শরণার্থী শিবির থেকে আরব আইডল হলেন যে ফিলিস্তিনি
মোহাম্মদ আসাফ। দ্বিতীয় আরব আইডল। আসাফকে আরব বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় তরুণ সংগীত তারকা বললেও মনে হয় ভুল হবে না। তবে আরবের বাইরেও জনপ্রিয় হয়ে উঠছেন তিনি। শুধু ফেইসবুকেই আসাফকে ফলো করছেন ১৩ মিলিয়ন মানুষ।
ফিলিস্তিনি এ পপ শিল্পীর জন্ম ১৯৮৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর লিবিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম শহর মিসরাতায়। চার বছর বয়সে বাবা-মায়ের সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে আসেন এবং বেড়ে উঠেন খান ইউনিসের একটি শরণার্থী শিবিরে।
শিশুকালেই আসাফের সংগীতের হাতেখড়ি হয় বলে জানিয়েছেন তার মা ইনতিসার। তিনি বলেন, পাঁচ বছর বয়স থেকেই গান গাওয়া শুরু করেছিলেন আসাফ। তবে তখন তার কণ্ঠ কিছুটা বয়স্ক লোকদের মতো শোনাতো।
শৈশবে কিংবা কৈশরে গানের প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ নেয়া আসাফের পক্ষে সম্ভব হয়নি। বিয়ের অনুষ্ঠানসহ ছোট-খাটো বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান গেয়েই ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন মোহাম্মাদ আসাফ।
তবে টেলিভিশনের পর্দায় যাওয়ার আগে আসাফ ফিলিস্তিনের গাজা নগরীতে অবস্থিত ফিলিস্তিন বিশ্ববিদ্যালয়ে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগে পড়াশোনা করেন।
এরপর ২০০০ সালে ফিলিস্তিনের একটি আঞ্চলিক টেলিভিশনে ডাক পান আসাফ— যেখানে একটি দেশের গান গেয়ে সবার নজরে আসেন তিনি। ডাক পেয়ে যান স্থানীয় একটি রেকর্ডিং কোম্পানিতে।
কিছু দিন পর বৃহৎ পরিসরে একটি অনুষ্ঠানে সংগীত পরিবেশন করে তৎকালীন ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াসির আরাফাতের নজরে আসেন আসাফ। ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন ইয়াসির আরাফাত। এরপরই জনপ্রিয় হয়ে উঠেন আসাফ।
২০১৩ সালটা আসাফের জন্য ছিল বেশ চ্যালেঞ্জিং। সে বছর ৮ মার্চ থেকে মিশরে শুরু হওয়ার কথা ছিল ‘আরব আইডল’ এর দ্বিতীয় আসর। ২০১১ সালে হওয়া প্রথম আরব আইডলে লড়তে পারেনি আসাফ। তাই দ্বিতীয় আসরে লড়তে মনস্থির করেন তিনি। তবে যাত্রাটা সহজ ছিল না। কারণ, প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে তাকে যেতে হবে মিশরে। ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা নগরী থেকে মিশরে প্রবেশ করা ছিল অনেক কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তাই আরব আইডল হওয়ার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হওয়ার আগে আসাফকে সম্মুখীন হতে হয় আরেকটি যুদ্ধের।
অবরুদ্ধ গাজা থেকে মিশরে পৌঁছা ছিল তার জন্য ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। প্রথমেই মিশর-ফিলিস্তিন সীমান্তে যাত্রা থামে আসাফের। সেখানে দুই দিন অবস্থান করে নিজেকে মিশরের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর কাছে ইতিবাচক হিসেবে উপস্থাপন করতে পেরে ছাড়পত্র পান সীমান্ত থেকে। এই ঝামেলা শেষে যখন কায়রো পৌঁছান ততক্ষণে অডিশনের দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তাকে বলা হয় যে, আর নতুন প্রতিযোগী নেয়া হবে না।
কোনো উপায় না পেয়ে শেষ আশাটুকু নিয়ে আসাফ দেয়াল টপকিয়ে কোনোমতে প্রতিযোগীদের রুমে ঢুকে যান। সেখানে ঢুকে দেখেন যে প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গিয়েছে। এবার আশাহত হন আসাফ। মেঝেতে বসে পড়ে মনের কষ্ট নিয়ে নিজে নিজেই গান শুরু করেন তিনি। এ সময় রামাদান আবু নাহেল নামে এক প্রতিযোগীর কানে পৌঁছায় আসাফের গান। তিনি আসাফের কাছে আসেন এবং নিজের প্রতিযোগিতার কার্ডটি আসাফকে দিয়ে বলেন, ‘আমি জানি, আমি পারব না। কিন্তু তুমি পারবে।’
অবশেষে আবু নাহেলের কার্ডে প্রতিযোগিতায় অংশ নেন আসাফ। কণ্ঠ দিয়ে মুগ্ধ করতে সক্ষম হন বিচারক এবং শ্রোতাদের। আসাফ ফাইনাল রাউন্ডে উত্তীর্ণ হন। আসাফ গানের সুরে দর্শক হারিয়ে দিতেন ভিন্ন জগতে। মুগ্ধ হয়ে আসাফকে ‘আসারুখ’ (দ্যা রকেট) উপাধি দেন আরব আইডলের বিচারক, লেবানিজ শিল্পী রাগিব আলামা।
আসাফের ফাইনাল পরিবেশনা ছিল ফিলিস্তিনের জাতিয়তাবাদী সংগীত ‘আলি আল কুফিয়েহ’(রাইজ দ্যা কুফিয়েহ) পরিবেশন করেন। যার মাধ্যমে তিনি ফিলিস্তিনিদের তাদের জাতীয় প্রতীক মাথায় বেঁধে এক হওয়ার আহবান জানান, তখন ফিলিস্তিনের দু’টি শক্তিশালী স্বাধীনতাকামী সংগঠন হা-মাস এবং ফাতাহ পরস্পর রক্তক্ষয়ী সংঘাতে লিপ্ত ছিল।
২০১৩ সালের ২২ জুন। অপেক্ষার পর অবশেষে এলো সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। দিনটি ছিল আসাফের জন্য তারকা বনে যাওয়ার ঘোষণার দিন। সেদিন আহমেদ গামাল ও ফারাহ ইউসুফকে পেছনে ফেলে আরব আইডল হিসেবে ঘোষিত হয় মোহাম্মদ আসাফের নাম। এ ঘোষণায় গাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন আনন্দে। ফিলিস্তিনের পূর্ব জেরুজালেম, নাবিলুম, রামাল্লা, বেথেলহেম, খান ইউনিস ছাড়াও লেবানন এবং জর্ডানেও উল্লাস হয় আসাফের বিজয়ে।
মুক্তির গান গাওয়ায় আসাফকে নিজ দেশেই নিষিদ্ধ হতে হয় ইসরাইলি প্রশাসনের দ্বারা। তবে ২০১০ সালে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ‘ইএনআরডব্লিউএ’ (UNRWA) এর অ্যাম্বাসেডর নিযুক্ত হলে ইসরায়েলি নিষেধাজ্ঞা ভেস্তে যায়।
এরপর আর পেছনে তাকাতে হয়নি আসাফকে। নিজ দেশে পৌঁছান বীরের বেশে। আসাফকে অভিনন্দন জানাতে আসেন স্বয়ং ‘ইএনআরডব্লিএ’ কমিশনার।