পালন করলেও ক্ষমতার অপব্যবহার করে তাকে মাদারীপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে খণ্ডকালীন প্রশিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগ থেকে পাস করা মাকসুদাকে প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের গার্মেন্টস ট্রেডের খণ্ডকালীন প্রশিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেয়া হলেও তাকে এ কেন্দ্রে সেভাবে দেখা যায় না। এছাড়া সম্প্রতি সেইফ প্রজেক্টে ৪টি ট্রেডে শিক্ষক নিয়োগ নিয়েও মোটা অংকের অর্থ লেনদেনের অভিযোগ উঠেছে। ছাত্রছাত্রীদের ড্রাইভিংয়ের প্রশিক্ষণ দেয়ার জন্য কলেজের ৩টি গাড়ি থাকলেও সেগুলো ব্যক্তিগত কাজে ব্যবহারের অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। এ নিয়ে ক্যাম্পাসে কানাঘুষা রয়েছে।
মোটর ড্রাইভিং কোর্সের সোহান নামের একজন ছাত্র এ প্রতিবেদককে বলেন, প্রশিক্ষণের সনদ হাতে পেলেও গাড়ি চালাতে পারি না। মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য সে দেশের ভাষা শিক্ষার জন্য এ প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছিলেন বাপ্পি নামের একজন ছাত্র। এ প্রতিবেদককে তিনি জানান, কোর্স সম্পন্ন হলেও ভাষা শেখা হয়নি। তবে সনদ পেয়েছি।
একজন শিক্ষক বলেন, এ পর্যন্ত এ কেন্দ্রে সব মিলিয়ে ভর্তি ছাত্রছাত্রীর সংখ্যা ১৮ হাজার। এর মধ্যে বিদেশগামী কর্মীদের ভর্তি ‘ফি’ ২০০ টাকা করে নেয়ার কথা থাকলেও নেয়া হচ্ছে ২৩০-২৫০ টাকা করে। অতিথি শিক্ষক দিয়ে শিক্ষক সংকট সামাল দেয়া কথা থাকলেও তা না নিয়ে এ খাতে বরাদ্দ অর্থ লোপাট করা হচ্ছে। হাউজ কিপিং ট্রেডের ছাত্রছাত্রীদের বেশিরভাগ ক্লাসই হয় না।
এছাড়া প্রচার কাজে মোটা অংকের অর্থ বরাদ্দ থাকলেও সেটা হচ্ছে না একেবারেই। প্রচার নিয়ে কথা হয় মাদারীপুর শহরের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে। সরকারি নাজিম উদ্দিন কলেজের শিক্ষার্থী রাসেল খান জানিয়েছে, ইন্সটিটিউটের কাজ সম্পর্কে আমরা অবগত নই। তবে কতগুলো দালান দেখি। ওখানে কি হয় তা জানি না। সরকার নিশ্চয়ই কোনো ভালো কাজের জন্য এগুলো করেছে।
সেইপ প্রকল্পের এক শিক্ষক জানান, সেইপ প্রকল্পের মালামাল ক্রয়েও দুর্র্নীতির বিস্তর অভিযোগ রয়েছে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে। সব শিক্ষার্থীকে আইডি কার্ড দেয়ার নির্দেশনা থাকলেও কাউকেই আইডি কার্ড দেয়া হয় না। শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আইডি কার্ড বাবদ ৩০ টাকা করে নেয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রতি ছাত্রের কাছ থেকে ফেরতযোগ্য জামানত বাবদ ১০০ টাকা করে রাখা হলেও তা কাউকেই দেয়া হয় না। তবে ১০০ করে টাকা নেয়ার সময়ই ফেরত দেয়ার ঘরে আগেই শিক্ষার্থীদের স্বাক্ষর রেখে দেয়া হয়। এসব অর্থ নানা ভাউচারের মাধ্যমে তুলে নেয়া হয়েছে।
প্রতিষ্ঠানের একজন কর্মকর্তা জানান, উন্নয়ন খাতে শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে ৭০ টাকা করে রাখা হচ্ছে। এ টাকা ব্যাংকে থাকার কথা। এ পর্যন্ত ১৮ হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী এ কেন্দ্রে ভর্তি হয়েছে। এসব খাত থেকে বিপুল অংকের টাকা লোপাটের অভিযোগ রয়েছে। শুধু তাই নয় প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের জন্য একটি সাইনবোর্ড বানানোতে খরচ দেখানো হয়েছে ৫৫ হাজার এবং নোটিশ বোর্ড বানানোর খরচ দেখানো হয়েছে ২৪ হাজার টাকা।
এ ব্যপারে মাদারীপুরের সৃজন অ্যাডের মালিক তুষার মোল্লা জানান, যে সাইজের সাইনবোর্ডে এ ব্যয় দেখানো হয়েছে তা অস্বাভাবিক। এ সাইজের একটি ভালোমানের সাইনবোর্ড বানাতে ১২ হাজার টাকার বেশি লাগার কথা নয়। আর নোটিশ বোর্ডের সর্বোচ্চ ব্যয় হওয়ার কথা ৫ হাজার টাকা।
অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে মাদারীপুর কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ মোস্তাফিজুর রহমান তার বিরুদ্ধে ওঠা সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, আমার বিরুদ্ধে একটি মহল ষড়যন্ত্র করছে। অতিরিক্ত বিল-ভাউচারের ব্যাপারে তিনি বলেন, ক্রয় কমিটির মাধ্যমে সব কিছু করা হয়। বিল যদি বেশি হয়ে থাকে তাহলে ক্রয় কমিটি আমার কাছে অভিযোগ দেবে, তবে তারা তো সেটা দেয়নি। ক্রয় কমিটি বিল-ভাউচারে স্বাক্ষর করে, এরপর হিসাবরক্ষক স্বাক্ষর করেন, তারপর আমার কাছে আসে। ভুল যদি করে থাকে ক্রয় কমিটি করেছে। একটি সাইনবোর্ডের দাম সম্পর্কে তিনি বলেন, একটা মার্কার সাইনবোর্ডে এ পরিমাণ টাকা লাগবে। ওটা লাইটিং সাইনবোর্ড, নরমাল কোনো সাইনবোর্ড নয়।
ড্রাইভিং ট্রেইনারকে দিয়ে ব্যক্তিগত গাড়ি চালানো প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ড্রাইভিং ট্রেইনারের কাজ গাড়ি চালানো। যেহেতু প্রতিষ্ঠানে ড্রাইভার নেই। তার সঙ্গে আমার যদি সুসম্পর্ক থাকে তাহলে আমি এক জায়গায় যাওয়ার জন্য বললে সে যেতেই পারে। আর যদি সে বলে আমি টিচার হিসেবে আছি, আমি যাব না। সেটা ভিন্ন ব্যাপার। সে তো বলেনি কখনও। শিক্ষকদের আমি ডরমেটরি থেকে নামিয়ে দেয়ায় তারা ক্ষিপ্ত হয়ে বিভিন্ন ধরনের বাজে চিঠি ও বাজে বক্তব্য দিচ্ছেন।