বন্ধ হচ্ছে পলিটেকনিকের দ্বিতীয় শিফট, অর্ধলক্ষ শিক্ষার্থীর ভাগ্য অনিশ্চিত
সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, মনোটেকনিক ইনস্টিটিউট ও টেকনিক্যাল স্কুলগুলোর দ্বিতীয় শিফট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর থেকে। ওইদিন থেকে দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন শিক্ষকরা। দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস নেওয়ার জন্য সরকার তাদের ভাতা বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়ে উল্টো কমিয়ে দেওয়ায় এ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তারা। ক্ষুব্ধ শিক্ষকরা ২০১৮ সালের জুলাই থেকে দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস নিলেও ভাতা উত্তোলন বন্ধ রেখেছেন।
এর আগে গত ১ আগস্ট থেকে সারাদেশে দ্বিতীয় শিফটের ক্লাস নেওয়া বন্ধ করে দেন তারা। ৭ আগস্ট কারিগরি শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রওনক মাহমুদ ও কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান মোরাদ হোসেন মোল্লার সঙ্গে আলোচনার পর তাদের আশ্বাসে সরকারকে দুই মাস সময় দেওয়া হয়। আগামী ৩০ সেপ্টেম্বর সেই সময় শেষ হবে। তবে এখন পর্যন্ত শিক্ষকদের দাবি পূরণের কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। এর আগে ভাতা বাড়ানোর দাবিতে শিক্ষকরা শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব মুন্সী শাহাব উদ্দিনের সঙ্গেও কয়েক দফা বৈঠক করেছেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষার্থী বাড়ানোর লক্ষ্য নিয়ে ১৯৮২ সালে সরকারি পলিটেকনিক ও টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বিতীয় শিফট চালু করা হয়। প্রায় ৪০ বছর ধরে শিক্ষকরা তাদের মূল বেতনের ৫০ শতাংশ হারে দ্বিতীয় শিফটের ভাতা হিসেবে পেয়ে আসছেন। গত বছর এপ্রিল মাসে অনেকটা আকস্মিকভাবে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের এক আদেশে এ ভাতা কমিয়ে দেওয়া হয়। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে শিক্ষকরা জুলাই থেকে ভাতা উত্তোলন বন্ধ করে দেন।
সংশ্নিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, দেশের বেকারত্ব কমানোর জন্য সরকার কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষায় ভর্তির হার আগামী বছর (২০২০ সালে) মোট শিক্ষার্থীর ২০%, ২০৩০ সালে ৩০% এবং ২০৪০ সালে ৫০%-এ উন্নীত করার টার্গেট নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে। দ্বিতীয় শিফট বন্ধ হয়ে গেলে কোনোভাবেই ওই টার্গেটে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।
বাংলাদেশ কারিগরি শিক্ষক পরিষদ কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি মো. তাহের জামিল বলেন, কারিগরি শিক্ষায় এনরোলমেন্ট বাড়াতে শিক্ষকরা নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছেন। তারা দ্বিতীয় শিফটে প্রথম শিফটের একই সমান ক্লাস নেন। পরীক্ষা ও খাতা দেখায় একই পরিমাণ শ্রম দেন। এর বিনিময়ে সরকার থেকে মূল বেতনের ৫০ শতাংশ অর্থ দ্বিতীয় শিফটের সম্মানী হিসেবে পেয়েছেন। ধাপে ধাপে তা শতভাগে উন্নীত করার জন্য সরকারি প্রতিশ্রুতিও দেওয়া হয়েছিল। এমনকি ২০১২ সালে মন্ত্রণালয়ের গঠন করা এক কমিটির প্রস্তাবে এ ভাতা ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে মূল বেতনের ৭৫ শতাংশে উন্নীত করার প্রস্তাব করা হয়েছিল। তিনি জানান, ২০১৫ সালে অষ্টম জাতীয় বেতন স্কেল চালুর পর তিন বছর একই হারে তা পেয়েছেন। তবে ২০১৮ সালের এপ্রিলে অনেকটা আকস্মিকভাবে কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের এক প্রজ্ঞাপনে এ ভাতা ১ জুলাই ২০১৮ থেকে ২০০৯ সালের বেতন স্কেলের ৫০ শতাংশ দেওয়ার কথা বলা হয়। এতে ভাতা কমে চার ভাগের এক ভাগ হওয়ায় তারা ভাতা উত্তোলন বন্ধ করে দেন। এই শিক্ষক নেতা বলেন, এরই মধ্যে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে তারা একাধিক বৈঠক করেছেন। এখন সরকার তাদের ২০০৯ সালের বেতন স্কেলের ৬৭ শতাংশ হারে ভাতা দিতে চায়। আর তাদের দাবি, ২০১৫ সালের স্কেলের ৫০ শতাংশ হারে ভাতা দিতে হবে।
সারাদেশের ৪৯টি সরকারি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ও ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল অ্যান্ড কলেজে বর্তমানে দ্বিতীয় শিফট প্রোগ্রাম চালু আছে। প্রতি বছর প্রথম শিফটে ৫০ হাজার এবং দ্বিতীয় শিফটে ৫০ হাজার, মোট এক লাখ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হয়। ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের একাধিক শিক্ষক জানান, কারিগরি শিক্ষার হার বৃদ্ধিতে দ্বিতীয় শিফটের একটি বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। এটি ব্যাহত হলে কারিগরি শিক্ষায় ভর্তি হ্রাস পাবে।
বাংলাদেশ পলিটেকনিক শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষক জহিরুল ইসলাম বলেন, মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে হঠাৎ করে পুরনো স্কেলে ভাতা নির্ধারণ করাতেই সংকট সৃষ্টি হয়েছে। নতুন এই আদেশ অমানবিক। একটি কার্যকর বিষয়কে এভাবে অকার্যকর করা যায় না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, সরকার চাইলে দ্বিতীয় শিফটের জন্য আলাদা জনবল নিয়োগ দিতে পারে, আমাদের তাতে আপত্তি নেই। আমরা প্রথম শিফটের জন্য নিয়োগপ্রাপ্ত। আমরা আমাদের কাজ করব।
কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ সূত্র জানায়, কারিগরি শিক্ষকদের বেতন জটিলতা নিরসনে উদ্যোগ নিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি ও উপমন্ত্রী ব্যারিস্টার মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। অর্ধেকের পরিবর্তে শিক্ষকদের গ্রেডভিত্তিক সম্মানী ভাতা দিতে ৫১ কোটি ৫৫ লাখ টাকা পরিশোধের সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য প্রস্তাব দিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে একটি পত্র পাঠিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী।
ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশের (আইডিইবি) সাধারণ সম্পাদক মো. সামসুর রহমান বলেন, শিক্ষকদের দাবি অত্যন্ত যৌক্তিক। সরকারের কাছে আমাদেরও সুপারিশ- অবশ্যই তাদের সম্মানী বাড়াতে হবে।