এক গ্রুপ চান বিসিএস ক্যাডার হতে, অন্য গ্রুপ ১০ম গ্রেড
বেতন ও গ্রেড বৈষম্যের অভিযোগে দেশজুড়ে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করছেন। এদের মধ্যে প্রাথমিকের শিক্ষকরা ১০ম গ্রেড ও মাধ্যমিকের শিক্ষকরা সহকারী শিক্ষক পদটি বিসিএস ক্যাডারভুক্ত করার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন। এতে দেশের বেশিরভাগ প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে বার্ষিক পরীক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। পরীক্ষা দিতে এসে ফিরে যেতে হয়েছে শিক্ষার্থীদের। তবে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান আগেই নোটিশ দিয়ে পরীক্ষা স্থগিতের কথা জানিয়েছে।
সোমবার (১ ডিসেম্বর) সকাল থেকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, রাজধানীর সরকারি ৩১টি মাধ্যমিক স্কুলের একটিতেও আজকের পরীক্ষা নেয়নি শিক্ষকরা। পরীক্ষা দিতে আসা শিক্ষার্থীদের ফিরে যেতে দেখা গেছে। একইভাবে চট্টগ্রাম, সিলেট, বরিশাল, কুমিল্লা, রংপুরসহ বিভিন্ন বিভাগের অনেক প্রতিষ্ঠানেই পরীক্ষা হচ্ছে না বলে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের প্রতিনিধিরা জানিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির ব্যানারে এ কর্মসূচি চলছে। এই সমিতির কেন্দ্রীয় সমন্বয় কমিটির সমন্বয়ক মোহাম্মদ ওমর ফারুক বলেন, মন্ত্রণালয় যদি তাদের দাবিগুলো পূরণের বিষয়ে রূপরেখাসহ সুনির্দিষ্ট প্রতিশ্রুতি দেন, তাহলে তারা শিক্ষার্থী ও জাতীয় স্বার্থে কর্মবিরতি রাখবেন না।
এ বিষয়ে গতকাল (রবিবার) সরকারি মাধ্যমিক শিক্ষক সমিতির এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, দীর্ঘদিনের পেশাগত মর্যাদা ও বেতন-ভাতাসংক্রান্ত চার দফা দাবির বিষয়ে আজ (রবিবার) মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের সামনে শিক্ষকরা দ্বিতীয় দিনের মতো অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন; কিন্তু দাবিগুলো না মানায় আজ থেকে লাগাতার কর্মবিরতিতে যাচ্ছেন।
মাধ্যমিক শিক্ষকদের চার দফা দাবিগুলো হলো- সহকারী শিক্ষক পদকে বিসিএস (সাধারণ শিক্ষা) ক্যাডারভুক্ত করে ‘মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর’-এর গেজেট প্রকাশ, বিদ্যালয় ও পরিদর্শন শাখায় কর্মরত শিক্ষকদের বিভিন্ন শূন্য পদে নিয়োগ, পদোন্নতি ও পদায়ন দ্রুত কার্যকর করা, সুপ্রিম কোর্টের রায়ের আলোকে বকেয়া টাইমস্কেল ও সিলেকশন গ্রেডের মঞ্জুরি আদেশ দেওয়া এবং ২০১৫ সালের আগের মতো সহকারী শিক্ষকদের দুই থেকে তিনটি ইনক্রিমেন্টসহ অগ্রিম বর্ধিত বেতন-সুবিধা বহাল করে গেজেট প্রকাশ।
এদিকে সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চলমান বার্ষিক ও টেস্ট পরীক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষক-কর্মকর্তাদের উপস্থিতি জানানোর নির্দেশ দিয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, সোমবার সরকারি (নিম্ন মাধ্যমিক, মাধ্যমিক, স্কুল এন্ড কলেজের মাধ্যমিক স্তর) শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো চলমান বার্ষিক, টেস্ট পরীক্ষা গ্রহণসংক্রান্ত এবং পরীক্ষার দায়িত্বে নিয়োজিত শিক্ষক, কর্মকর্তাদের উপস্থিতি সংক্রান্ত তথ্য দুপুর ১২টার মধ্যে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগ পাঠানোর জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো।
অন্য আরেকটি বিজ্ঞপ্তিতে মাধ্যমিক পর্যায়ে সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বার্ষিক, জুনিয়র বৃত্তি ও নির্বাচনী পরীক্ষা গ্রহণ ও সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের নির্দেশ দিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তর (মাউশি)। আজ সোমবার অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ড. খান মইনুদ্দিন আল মাহমুদ সোহেল স্বাক্ষরিত বিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এটি অমান্য করলে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানিয়েছে মাউশি।
অন্যদিকে, সহকারী শিক্ষকদের ১০ম গ্রেড প্রদানসহ তিন দাবিতে প্রাথমিকের সহকারী শিক্ষকেরা এ মাসের শুরুতে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান ও বিদ্যালয়ে কর্মবিরতি শুরু করেছিলেন। আন্দোলন চলাকালেই অর্থ বিভাগের সচিব এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে বৈঠকের পর আন্দোলনকারী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষকেরা আন্দোলন প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ওই বৈঠকের পর সরকার থেকে বলা হয়েছিল, সহকারী শিক্ষকদের বেতন গ্রেড ১১তম করার বিষয়ে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবটি জাতীয় বেতন কমিশনে পাঠানো হয়েছে, যা বেতন কমিশনের বিবেচনাধীন। কমিশনের সুপারিশ পাওয়ার পর অর্থ বিভাগ এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম গ্রহণ করবে।
তবে ১১তম গ্রেডে বেতন বাস্তবায়নের দাবিতে ‘প্রাথমিক শিক্ষক দাবি বাস্তবায়ন পরিষদ’-এর অনুসারীরা আজ থেকে পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করছেন। একইসঙ্গে আজকের বার্ষিক পরীক্ষা বর্জনেরও ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
আন্দোলনকারীরা জানিয়েছেন, সরকারের আশ্বাস অনুযায়ী ১১তম গ্রেডে বেতন বাস্তবায়ন না হওয়া পর্যন্ত তারা কর্মবিরতি চালিয়ে যাবেন। ময়মনসিংহের ফুলপুর উপজেলার চাঁনপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও দাবি বাস্তবায়ন পরিষদের আহ্বায়ক মো. আবুল কাসেম বলেন, ‘সোমবার থেকে বার্ষিক পরীক্ষা শুরু হলেও আমরা তা বর্জন করছি। দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত কর্মবিরতি অব্যাহত থাকবে।’
অন্যদিকে, সহকারী শিক্ষকদের আরেকটি অংশ ‘সহকারী শিক্ষক সংগঠন ঐক্য পরিষদ’- এর ব্যানারে বেতন ১১তম গ্রেডসহ তিন দফা দাবি আদায়ে আগামী ১১ ডিসেম্বর থেকে অনশন কর্মসূচি শুরুর ঘোষণা দিয়েছেন তারা।
তবে বেশ কিছু অঞ্চলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা চলমান রয়েছে। তবে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের কেউই তাদের স্কুলের নাম পরিচয় প্রকাশ করতে চাননি। এর মধ্যে রয়েছে চট্টগ্রামের আনোয়ারা, মিরসরাই উপজেলার বেশ কিছু বিদ্যালয়। ভোলার চরফ্যাশনের প্রায় সব বিদ্যালয়, কুমিল্লার চৌদ্দগ্রাম উপজেলার কিছু বিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বেশ কিছু প্রাথমিক বিদ্যালয়।
ভোলা চরফ্যাশন উপজেলার একটি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘সমিতির পক্ষ থেকে আমরা আগেই নোটিশ পেয়েছি বার্ষিক পরীক্ষা বন্ধ রাখার। তবে শিক্ষার্থীদের কথা বিবেচনা করে বিদ্যালয়ের সবার সিদ্ধান্তক্রমে আমরা পরীক্ষা নিচ্ছি। তবে আনুষ্ঠানিকভাবে এটা প্রকাশ করতে পারছি না।’
এদিকে রাজধানী ঢাকার বিদ্যালয়গুলোতেও সকালে যথাসময়ে পরীক্ষা শুরু হতে দেখা গেছে। তবে নীলক্ষেত সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়সহ কয়েকটি স্কুলে কিছুটা বিলম্বে পরীক্ষা শুরু হয়।
শিক্ষকরা বলেন, আন্দোলনের কারণে শিশুশিক্ষার্থীদের লেখাপড়ার ওপর প্রভাব না পড়ুক সেটা চান না তারা। তবে সরকারকে তাদের দাবিও বিবেচনা করতে হবে। পরীক্ষা নেওয়ার জন্য সরকারের পক্ষ থেকেও নির্দেশ আছে বলেও জানান শিক্ষকরা।
অভিভাবকরা উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, শিক্ষকদের কর্মবিরতিতে প্রভাব পড়ছে শিক্ষার্থীদের ওপরে। তাই সরকার এবং শিক্ষক উভয়পক্ষকে বিষয়টি বিবেচনা করে দেখতে হবে।
এছাড়া প্রাথমিক প্রধান শিক্ষকদের সংগঠন ‘বাংলাদেশ সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক সমিতি’ থেকেও যথাসময়ে আজকের পরীক্ষা নেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।