সর্বজনীন পেনশন চালু হলে শিক্ষকতায় আগ্রহ হারাবেন মেধাবী শিক্ষার্থীরা
গত ১৩ মার্চ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের জারি করা প্রজ্ঞাপনে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকসহ কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বর্তমান পেনশন ব্যবস্থা থেকে বের করে সর্বজনীন পেনশন স্কিমের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এরপর ফুঁসে উঠে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষক সমাজ। এর প্রতিবাদে মানববন্ধন ও অর্ধবেলা কর্মবিরতিও পালন করেছেন শিক্ষকরা।
তারা মনে করছেন, এটি চালু হলে একদিকে বৈষম্য তৈরি হবে, অন্যদিকে শিক্ষক পেশায় মেধাবী শিক্ষার্থীদের পাওয়া যাবে না। শিক্ষকরা পূর্বের পেনশন স্কিম চালু রাখা এবং পেশাগত সুযোগ-সুবিধা সম্বলিত একটি স্বতন্ত্র বেতন কাঠামো প্রবর্তনের দাবি জানান।
শিক্ষকরা বলছেন, পুরো শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে চক্রান্ত চলছে। প্রাথমিক শিক্ষা থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষা কিছুই বাদ যায়নি। পাকিস্তান আমলে শিক্ষকদের উপর নিপীড়ন-নির্যাতন দেখে বঙ্গবন্ধু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা হবেন স্বাধীন। এই জন্য তিনি ৭৩-এর অ্যাক্টের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্বায়ত্তশাসন দিয়েছিলেন। কিন্তু আজ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদেরকে বৈষম্যমূলক স্কিমের আওতায় যুক্ত করা হয়েছে। স্কিমের নাম দেওয়া হয়েছে সর্বজনীন স্কিম। কিন্তু সেখানে পুলিশ, আমলা, সেনাবাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। তাহলে সেই স্কিম কীভাবে সর্বজনীন হয়?
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সাবেক সভাপতি অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করার জন্য পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ৭৫ বছরের পর আর কোনো সুবিধা পাবেন না শিক্ষকরা। সুযোগ-সুবিধা না পেলে মেধাবীরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে আসবেন না।
শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক অধ্যাপক ড. মামুনুর রহমান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা শিক্ষা, গবেষণায় যে বেতন-ভাতা পান তা খুবই অপ্রতুল। এখন শিক্ষকদের বেতন ভাতা না বাড়িয়ে উল্টো কমিয়ে দেয়া হচ্ছে। এমন হলে বিশ্ববিদ্যালয় আর জ্ঞান চর্চার জায়গা থাকবে না। কারণ মেধাবীরা এ পেশায় আর আসবেন না। তারা অন্য ক্ষেত্রে বা বিদেশে যেখানে আরও বেশি সুবিধা আছে সেখানে চলে যাবেন। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বঞ্চিত করলে দেশ বঞ্চিত হবে।
শিক্ষক সমিতির সভাপতি অধ্যাপক ড. আনোয়ার হোসেন বলেন, ২০১৫ সালে যারা ষড়যন্ত্র করেছিল, বর্তমানে সর্বজনীন পেনশনের ক্ষেত্রেও তারাই ষড়যন্ত্র করছে। তারা চায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যেন মেধাবী শিক্ষকরা না আসেন। কারণ মেধাবীদের সাথে তারা যুক্তিতে পারে না। তাই তারা চায় বিশ্ববিদ্যালয়ে যত অযোগ্য শিক্ষক আসবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ততো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে। শিক্ষকদের সাথে যদি এরকম বৈষম্যমুলক আচরণ করা হয় তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যোগ্য শিক্ষক হারাবে।
নতুন পেনশন স্কিমে শিক্ষকরা বঞ্চিত হবেন দাবি করে অধ্যাপক আনোয়ার বলেন, আমরা যারা সিনিয়র শিক্ষক আছি আমরা অবসরের পর পাবো ১ কোটি ১৫ লাখ টাকা। বর্তমান শিক্ষকদের এই টাকার পরিমাণ অনেক কম হবে। এছাড়াও প্রতিটি শিক্ষকের একজন করে নমিনি থাকে। শিক্ষকদের অনুপস্থিতিতে তারা আজীবন টাকা পাবে। বর্তমান নিয়মানুযায়ী নমিনি ৭৫ বছর পর্যন্ত টাকা পাবে। এত বৈষম্য থাকলে পরবর্তীতে মেধাবী শিক্ষার্থীরা শিক্ষকতা পেশায় আসবেন না।
তিনি বলেন, প্রধানমন্ত্রী যখন পেনশন স্কিম চালু করেন তখন এই প্রত্যয় স্কিম ছিল না। হঠাৎ করে এটা যুক্ত করা হয়েছে। তাই বোঝা যায় পূর্বের ষড়যন্ত্র এবারও করা হয়েছে। অন্যায়ভাবে ষড়যন্ত্র করে এই প্রত্যয় স্কিম যুক্ত করা হয়েছে। এটা প্রত্যাহার না করা হলে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি এই কর্মসূচিতেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। তারা আরও বড় কর্মসূচি ঘোষণা করবে। প্রশাসনের ভেতরে যারা সরকারে ভালো চায় না, সেই ঘাপটি মেরে থাকা দেশদ্রোহী কুচক্রী মহল এই কাজ করেছে।
প্রসঙ্গত, ২০২৪ সালের জুলাই থেকে এসব প্রতিষ্ঠানে যারা যোগদান করবেন তাদের বাধ্যতামূলকভাবে সার্বজনীন পেনশনের সর্বশেষ স্কিমের আওতাভুক্ত করতে হবে। ফলে আগামী ১ জুলাই এবং তৎপরবর্তীতে নিয়োগপ্রাপ্ত সকলেই এই ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হবেন। এই স্কিমে বর্তমান ব্যবস্থার মতো অবসরের পর এককালীন অর্থ পাওয়া যাবে না।
এদিকে, এ পেনশন স্কিম প্রত্যাহারের দাবিতে গত ৪ জুন দেশের সব পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের ডাকা অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালিত হয়। এদিন দুপুরে পূর্বঘোষিত কর্মসূচি অনুযায়ী অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) কলা ভবনে ফেডারেশনের নেতারা ২৪ জুন পর্যন্ত সরকারকে সময় বেঁধে দেন।
ঘোষণা অনুযায়ী, আগামী ২৫, ২৬ ও ২৭ জুন অর্ধদিবস কর্মবিরতি পালন করবেন শিক্ষকরা। এছাড়া ৩০ জুন শিক্ষকরা পূর্ণদিবস কর্মবিরতি পালন করবেন। তবে, পরীক্ষা কর্মবিরতির আওতামুক্ত থাকবে। দাবি আদায় না হলে আগামী ১ জুলাই থেকে দেশের সবকটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বাত্মক কর্মবিরতি পালিত হবে।