উচ্চ বেতনের চাকরি ছেড়ে বিসিএস প্রস্তুতি, ম্যাজিস্ট্রেট হলেন নওশীন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অর্থনীতি বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী নুসরাত নওশীন। স্নাতকোত্তরের পরীক্ষা শেষে ৩৭তম বিসিএসে প্রথম অংশগ্রহণ করেন তিনি। ওই সময় ৪৫ দিনের টানা প্রিপারেশন নিয়ে প্রিলিতে পাশ করলেও স্বপ্ন পূরণ হয়নি। ততদিনে দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার (এমটিও) হিসেবে যোগদান করেন নুসরাত নওশীন।
এরপর ৩৮তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষা তার আর দেওয়া হয়নি। ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে উচ্চ বেতনের ব্যাংকের এই চাকরি ছেড়ে শুরু করেন ৪০তম বিসিএসের প্রস্তুতি। এই বিসিএসের চূড়ান্ত ফলে প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি, মেধাক্রম-৬৪। বিসিএসের চার বছরের জার্নির গল্প তুলে ধরছেন নুসরাত নওশীন নিজেই—
৪০তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফল বের হওয়ার পর থেকে অনেক শুভানুধ্যায়ীরা আমার কাছে অনুরোধ জানিয়েছেন আমার বিসিএস জার্নি শেয়ার করার জন্য। তাদের জন্য এই লেখা। যথাসম্ভব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করবো। চার বছরের জার্নি যদিও খুব ছোট নয়।
আমি প্রথম বিসিএস এর প্রিপারেশন নেয়া শুরু করি আমার মাস্টার্স পরীক্ষার পরে, ৩৭তম বিসিএস এর জন্য। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বিসিএস এর ধারেকাছেও ঘেঁষিনি। যেদিন সিদ্ধান্ত নিলাম সিরিয়াসলি এবার পড়াশোনা শুরু করবো, সেদিন দুপুর বেলা প্রিলিমিনারির তারিখ দিল! মাত্র দেড় মাস সময় ছিল হাতে। আমি আর আমার বেস্টফ্রেন্ড (বর্তমান বর) একসাথে প্রিপারেশন নেওয়া শুরু করি।
৪৫ দিনের টানা প্রিপারেশনে প্রিলি দেই এবং পাশ করি। রিটেন পরীক্ষার সময় হাতে ছিল মাত্র আড়াই মাস। আবারও দুজন একসাথে গ্রুপ স্টাডি করে পড়া শুরু করি। প্রিপারেশন খুব যে খারাপ নিয়েছিলাম তাও না। কিন্তু ঐ যে, ভাগ্য বলে একটা কথা আছে তো। বাংলাদেশ বিষয়াবলী পরীক্ষাটা ছিল পহেলা বসন্তের দিনে। প্রচন্ড জ্যাম ঠেলে যখন সেন্টারে গিয়ে পৌছাই তখন পরীক্ষা ১ ঘণ্টা শেষ! ১১টার সময় হলের গেটের সামনে ফুটপাতে বসে রাস্তাভর্তি লোকের সামনে পাগলের মত চিৎকার করে কাঁদতে দেখে সেন্টার থেকে পুলিশ এসে আমাকে অবশেষে গেটের ভিতরে ঢুঁকতে দেয়। কিন্তু তাও লাভ হলো না।
মানসিক আর শারীরিক সেই ধাক্কায় ৪ ঘণ্টার পরীক্ষা ২.৩০ ঘণ্টাতে দিয়ে ২০ মার্কস উত্তর করতে পারিনি, যা উত্তর করেছিলাম তাও ধর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। ঐদিনই বুঝে গিয়েছিলাম বিসিএস এর আশা এবারের মত ছাড়তে হবে। ৩৭তম সেই বিসিএসে আমার প্রথম শ্রেণির নন ক্যাডার আসে। আর আমার বর পররাষ্ট্র ক্যাডারে মেধা তালিকায় ৭ম স্থান লাভ করে। পরবর্তীতে যদিও সে ফরেন সার্ভিসে যোগদান করেনি। বর্তমানে সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ইনফরম্যাশন সিস্টেম বিভাগের (এমআইএস) সহকারী অধ্যাপক।
৩৭তম এর অভিজ্ঞতার পর বিসিএস থেকে মন উঠে গিয়েছিল একদম। ততদিনে আমি দেশের একটি শীর্ষস্থানীয় বেসরকারি ব্যাংকে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি অফিসার হিসেবে কর্মরত। এর মাঝে আমাদের বিয়ে হলো। ৩৮তম বিসিএস আমার আর দেওয়াই হল না।
আমার পোস্টিং ছিল হেড অফিসে পলিসি ডেভেলপমেন্ট ডিপার্টমেন্টে। একদিন অফিসে কাজ করতে গিয়ে হঠাৎ মনে হল, আমি একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পলিসি নিয়ে কেন কাজ করছি। পলিসি মেকিং নিয়েই যদি কাজ করি, আমি ন্যাশনাল পলিসি নিয়ে কাজ করবো। সেদিন সিদ্ধান্ত নিলাম, আর একটা বার চেষ্টা করবো। দেখি এবার ভাগ্য কোথায় নিয়ে যায়। ব্যস। তার ঠিক এক সপ্তাহের মাথায় হাই স্যালারির চাকচিক্যময় চাকরিটা ছেড়ে দিয়ে চলে আসলাম। তখন ২০১৮ সালের নভেম্বর মাস।
এরপরের গল্প দীর্ঘ এক যাত্রার গল্প। আবার সেই প্রিলিমিনারি, সেই রিটেন, সেই ভাইবা। এবার পড়াশোনা করেছি একা। বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রী হওয়াতে ম্যাথ আর বিজ্ঞানের বেসিক বরাবর ভালোই ছিল। আর ছোটবেলা থেকেই বাংলা আর ইংরেজিতে ছিল আমার শিক্ষক মায়ের দেয়া শক্ত হাতেখড়ি। রিটেনে আন্তর্জাতিক বিষয়াবলিতে আমার বেশ দুর্বলতা ছিল, আমার বর পুরোটা আমাকে গাইড করেছিল এ ব্যাপারে।
ও যেভাবে লিখতে বলেছিল পরীক্ষার খাতায় সেভাবেই প্রেজেন্ট করেছি। সংবিধান ঝেড়ে গিয়েছিলাম বাংলাদেশ বিষয়াবলীর জন্য। সংবিধানের অনুচ্ছেদগুলো আলাদা নীল কালি দিয়ে লিখেছি। ম্যাপ-ডাটা-চার্ট নিয়ে কোন বাড়াবাড়ি করিনি। বাংলা-ইংরেজি রচনা সম্পূর্ণ নিজের ভাষায় নিজের মত করে লিখেছি, কোন নোট করিনি। পরীক্ষার হলে এত লেখার সময় থাকে না আসলে। অপ্রাসঙ্গিক কথাবার্তা লিখে অযথা উত্তর বড় করিনি। চেষ্টা করেছি পরীক্ষার খাতা একদম নিট এন্ড ক্লিন রাখতে, কোন কাটাকাটি ছাড়া।
৪০তম বিসিএসসের রেজাল্ট যেদিন হয় সেদিন আমার বাবা ক্রিটিক্যাল অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি। সকাল থেকে অফিস থেকে ছুটি নিয়ে হাসপাতালে আব্বুর পাশে বসে ছিলাম (বিসিএস ভাইভার পরে আমি বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে সহকারী পরিচালক হিসেবে যোগদান করি)। এর মধ্যেই আমার বর ফোন করে প্রথম রেজাল্টটা দিল। ও কাঁদছিল। আমার পুরোটা জার্নি, আমার ডেডিকেশন, স্ট্রাগল সবচেয়ে কাছ থেকে সেই তো দেখেছে। ছায়ার মত আমার পাশে ছিল সে পুরোটা সময়।
এই রেজাল্টের সময় আমি আল্লাহকে একবারও বলিনি, আল্লাহ আমাকে অমুক ক্যাডার দিও। শুধু একটা কথাই বলেছি, আল্লাহ আমাকে একটা হালাল এবং আমার পরিবারের জন্য সর্বোত্তম কল্যাণকর রিজিক দান করো, যে রিজিক দিয়ে আমি আমার মা-বাবার সেবা করতে পারবো। নিশ্চয়ই তুমি অন্তর্যামী, সর্বোজ্ঞ। আল্লাহ তাঁর বান্দাকে নিরাশ করেন নাই। আলহামদুলিল্লাহ।
শেষ কথা— বিসিএস পুরোটাই মানসিক শক্তির খেলা। স্ট্র্যাটেজি সেট করে পড়তে পারলে, পরীক্ষার হলে মাথা ঠান্ডা রাখতে পারলে আর সাথে আল্লাহর রহমত এবং মা-বাবার দোয়া থাকলে কোন কিছুই অসম্ভব না।
তবে বিসিএস দিনশেষে একটা সরকারি চাকরি। এখানে অন্যান্য পেশার চেয়ে মানুষের জন্য সরাসরি কিছু করার সুযোগটা বেশি, তাই এক্সপোজার একটু বেশি। তাই বলে বিসিএসকে ক্রেজ বানিয়ে অন্ধের মত ছোটাও কোন কাজের কথা না। এটা খুবই রিস্কি গেইম, এজন্য সবসময় হাতে প্ল্যান বি রেডি থাকাটা জরুরি। বিসিএস ছাড়া জীবনে করার এবং দেশকে দেয়ার অনেক কিছু আছে। সবার জন্য অনেক শুভকামনা।
লেখক: সহকারী কমিশনার এবং নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (সুপারিশপ্রাপ্ত)
৪০তম বিসিএস (প্রশাসন) ক্যাডার
মেধাক্রম- ৬৪