১৬ বছর বয়সী ‘বিস্ময়কর বালক’ তামজিদ, পেতে যাচ্ছে আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার?
বাংলাদেশি কিশোর তামজিদ রহমান, বয়স ওর মাত্র ১৬ বছর। দারুণ এক উদ্ভাবক। অসাধারণ ওর পরিকল্পনা। কিশোর বয়সে সে তৈরি করে রক্ত আদান-প্রদানের জন্য কার্যকর ও যুগোপযোগী অ্যাপ। মাত্র ১৫ বছর বয়সে ‘ব্লাডলিংক’ নামের ওই অ্যাপ সে তৈরি করে ২০২৩ সালে। ইতিমধ্যে এটি সাড়া ফেলেছে, উপকার করেছে অসংখ্য মানুষের। ‘বিস্ময়কর বালক’ হিসেবে তাকে অবহিত করেছেন অনেকই। তার এই অভাবনীয় উদ্যোগের জন্য আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের (আইসিপিপি) সেরা ৩০ জন চূড়ান্ত প্রার্থীর তালিকায় স্থান করে নিয়েছেন।
পুরস্কারটি নেদারল্যান্ডস-ভিত্তিক কিডসরাইটস ফাউন্ডেশন প্রদান করে। একে শিশুদের জন্য ‘নোবেল পুরস্কার’ হিসেবে অভিহিত করা হয়। তামজিদের এই অসামান্য স্বীকৃতি বাংলাদেশের জন্য গৌরবের একটি বড় অধ্যায়।
২০০৫ সালে রোমে অনুষ্ঠিত নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ীদের এক শীর্ষ সম্মেলন থেকে এই পুরস্কার চালু করে ‘কিডস-রাইটস’ নামের একটি সংগঠন। শিশুদের অধিকার উন্নয়ন ও নিরাপত্তায় অসাধারণ অবদানের জন্য প্রতিবছর আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কার দেওয়া হয়। ১২ থেকে ১৮ বছর বয়সীরা ওই পুরস্কার পাওয়ার যোগ্য। পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গ, নোবেল পুরস্কার বিজয়ী মালালা ইউসুফজাই প্রমুখ এ পুরস্কার পেয়েছেন।
জানা গেছে, ব্লাডলিংক অ্যাপটি চালু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজার ২০০-এরও বেশি সফল রক্তদাতা-প্রাপক সংযোগ তৈরি হয়েছে। ৫০০-এরও বেশি শিশুর জীবন রক্ষা করা গেছে। অ্যাপটিতে তালিকাভুক্ত আছে দেশের প্রায় ৯৫০ জন সক্রিয় রক্তদাতা।
এ ছাড়া অ্যাপটির ইমার্জেন্সি রেসপন্স ইউনিট সাম্প্রতিক ডেঙ্গু প্রাদুর্ভাবের সময় ৩০টিরও বেশি পরিবারকে রক্তদাতার সহায়তা প্রদান করে। সক্রিয় রক্তদাতা ছাড়াও বর্তমানে ঢাকার ১১টি সেক্টরে ব্লাডলিংকের শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক রয়েছে। এসব স্বেচ্ছাসেবক যেকোনো সময় বিনা মূল্যে রক্ত দেওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন।
‘ব্লাডলিংক’ দেশের প্রথম এবং বৃহত্তম পিয়ার-টু-পিয়ার রক্তদান অ্যাপ। ২০২৩ সালের শুরুর দিকে চালু হওয়া এই অ্যাপটি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে এক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা সমাধানে কাজ করছে—রক্তদান সংকট, বিশেষ করে থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশুদের জন্য যাদের নিয়মিত রক্ত সঞ্চালনের প্রয়োজন। ব্লাডলিংক স্বেচ্ছায় রক্তদাতা ও রক্তপ্রাপকদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগ স্থাপন করে, যা একেবারে বিনামূল্যে করা হয়।
তামজিদ এবং তার ব্লাডলিংক টিমের কার্যক্রম শুধু অ্যাপের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। তারা সারা দেশে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কর্মশালা, স্কুল কার্যক্রম, এবং ক্যাম্পাস অ্যাক্টিভেশন পরিচালনা করেছে। তারা ২০টিরও বেশি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করেছে, যেখানে ১৫,০০০ এরও বেশি মানুষকে রক্তদানে উদ্বুদ্ধ করা হয়েছে। তামজিদের নেতৃত্বে ব্লাডলিংক দল রক্তদানের সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন ভুল ধারণা দূর করতে কমিক বই এবং পোস্টারও তৈরি করেছে, যা নতুন প্রজন্মের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করছে।
নিজের কাজ সম্পর্কে তামজিদ বলেন, ‘দেশে প্রতি বছর ৯ লাখ ব্যাগ রক্তের প্রয়োজন হয়। সময়মতো মাত্র ৩২ শতাংশ রক্তের চাহিদা পূরণ করা যায়। শুধু তাই নয়, ডেঙ্গু মহামারিসহ নানা কারণে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষের জীবন বাঁচাতে রক্তের প্রয়োজন হয়। প্রতিনিয়ত রক্তের প্রয়োজনে হাসপাতালে ছুটতে দেখা যায় রোগীর স্বজনদের। প্রায়ই সঠিক সময়ে রক্ত না পেয়ে চরম দুশ্চিন্তা ও ভোগান্তি পোহাতে হয় তাদের। অপারেশন থিয়েটারে রোগী; রক্ত মিলছে না, এ যেন এক ভয়াবহ দুশ্চিন্তা। এই ভয়াবহতা আমি কাছ থেকে দেখেছি; তাই এর সমাধানে কাজে নেমেছি। যদিও একার প্রচেষ্টায় তা সম্ভব নয়। তাই আমরা দলগতভাবে কাজ করছি। তিনজন থেকে শুরু করা সংগঠনটি বর্তমানে ঢাকাজুড়ে শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী নিয়ে বিনামূল্যে সেবা করে যাচ্ছে।’
ব্লাডলিংক শুধুমাত্র বাংলাদেশেই নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও স্বীকৃতি পাচ্ছে। তামজিদ ইতোমধ্যেই কিডসরাইটস ফাউন্ডেশন, আইসিটি ডিভিশন, ইউএনডিপি বাংলাদেশ, এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছ থেকে ১৫,০০০ ডলারের বেশি অনুদান পেয়েছেন। এই অনুদানের মাধ্যমে অ্যাপটির প্রযুক্তিগত অবকাঠামো আরও উন্নত করার কাজ চলছে, যাতে রক্তদাতা-প্রাপক সংযোগ প্রক্রিয়া আরও দ্রুত এবং নির্ভরযোগ্য হয়।
তামজিদের বেড়ে ওঠা ঢাকায়। পড়াশোনা করেন ঢাকার সেন্ট জোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। তার আন্তর্জাতিক শিশু শান্তি পুরস্কারের মনোনয়ন প্রমাণ করে যে বাংলাদেশের তরুণরা বৈশ্বিক অঙ্গনে বড় ধরনের পরিবর্তন আনতে সক্ষম।