জাতীয়করণের দাবিতে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষক নেতা বরখাস্ত
দেশের মাধ্যমিক শিক্ষা জাতীয়করণ, বেসরকারি শিক্ষকদের নানা দাবিতে বিভিন্ন সময়ে আন্দোলনে থাকা শিক্ষক নেতা ও বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. কাওছার আলী শেখ (শেখ কাউছার) বরখাস্ত করা হয়েছে। শনিবার (১১ নভেম্বর) তার নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর সবুজ বিদ্যাপীঠ স্কুল এন্ড কলেজ থেকে পাঠানো এক বিবৃতিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়েছে। শিক্ষালয়টির সভাপতি ও স্থানীয় কাউন্সিলর হাজী আবুল কালাম অনু স্বাক্ষরিত ওই বিবৃতিতে ২ কোটি ৮৭ লাখ ৫২ হাজার ৭৩৯ টাকা আত্মসাতের বিষয়টি জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে জানানো হয়েছে, মো. কাওছার আলী শেখ (ইনডেক্স নং ৪৮০) ৩১ মে ২০১২ থেকে ‘সবুজ বিদ্যাপীঠ উচ্চ বিদ্যালয়ে’র প্রধান শিক্ষক হিসেবে দায়িত্ব পালনকালীন সময়ে বিভিন্ন আর্থিক অনিয়মের অভিযোগ উত্থাপিত হলে ২৭ ফেব্রুয়ারি ম্যানেজিং কমিটি ১০নং আলোচ্যসূচিতে প্রতিষ্ঠানের অডিট সম্পন্ন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সে মোতাবেক অডিট সম্পন্ন করার লক্ষ্যে নির্ধারিত ফার্মের অডিট দল আপনার নিকট ২০১৫ সন হতে ২০২০ সন পর্যন্ত সময়ের আর্থিক তথ্য-উপাত্ত চাইলে আপনি অডিট দলকে কোন রকম তথ্য উপাত্ত প্রদান করেননি এবং সহযোগিতা করেননি।
অডিট দলের দাখিলকৃত প্রতিবেদনে ২০১৫ সাল ২০২০ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের আয়ের খাতের দুর্নীতির ১ কোটি ৪২ লাখ ০৭ হাজার ৪৮৯ টাকা প্রতিষ্ঠানের ব্যয়ের খাতের দুর্নীতির ১ কোটি ৪৩ লাখ ৪৭ হাজার ২৫০ টাকা অনিয়মের বিষয়টি প্রমাণিত হয়। এছাড়াও প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে গঠিত তদন্ত কমিটির তদন্ত প্রতিবেদনে এমপিও নাম করে অর্থ আত্মসাৎ এবং ২০২০ সালে শিক্ষকদের প্রভিডেন্ড ফান্ডের ১ লাখ ৯৮ হাজার টাকা আত্মসাতের বিষয়টি প্রমাণিত হওয়ার পরও উপরন্তু ইতঃপূর্বে আপনাকে দুইবার কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হলেও আপনি সন্তোষজনক জবাব প্রদানে ব্যর্থ হয়েছেন।
আমি বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণসহ আন্দোলনে ছিলাম—ফলে উপর মহলের নাখোশও আমাকে সরিয়ে দেবার কারণ হতে পারে। আমি আমার জায়গা থেকে লড়াই চালিয়ে যাবো। আমার বিরুদ্ধে আনীত এসব অভিযোগ আমি প্রমাণ করবো এবং আমি প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপই নেব সত্য প্রমাণের জন্য—শেখ কাউছার।
একইসাথে আর্থিক দুর্নীতি, জাল সনদের মাধ্যমে নিজ আত্মীয়কে নিয়োগ প্রদান, এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়ে আদায়, নারী শিক্ষকদের নিপীড়নসহ প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় না দিয়ে জমি ব্যবসায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে প্রতি দায়িত্বে অবহেলার কারণে ‘স্বীকৃতিপ্রাপ্ত বেসরকারি মাধ্যমিক স্কুল শিক্ষকগণের চাকুরির শর্ত বিধিমালা ১৯৭৯’ এর ১০ অনুযায়ী আপনি মো. কাওছার আলী শেখ-কে সাময়িক বরখাস্ত করা হলো। এছাড়াও ২০১৫ সাল থেকে ২০২০ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে প্রতিষ্ঠানের আয়ের খাতের দুর্নীতির সকল অর্থ প্রতিষ্ঠানের ফান্ডে জমা করার প্রদান করা হলো। অন্যথায় বিধি মোতাবেক আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে বলেও জানানো হয়েছে ওই বিবৃতিতে।
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক মো. কাওছার আলী শেখ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে জানিয়েছেন, আমার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ ভিত্তিহীন, অসত্য এবং উদ্দেশ্য প্রণোদিত। যারা আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ করছেন তারা বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠান থেকে আর্থিক সুবিধা নিয়েছেন এবং নিতে চেয়েছেন। আমার কারণে তারা স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটেছে। ফলে তারা আমাকে সরিয়ে দিতে পারলে প্রতিষ্ঠান থেকে বিভিন্ন ধরনের আর্থিক অবৈধ সুবিধা তারা নিতে পারবেন। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানের সভাপতি বিদ্যালয়ের বিদ্যৎ এবং পানির লাইন তার বাসায় ব্যবহার করছেন। এছাড়াও তিনি পরীক্ষার ফি ২ হাজার টাকা হলেও সেখানে তিনি প্রায় ৮ হাজার টাকা করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নিয়েছেন। তার ভাগ্নে এবং দুই মেয়ের জামাতা অবৈধভাবে ম্যানেজিং কমিটিতে রয়েছেন। এছাড়াও আরও বিভিন্ন অনিয়ম তারা করছে নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করেই।
আর্থিক দুর্নীতি, জাল সনদের মাধ্যমে নিজ আত্মীয়কে নিয়োগ প্রদান, এমপিওভুক্তির আশ্বাস দিয়ে আদায়, নারী শিক্ষকদের নিপীড়নসহ প্রতিষ্ঠানের কাজে সময় না দিয়ে জমি ব্যবসায় নিজেকে ব্যস্ত রাখার মাধ্যমে প্রতি দায়িত্বে অবহেলাসহ বিভিন্ন অভিযোগ এনেছে প্রতিষ্ঠানটি।
আমি বিভিন্ন সময়ে শিক্ষকদের ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণসহ আন্দোলনে ছিলাম—ফলে উপর মহলের নাখোশও আমাকে সরিয়ে দেবার কারণ হতে পারে। আমি আমার জায়গা থেকে লড়াই চালিয়ে যাবো। আমার বিরুদ্ধে আনীত এসব অভিযোগ আমি প্রমাণ করবো এবং আমি প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপই নেব সত্য প্রমাণের জন্য—যুক্ত করেন শেখ কাউছার।
তিনি বলেন, বিদ্যালয়ের হিসাব নিকাশের জন্য তিন ধরনের অডিট করা হয়; প্রথমত অভ্যন্তরীণ নিরীক্ষা, দ্বিতীয়ত প্রতি অর্থ বছর সিএ ফার্ম কর্তৃক নিরীক্ষা এবং প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পরিদর্শন ও নিরীক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক প্রতিবেদন। সর্বশেষ বিদ্যালয়টিতে ২০২১ সাল পর্যন্ত কোন প্রকার অভিযোগ ছাড়াই পরিদর্শন রিপোর্ট রয়েছে। সুতরাং বর্তমান কমিটি কর্তৃক উত্থাপিত আর্থিক বিষয়টি সম্পূর্ণ উদ্দেশ্যে প্রণোদিত।
আর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটির সভাপতি ও স্থানীয় কাউন্সিলর হাজী আবুল কালাম অনু বলছেন, তিনি বিভিন্ন সময়ে প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ আত্মসাৎ করেছেন এবং এর পরিমাণ প্রায় তিন কোটি টাকা। আমরা এ নিয়ে অডিট করার সময় তার কাছে হিসেব চেয়েছি এবং তার সহযোগিতা চেয়েছি; তিনি আমাদের যৌক্তিক কোনো হিসেব বা জবাব দিতে পারেননি। ফলে আমরা তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দিয়েছি। এছাড়া তিনি আমার বিরুদ্ধে যে-সব অভিযোগ করছেন তা সত্য নয় বলেও জানান তিনি।
এর আগে চলতি বছরের ১১ জুলাই থেকে বেসরকারি মাধ্যমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ দাবিতে স্কুলে তালা ঝুলিয়ে জাতীয় প্রেস ক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন এমপিও শিক্ষকরা। এতে নেতৃত্ব দেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির (বিটিএ) সভাপতি অধ্যক্ষ বজলুর রহমান মিয়া ও সাধারণ সম্পাদক শেখ কাওছার আহমেদ।
টানা ২৩ দিন জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচির পর গত ১ আগস্ট রাতে শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী ও সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব কবির বিন আনোয়ারের সঙ্গে বৈঠক করেন তারা। বৈঠকে শিক্ষকদের জাতীয়করণ বা বৈষম্য নিরসনের আশ্বাসে অনশন স্থগিত করে ক্লাসে ফেরার ঘোষণা দেন শিক্ষক নেতারা। আন্দোলন চলাকালে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষক নেতারা নানাভাবে সরকারের রোষানলে পড়েন।