৩০ আগস্ট ২০২২, ০০:৫২

কুমিল্লার সেই মোশন গ্রাফিক ডিজাইনার এখন কাজ করছেন হলিউডে

জিসান কামরুল হাসান  © সংগৃহীত

বাণিজ্যিক সিনেমার জন্য বিখ্যাত হলিউড ইন্ডাস্ট্রিতে কাজের ক্ষেত্রে গুণমান এবং প্রযুক্তিগত দক্ষতার সঙ্গে কোনোরকম আপস গ্রহণযোগ্য না। সেই হলিউডে যেকোনো ভূমিকায় কাজের স্বপ্ন কমবেশি অনেকেরই থাকে। ছিল কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার জিসান কামরুল হাসানেরও। সেই স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে নিরলস প্রচেষ্টা আর পরিশ্রম এই তরুণকে বাংলাদেশ থেকে পৌঁছে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার কালভার সিটিতে।

থ্রিডি অ্যানিমেশন এবং মোশন গ্রাফিক্স নিয়ে কাজের আগ্রহ এবং অনুশীলন করা জিসান কামরুল হাসান শিক্ষাজীবনে আহসানউল্লাহ ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করেন।

বিখ্যাত মেট্রো-গোল্ডউইন-মেয়ার স্টুডিওর ঘরখ্যাত কালভার সিটি চলচ্চিত্র এবং টিভি সিরিজ প্রযোজনার জন্য বিখ্যাত। ক্যালিফোর্নিয়ার কালভার সিটি হলিউডের আঁতুড়ঘর হিসেবেও সমধিক পরিচিত। এই তরুণ বাংলাদেশি মোশন গ্রাফিক ডিজাইনারের যাত্রার কথা বলতে গেলে, সম্প্রতি সমালোচকদের প্রশংসিত “লাস্ট নাইট ইন সোহো”, জনপ্রিয় কিছু সিনেমা এবং সিরিজের টিজার ও ট্রেলার থেকে মার্ভেলের “ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অব ম্যাডনেস”-এ কাজ করার কথা উল্লেখ করা যেতে পারে।

নিজের হলিউড যাত্রার কথার জানিয়ে জিসান কামরুল হাসান বলেন, আমার হলিউড যাত্রার শুরু সেই ২০০২ সালে। সে বছর দ্য লর্ড অব দ্য রিংস চলচ্চিত্রের জাঁকজমকপূর্ণ দৃশ্য দেখে হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম। সিনেমাটির বিভিন্ন দৃশ্যে মোশন গ্রাফিক্সের কাজ দেখে আশ্চর্য হয়ে এটি শেখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিই।

২০০২ সালেই মোশন গ্রাফিক্সের কাজ শেখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিলেও ২০০৭ সালের আগে নিজের একটি ব্যক্তিগত কম্পিউটার (পিসি) পেতে ২০০৭ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়েছিল জিসানকে। এ প্রসঙ্গে জিসান বলেন, এরপর থেকে জীবনের চাকা দ্রুতগতিতে ঘোরা শুরু করে। ২০০৮ সালে আমি ঢাকায় চলে আসি এবং ইউটিউবের মাধ্যমে ফটোশপের কাজ শিখতে শুরু করি।

জিসান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময়েই গ্রাফিক ডিজাইন এবং ফটোগ্রাফির মাধ্যমে আমি উপার্জন করতাম। ২০১২ সালে আমার এক সিনিয়র মেস রুমমেট আমাকে জিজ্ঞেস করে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে তার ব্যবসার জন্য আমি কাজ করতে আগ্রহী কি-না। এভাবেই মোশন ডিজাইনার হিসেবে আমার যাত্রা শুরু হয়েছিল।

তিনি আরও বলেন, ২০১৩ সালে আমি আমার নিজস্ব ক্যামেরা কিনে একজন ফ্রিল্যান্সার হিসাবে ফটোগ্রাফি শুরু করি। চলচ্চিত্র নির্মাতা হওয়ার স্বপ্ন চোখে নিয়ে আমি কয়েকটি শর্টফিল্ম নির্মাণের পাশাপাশি ওয়েডিং ফটোগ্রাফিও করেছি। সেই সঙ্গে কিছু সৃজনশীল এবং প্রতিভাবান বন্ধুও জুটেছিল আমার।  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলায় ছবির হাটে আমার নিয়মিত এবং ঘন ঘন যাতায়াত ছিল।

জিসান কামরুল হাসান ২০১৬ সালে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে চলে যান। যেখানে তিনি কাজী শামসুল হক নামের এক প্রবাসী সাংবাদিকের সৌজন্যে একটি পত্রিকায় গ্রাফিক ডিজাইনার হিসেবে কাজ শুরু করেন। পেশাগতভাবে কাজে তেমন জ্ঞান না থাকায় এখান থেকেই জিসানের সংগ্রাম শুরু হয়।

জিসান বলেন, “২০১৭ সালে আমি লস অ্যাঞ্জেলেসে চলে আসি। সম্পূর্ণ নতুন এবং বড় একটি শহরে অজস্র বাধার মুখোমুখি হয়ে আমাকে টিকে থাকতে হয়েছিল। এরপর এক সময় করোনাভাইরাস মহামারি আঘাত হানে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম সইবকিছুকে একপাশে রেখে স্বপ্নপূরণের লক্ষ্যে চেষ্টা করার জন্য এটিই সেরা সুযোগ।”

লাকসাম থেকে আগত এক যুবকের জন্য সেটি ছিল বাঁচা-মরার লড়াই। তাই নিজের সবকিছু দিয়েই সে প্রচেষ্টা শুরু করেছিল। সেই অভিজ্ঞতার কথা স্মরণ করে জিসান বলেন, “আমি চাকরি ছেড়ে ভিডিও টিউটোরিয়াল থেকে মোশন গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখতে শুরু করি। পাশাপাশি বিভিন্ন বই এবং নিবন্ধ পড়ার মাধ্যমে চলচ্চিত্রের গ্রাফিক্সে প্রয়োজনীয় নতুন সফটওয়্যার যেমন আফটার ইফেক্টস, সিনেমা ফোরডি, হাউডিনি এবং নিউকের কাজ শিখতে শুরু করি।”

তিনি আরও বলেন, “এসব জিনিসের জন্য আমাকে প্রতিদিন ১৫ থেকে ১৮ ঘণ্টা ব্যয় করতে হতো। ২০২০ সালের মার্চ থেকে ওই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত এটাই ছিল আমার রুটিন। নতুন হিসেবে কাজটা কঠিন হলেও রাতের ঘুম এবং অন্যান্য বিলাসিতাকে বিসর্জন দিয়ে আমি লেগে ছিলাম।”

এরপরে তিনি ২০২১ সালের জানুয়ারি থেকে ওই বছরের মে মাস পর্যন্ত নিজের শো রিল প্রস্তুত করেন।  গত বছরের জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত তিনি একটি ছোট বিরতি নেন। দীর্ঘ পাঁচ বছর দূরে থাকার পর ২০২১ সালে নিজের পরিবারের সঙ্গে ঈদ-উল-আযহার ছুটি কাটাতে তিনি বাংলাদেশে আসেন।

আগস্ট মাসে জিসান আবার লস অ্যাঞ্জেলেসে ফিরে যান এবং মোশন গ্রাফিক্স ডিজাইনার হিসেবে বিভিন্ন চাকরির জন্য আবেদন করা শুরু করেন। জিসান প্রতিদিন ৩০-৪০টি প্রযোজনা সংস্থার কাছে নিজের তৈরি শোরিল বা পোর্টফোলিও পাঠাতেন। তবে প্রথম কয়েক মাসে কোনো প্রযোজনা সংস্থার কাছ থেকে সাড়া পাননি জিসান।

ওই সময়ের স্মৃতিচারণা করে জিসান বলেন,  “ব্যক্তিগতভাবে অনেক পরিচালক এবং প্রযোজকদের কাছে নিজের তৈরি শোরিল বা পোর্টফোলিও পাঠানোর পরেও দুর্ভাগ্যবশত ইন্টারভিউয়ের জন্য আমি তেমন ডাক পাচ্ছিলাম না। অবশেষে তিন মাস পর আমার বর্তমান নিয়োগকর্তা ওয়াইল্ড কার্ড ক্রিয়েটিভ, আমার সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং আমাকে চাকরির জন্য নির্বাচন করে। ২০২১ সালের নভেম্বরে আমি এখানে যোগদান করি।”

এভাবেই জিসানের সামনে হলিউডে কাজ করার দরজা খুলে যায়। লাস্ট নাইট ইন সোহো চলচ্চিত্রের জন্য প্রথমবারের মতো কোনো হলিউড সিনেমার ট্রেইলার নিয়ে কাজ করার সুযোগ পান জিসান। যদিও হাউস অফ গুচি"-এর জন্য তৈরি করা একটি ভিডিও ক্লিপকে নিজের প্রথম উল্লেখযোগ্য কাজ হিসেবে দাবি করেন। অবশেষে তিনি একে একে দ্য ব্যাটম্যান, মরবিয়াস, ডক্টর স্ট্রেঞ্জ ইন দ্য মাল্টিভার্স অফ ম্যাডনেস এবং কিংবদন্তি পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গের ওয়েস্ট সাইড স্টোরির ২০২১ সালের রিমেকের প্রচারমূলক ট্রেলার এবং টিজারে কাজ করার সুযোগ পান।

এ সিনেমাগুলি ছাড়াও বশ: লিগ্যাসি, তেহরান (সিজন ২), দ্য কার্দাশিয়ানসসহ বেশ কয়েকটি টেলিভিশন ডকুমেন্ট্রি এবং সিরিজেও জিসান কাজ করেছেন।

নিজের কাজের সঙ্গে সঙ্গে ইন্ডাস্ট্রি এবং ট্রেইলারের বাজারের কথা জানিয়ে জিসান বলেন, “আমরা টিজার এবং ট্রেলার তৈরি করেছি যা ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব এবং স্ন্যাপচ্যাটসহ থিয়েটার এবং টেলিভিশনের জন্য তৈরি করা হয়। টিজার-ট্রেলার হলো দর্শকদের কাছে সিনেমা বা টিভি সিরিজটি পৌঁছানোর প্রথম মাধ্যম। আমরা দুই ধরনের ট্রেইলার তৈরি করি- একটি মার্কিন দর্শকদের জন্য এবং অন্য সংস্করণটি আন্তর্জাতিক দর্শকদের জন্য। সব ক্ষেত্রেই ট্রেইলারের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।

বাংলাদেশের প্রযুক্তিগত সীমাবদ্ধতা এবং যুক্তরাষ্ট্রে পাওয়া  প্রযুক্তিগত সুবিধার কথা জিজ্ঞেসে করলে জিসান বলেন, “আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রযুক্তিকে বাধা বলে মনে করি না। কারণ বাংলাদেশেও একই ধরণের বা কাছাকাছি যন্ত্রপাতি রয়েছে। এখানে সফলতা পাওয়ার জন্য উত্সর্গ এবং কঠোর পরিশ্রম সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। 

দেশের মুক্তিযুদ্ধের ওপর চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্নের কথা জানিয়ে জিসান বলেন, এই পেশার জন্য আমি দিনরাত পরিশ্রম করেছি। তাই আমি এ কাজ ছাড়ব না। আমাদের গৌরবোজ্জ্বল মুক্তিযুদ্ধের ওপর ভিত্তি করে আমার একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের স্বপ্ন রয়েছে। গল্প উপস্থাপনের যথাযথ সৃজনশীল স্বাধীনতা এবং পর্যাপ্ত বাজেট পেলেই এটি সম্ভব হবে।

তিনি আরও বলেন, ৩২ বছর বয়সে এসে আমি আমার বাকি জীবনের জন্য কী করতে চাই, তা অবশেষে বুঝতে পেরেছিলাম। সামনের দিনগুলোতে আমি নিজেকে একজন সফল শিল্প পরিচালক হিসেবে দেখতে চাই।