‘নীল দল ১০০০, সাদা দল ১০০’— ঢাবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে জিতবে কারা?
- তাওসিফুল ইসলাম
- প্রকাশ: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৪:২৩ PM , আপডেট: ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৫:০৬ PM
প্রতিবছর ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) শিক্ষক সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ২০২৩ সালের ১২ ডিসেম্বর সর্বশেষ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সাদা দল বর্জন করায় বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় পুরো প্যানেল জিতে আওয়ামীপন্থী নীল দল। তা ছাড়া ২০০৯ সালের পর গত দেড় দশকে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করে আসছে আওয়ামীপন্থী এই প্যানেল।
সাদা দলের শিক্ষকদের অভিযোগ, মেধার ভিত্তিতে নয়, গত সাড়ে ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগে ‘আওয়ামীপন্থী’ ভোটারদের প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। ফলে সমিতির নির্বাচনে বারবার পরাজয় বরণ করতে হয়েছে তাদের। দলটির সদ্য সাবেক আহ্বায়ক ও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসি অধ্যাপক লুৎফর রহমান অভিযোগ করে কলেন, নির্বাচনে ‘ইয়াং কলিগদের ভোট দিতে বাধ্য’ করেছিল আওয়ামীপন্থীরা।
সামনের সমিতির নির্বাচনে জিতবে কারা?
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকের সংখ্যা ২২৯৯ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক রয়েছেন ১ হাজার ১৩২ জন, সহযোগী অধ্যাপক ৩৬৩ জন, সহকারী অধ্যাপক ৫৪০ জন ও প্রভাষক ২৩৫ জন। গত ১৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতিসহ যত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সব কটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা।
গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঢাবি শিক্ষক সমিতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে সাদা দল। ২২ আগস্ট সাদা দলের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অনির্বাচিত শিক্ষক সমিতির বিগত দিনের কর্মকাণ্ড শিক্ষক-শিক্ষার্থীবান্ধব না হওয়ায় স্বৈরাচারী সরকার ও তাদের দোসরদের অব্যাহত সমর্থন প্রদান করায় এবং সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে প্রত্যাখ্যান করছেন সাদা দল সমর্থক শিক্ষকরা।
এর কারণ হিসেবে সাদা দলের শিক্ষকরা মনে করেন, এই সময়ে তিন ভিসি (অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, অধ্যাপক মো. আখতারুজ্জামান ও অধ্যাপক এ এস এম মাকসুদ কামাল) দায়িত্ব পালনকালে আওয়ামী সমর্থিতদের শিক্ষক হিসেবে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শুধু তাই নয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়োগেও একই অবস্থা বলে দাবি করেন তারা। ফলে তারা ভোটার হিসেবে নিয়োগ পেয়ে এসব নির্বাচনে প্রভাব ফেলত বলে জানান তারা।
সাদা ও নীল দলের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নীল দলের প্রায় এক হাজার শিক্ষক রয়েছে। অন্যদিকে সাদা দলের রয়েছে শতাধিক শিক্ষক। গত ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত সংখ্যাটি এমনই বলে দাবি করছেন তারা।
এ প্রসঙ্গে নীল দলের সিনিয়র একজন অধ্যাপক বলেন, ‘আমাদের সর্বশেষ শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সর্বোচ্চ ১ হাজার ২০০ পর্যন্ত ভোট পড়েছে নীল দলের শিক্ষকদের পক্ষে। তাই নীল দলের শিক্ষকদের সংখ্যাটি এক হাজারের আশপাশে হবে।’ অনুষদের কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া দলটির জুনিয়র এক শিক্ষক বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিটি অনুষদে ৬০ শতাংশ শিক্ষক নীল দল সমর্থিত। তারা কর্মসূচিতে অংশ নিতেন, তবে নীল দলপন্থী শিক্ষক হিসেবে করলে সংখ্যাটি আরও কম হবে।
“গত ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় হারে যেভাবে আওয়াম লীগ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে, তা নজিরবিহীন। সে কারণে আপাতত নির্বাচন আয়োজন না করতে আমি পরামর্শ দিয়েছি।’ কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘ভোটার তো সব তাদের (নীল দলের)। তাই এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে জিতবেও তারা।’
অন্যদিকে, সাদা দলের একজন সিনিয়র অধ্যাপক বলেন, গত ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত তাদের দলীয় সভাগুলোয় শতাধিক শিক্ষক উপস্থিত থাকত। তাই তাদের শতাধিক শিক্ষক রয়েছেন বলে তিনি দাবি করেন। এ অবস্থায় তারা (সাদা দল) নির্বাচনে অংশ নিলে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করবে কি না, সে সন্দেহ তার। সাদা দলের কর্মসূচিতে অংশ নেন কলা অনুষদের এমন একজন শিক্ষক জানান, ৫ আগস্টের আগপর্যন্ত শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে সাদা দলের সর্বোচ্চ ৩০০ ভোট পড়ত। তবে সাদা দলপন্থী শিক্ষক, যারা দলটির কর্মসূচিতে অংশ নিতেন, তাদের সংখ্যা ১০০-১৫০ হবে।
২০০৯ সালের পর থেকে শিক্ষক সমিতির নির্বাচনের ফলাফল যেমন ছিল
বর্তমানে শিক্ষক সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মূলত দুটি প্যানেল থেকে। আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষকরা নীল দল এবং বিএনপি-জামায়াতপন্থী শিক্ষকদের সাদা দলের প্যানেল হয়ে নির্বাচনে অংশ নেন। এ ছাড়া একসময় বামপন্থী শিক্ষকরা গোলাপি দলের প্যানেল থেকে নির্বাচনে অংশ নিতেন। তবে বেশ কয়েক বছর ধরে তারা থাকছে না নির্বাচনে।
২০০৯ সালে দেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ। এরপর থেকে সাদা দলের পক্ষে অধ্যাপক এ বি এম ওবায়দুল ইসলাম দুবার (২০০৯ ও ২০১০ সাল) শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক পদে জয়ী হয়েছিলেন। এর পর থেকে সমিতির শীর্ষ দুই পদে সব সময় জিততেন আওয়ামী লীগপন্থী নীল দলের শিক্ষকরা। তা ছাড়া এসব নির্বাচনে কার্যকরী কমিটিতে পুরো প্যানেলে নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন করতেন তারা। সাদা দলের শিক্ষকরা সর্বোচ্চ দুয়েকটি পদে জিততেন।
বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষকের সংখ্যা ২ হাজার ২৯৯ জন। এর মধ্যে অধ্যাপক রয়েছে ১ হাজার ১৩২ জন, সহযোগী অধ্যাপক ৩৬৩ জন, সহকারী অধ্যাপক ৫৪০ জন ও প্রভাষক ২৩৫ জন। গত ১৫ বছরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সমিতিসহ যত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সব কটিতে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছে আওয়ামী লীগ সমর্থিতরা।
জয়ের ব্যাপারে আত্মবিশ্বাসী অধ্যাপক লুৎফর
অধ্যাপক লুৎফর রহমান। সাদা দলের সদ্য সাবেক আহ্বায়ক বর্তমানে যিনি জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রো-ভিসির দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে প্রায় অংশ নিতেন। একবার সমিতির ভারপ্রাপ্ত সভাপতিরও দায়িত্ব পালন করছেন। এই অধ্যাপক বলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি নির্বাচন হলে জাতীয়তাবাদী শিক্ষকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। গত সাড়ে ১৫ বছরে শিক্ষক নিয়োগে আওয়ামী পন্থীদের নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনের সময় স্বৈরাচারী পন্থায় তারা ইয়াং কলিগদের তাদের ভোট দিতে বাধ্য করেছে। আগামী নির্বাচন হবে উন্মুক্ত। যার যাকে খুশি ভোট দেবে। আমি মনে করি নীল দল আগামী চার-পাঁচ বছরে নির্বাচনে আসার সাহস পাবে না। আওয়ামী আমলেও আমি কয়েকবার জিতে এসেছি। আমি বিশ্বাস করি, সাদা দলের পক্ষেই থাকবে বেশিরভাগ শিক্ষক।’
তিনি বলেন, ‘সাধারণত শিক্ষক সমিতি পরবর্তী বছরের জন্য ডিসেম্বরে নির্বাচনের আয়োজন করে। গত বছর সাদা দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। কারণ পতিত স্বৈরাচারী সরকার বিরোধীদলীয় সব নেতাকর্মীকে জেলে ঢুকিয়ে ৭ জানুয়ারি নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। তাই সাদা দল শিক্ষক সমিতির নির্বাচনকেও প্রত্যাখ্যান করে। ফলে একতরফা অনির্বাচিত কমিটি গঠন হয়েছে। এ বছরের ১ জানুয়ারি থেকে তারা দায়িত্ব পালন শুরু করেছে। জুলাই আন্দোলনে সাদা দলের শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের পাশে দাঁড়ালেও শিক্ষক সমিতি বিপরীতমুখী অবস্থান নেয়। আন্দোলন চলাকালে আমরা এই শিক্ষক সমিতিকে প্রত্যাখ্যান করেছি। তার ধারাবাহিকতাই ৫ আগস্ট যখন নতুন স্বাধীনতা লাভ করলাম এই অনির্বাচিত শিক্ষক সমিতির কোন কার্যকারিতা থাকলো না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নির্বাচন আদৌ হবে কি না, আমি সন্দিহান। এ মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন ছাড়া অন্য কোনো নির্বাচনের সুযোগ আছে বলে আমি মনে করি না। এটা আমার ধারণা। শিক্ষকরা, বিশেষ করে সাদা দল এখন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে নানান কার্যক্রমে সহযোগিতা করছে।’
“আমি বিশ্বাস করি, নির্বাচন হলে জাতীয়তাবাদী শিক্ষকরাই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবে। গত সাড়ে ১৫ বছরে শিক্ষক নিয়োগে আওয়ামী পন্থীদের নিয়োগ দেওয়ার পাশাপাশি নির্বাচনের সময় স্বৈরাচারী পন্থায় তারা ইয়াং কলিগদের তাদের ভোট দিতে বাধ্য করেছে। আগামী নির্বাচন হবে উন্মুক্ত। যার যাকে খুশি ভোট দেবে। আমি মনে করি, নীল দল আগামী চার-পাঁচ বছরে নির্বাচনে আসার সাহস পাবে না। আওয়ামী আমলেও আমি কয়েকবার জিতে এসেছি। আমি বিশ্বাস করি, সাদা দলের পক্ষেই থাকবে বেশিরভাগ শিক্ষক-অধ্যাপক লুৎফর রহমান, সাদা দল শিক্ষক
নির্বাচনের দাবি আছে কি না, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কার কাছে সে দাবি করব? শিক্ষক সমিতি তো অ্যাক্সিস্ট (বিদ্যমান) করে না। তবে প্রশাসনের সাথে সাদা দল নিশ্চয়ই আলাপ করবে। আলাপ করে ঠিক করবে কারা নির্বাচনের আয়োজন করবে। আশা করি, সাদা দল অত্যন্ত স্মার্টলি হ্যান্ডেল করবে।’ তবে প্রশাসন এ মুহূর্তে এই নির্বাচন করতে পারবে কি না, সন্দিহান অধ্যাপক লুৎফর রহমান।
এবার নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব?
সম্প্রতি সাদা দলের সভায় এবারের শিক্ষক সমিতির নির্বাচন আয়োজন নিয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে শিক্ষকরা এ বিষয়ে তাদের মতামত ব্যক্ত করেন। সভায় উপস্থিত সাদা দলের সাবেক একজন আহ্বায়ক বলেন, ‘গত ১৫ বছরে বিশ্ববিদ্যালয়ে দলীয় হারে যেভাবে আওয়াম লীগ শিক্ষক নিয়োগ দিয়েছে, তা নজিরবিহীন। সে কারণে আপাতত নির্বাচন আয়োজন না করতে আমি পরামর্শ দিয়েছি। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ভোটার তো সব তাদের (নীল দলের)। তাই এ মুহূর্তে নির্বাচন হলে জিতবেও তারা।’
দেশে জরুরি অবস্থার কারণে ২০০৮ সালের ঢাবি শিক্ষক সমিতির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। বিষয়টি সামনে এনে এখন সাদা দলও যত দিন নির্বাচিত সরকার না আসবে, তত দিন এই নির্বাচন আয়োজন থেকে বিরত থাকবে, সভায় এমনটাও আলোচনা হয়েছে বলেন তিনি।
এদিকে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর ঢাবি শিক্ষক সমিতিকে প্রত্যাখ্যান করেছে সাদা দল। ২২ আগস্ট সাদা দলের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছিল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান অনির্বাচিত শিক্ষক সমিতির বিগত দিনের কর্মকাণ্ড শিক্ষক-শিক্ষার্থীবান্ধব না হওয়ায়, স্বৈরাচারী সরকার ও তাদের দোসরদের অব্যাহত সমর্থন প্রদান করায় এবং সাম্প্রতিক ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতিকে প্রত্যাখ্যান করছেন সাদা দল সমর্থক শিক্ষকরা।
বিষয়টি বহাল রেখে শিক্ষক সমিতির সব কার্যক্রম স্থগিত থাকবে বলে মনে করেন সাদা দলের সিনিয়র ওই অধ্যাপক।
নির্বাচন আয়োজনের বিষয়ে সমিতির বর্তমান সভাপতি অধ্যাপক নিজামুল হক ভুঁইয়া বলেন, ‘এখনো নির্বাচনের তারিখ ঠিক হয়নি। আমরা দু-এক দিনের মধ্যেই সবার সঙ্গে বসব। বসে আলাপ-আলোচনা করে নির্বাচন দিয়ে দেব।’