চাকরি সামলে ৩ প্রিলি জয় রাসেলের, ৪০তমে হলেন প্রশাসন ক্যাডার

চাকরি সামলে ৩ প্রিলি জয় রাসেলের, ৪০তমে হলেন প্রশাসন ক্যাডার
চাকরি সামলে ৩ প্রিলি জয় রাসেলের, ৪০তমে হলেন প্রশাসন ক্যাডার  © টিডিসি ফটো

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স ডিসিপ্লিনের ২০১৩-১৪ সেশনের (১৪) ব্যাচের শিক্ষার্থী রাসেল মুন্সী ৪০তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশ প্রাপ্ত হয়েছেন। বিসিএস প্রশাসনে মেধা তালিকায় ১১৩তম হয়েছেন তিনি। পছন্দের ক্যাডারের তালিকায় ছিল প্রশাসন, পুলিশ, ইকনমিক, কাস্টমস। তার বাড়ি খুলনার দৌলতপুরে।

বর্তমানে তিনি খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকশন অফিসার (গ্রেড-২) পদে কর্মরত রয়েছে। সম্প্রতি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে রাসেল নিজের জীবনের সফলতার গল্প শুনিয়েছেন। তার কথাগুলো শুনেছেন খুলনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি শরিফুল ইসলাম

ছোটবেলায় ক্রিকেট ও ফুটবল খেলার প্রতি অত্যন্ত ঝোঁক ছিল রাসেলের। সবসময় মনটা খেলার মাঠে যাওয়ার জন্য আনচান করত। বিশেষ করে টেলিভিশনে সম্প্রচার হওয়া কোনো ক্রিকেট খেলায় মিস করতেন না। শচীন টেন্ডুলকার ছিলো তার প্রিয় ক্রিকেটার। তখন তাদের টেলিভিশন ছিলো না, শচীনের খেলা দেখার জন্য তিনি ছুটে যেতেন অন্যদের বাড়িতে। তার মা তার প্রতি বিরক্ত হয়ে বলতেন, ‘তুই কি শচীন টেন্ডুলকার হতে পারবি, মেসি হতে পারবি? যদি না হতে পারিস তাহলে মন দিয়ে পড়াশোনা কর।’

উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে রাসেল খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন। ১ম বর্ষে পড়ার সময় সমাজের অসহায়-দরিদ্র মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর প্রয়াসে ২০১৫ সালের ১৫ জানুয়ারি ‘চিরন্তন’ নামক একটি সামাজিক সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন তিনি।

রাসেল বলেন, ‘‘আপনার দৈনিক দানকৃত মাত্র ১ টাকায় পারে অসহায়দের মুখে হাসি ফোটাতে’’- এই ভাবনা মাথায় রেখেই আমরা চিরন্তনের সদস্যদের কাছ থেকে ১ টাকা সংগ্রহের মাধ্যমে তহবিল গঠন করে ২০১৫ সাল থেকে আজ অবধি মানুষের কল্যাণে চিরন্তনের সদস্যরা কাজ করছে। সংগঠনে সময় দেওয়ার পাশাপাশি আমার পরিবারকে সাপোর্ট দেওয়ার জন্য প্রচুর স্টুডেন্ট পড়িয়েছি। অনার্স পাশ করার পর আমি ‘‘চিরন্তন জব এইড’’ নামে একটি চাকরির কোচিং পরিচালনা করতাম। ছাত্রজীবনে এই স্টুডেন্ট পড়ানো আমার চাকরির প্রস্তুতিতে অনেক বেশি সহায়তা করেছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময় থেকেই বিসিএসের জন্য ধীরে ধীরে প্রস্তুতি শুরু করেন রাসেল। তিনি বলেন,  পত্রিকা ও ফেসবুকে বিভিন্ন বিসিএস ক্যাডারদের লেখা পড়তাম আর নিজের প্রস্তুতি কৌশল সাজানোর চেষ্টা করতাম। অনার্সের শেষের দিকে এসে ওরাকলে ভর্তি হই এবং বিসিএস সিলেবাস অনুসরণ করে প্রস্তুতি নিতে থাকি।

রাসেল বলেন, ৪০তম বিসিএসের প্রিলিমিনারি ও আমার মাস্টার্স ১ম টার্মের পরীক্ষা একইসময়ে পড়ছিল। অনেক চাপের মধ্যেই বিসিএস প্রিলিমিনারিতে অংশগ্রহণ করি এবং আলহামদুলিল্লাহ সফল হই। প্রিলিমিনারি প্রস্তুতির সময় আমি সবসময় চেষ্টা করতাম ট্রেনের লাস্ট বগিটা ধরতে, কারণ প্রিলিমিনারিতে পাশ করতে পারলেই হলো সর্বোচ্চ মার্ক পাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই।

‘‘শেষ সময়ে আমি অনেকগুলো মডেল টেস্ট পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করি। পরীক্ষা শেষে সবসময় আমার প্রাপ্ত নম্বর আ্যনালাইসিস করে দুর্বলতা খুঁজে বের করে সেখানে পরিমিত সময় দেওয়ার চেষ্টা করতাম। এভাবে পড়াশোনা করেই আলহামদুলিল্লাহ পরপর ৩টি বিসিএস ৪০, ৪১ ও ৪৩ এর প্রিলিমিনারি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হই।’’

৪০তম বিসিএসের লিখিত পরীক্ষার আগে প্রায় ৭ মাস সময় পেয়েছিলেন রাসেল। তিনি বলেন, এ সময়ে সিলেবাস অনুসরণ করে প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করি। কিন্তু লিখিত পরীক্ষার বিশাল সিলেবাসের কিছুই যেন শেষ হচ্ছিল না। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক বিষয়াবলির জন্য পত্রিকা থেকে গুরুত্বপূর্ন টপিক নোট করার চেষ্টা করতাম। ইংরেজির জন্য তেমন কিছু পড়া লাগেনি তবে অনুবাদ প্রাকটিস করতাম।

তিনি বলেন, বিজ্ঞানের বিশাল সিলেবাসের মধ্যে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিজে সাজশন করে পড়ার চেষ্টা করতাম। বাংলায় ব্যাকরণ ও সাহিত্য অংশ গুরুত্ব দিয়ে পড়েছি। গণিত লিখিত সিলেবাস অনুসরণ করে প্রাকটিস করেছি। আর মানসিক দক্ষতার জন্য প্রিলির প্রস্তুতির পরে নতুন করে আর দেখার সুযোগ হয়নি। হঠাৎ মাত্র ২৩ দিন আগে আমাদের লিখিত পরীক্ষার তারিখ ঘোষণা হয়। পরীক্ষার সিডিউল ঘোষণার পর থেকে সবকিছু বাদ দিয়ে শুধু পড়াশোনার চেষ্টা করি।

লিখিত পরীক্ষার পরপরই ভাইভার প্রস্তুতি শুরু করেন তিনি। ভাইভার অভিজ্ঞতা নিয়ে রাসেল বলেন, নিজ সাবজেক্ট, নিজের জেলা, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, বাংলাদেশের সংবিধান, বর্তমান সরকারের কার্যক্রম, পত্রিকায় সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনাবলি গুরুত্ব দিয়ে পড়ার চেষ্টা করতাম। এর পাশাপাশি কয়েকটা মডেল ভাইভায় অংশগ্রহণ করে নিজেকে আরো শাণিত করে তোলার চেষ্টা করেছি।

আরও পড়ুন: স্ত্রী বলল, আমি পুলিশ ক্যাডারে প্রথম হয়েছি

এ যাত্রায় অনেক শ্রম দিতে হয়েছে রাসেলকে। তিনি বলেন, কষ্টের অনেক স্মৃতি রয়েছে। সেই স্মৃতিগুলো থেকে প্রতিনিয়ত শিক্ষা নিয়ে এবং নিজেকে গঠন করার চেষ্টা করেছি।

চাকরির সঙ্গে বিসিএসের প্রস্তুতির অভিজ্ঞতা কেমন ছিল

চাকরি থেকে বিসিএসসের পড়াশোনা করতে একটু সমস্যা হয়। চাকরি পাওয়ার আগে যখন সবসময়ই পড়ার সুযোগ পেয়েছি; কিন্তু চাকরি পাওয়ার পরে তেমন সুযোগ হয়নি। তবে অফিসে কাজের ফাঁকে ফাঁকে আমি পড়ার চেষ্টা করেছি এবং আমার কলিগরা এক্ষেত্রে আমাকে খুব সাপোর্ট দিয়েছেন। তাদের সকলের প্রতি আমি কৃতজ্ঞতা জানাই।

সফলতায় যাদের অবদান

আমার সফলতার পেছনে সবচেয়ে বেশি অবদান আমার আম্মুর। আমার মা জীবনভর অনেক সংগ্রাম করে আমাকে আজকের অবস্থানে এনেছেন। আমার আব্বুও আমার সফলতার জন্য অনেক কষ্ট করেছেন। আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষকরা আমার শিক্ষার ভিত্তিটা অনেক মজবুত করে গড়ে তুলতে সহায়তা করেছেন যা আমাকে প্রথম বিসিএস এই প্রশাসন ক্যাডার উপহার দিয়েছে।

আমার স্ত্রী সর্বদা আমাকে মানসিক সাপোর্ট দিয়ে নানা সংগ্রামের মধ্যে টিকে থাকতে সহায়তা করেছে। এছাড়াও আমার সহপাঠী, বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীরা সবাই আমার জন্য অনেক বেশি দোয়া করেছে। আমি তাদের সকলের প্রতি কৃতজ্ঞ।

নতুনদের জন্য পরামর্শ

জীবনটা সংগ্রামের, উত্থান পতন জীবনেরই অংশ। এতে ভেঙে পড়লে চলবে না। মহাপবিত্র আল কুরআনে বলা হয়েছে, ‘‘কষ্টের পরেই স্বস্তি আছে।’’ আমাদের ধৈর্য ধরে লেগে থাকতে হবে। পরিকল্পনামাফিক পড়াশোনা করতে পারলে অচিরেই ঘোর অমানিশা দূরীভূত হয়ে সোনালী সূর্যের দেখা মিলবেই। সকলের জন্য অনেক অনেক শুভকামনা রইলো।