অর্থাভাবে ঢাবি ভর্তির ফরম কিনতে না পারা দেবব্রত’র হাতে একটাই অপশন ছিল—‘বিসিএস’
মাধ্যমিক পরীক্ষায় ২০১০ সালে জিপিএ-৫ পেয়েছিলেন দেবব্রত চক্রবর্তী। তবে অর্থাভাবে ভালো প্রস্তুতি নিতে না পারায় উচ্চ মাধ্যমিক দিতে পারেননি। পরে বাবা ২০ হাজার টাকায় পুকুর বন্ধক রেখে তার উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। ২০১৩ সালে পরীক্ষায় অংশ নিয়ে জিপিএ-৫ পেয়ে উচ্চ মাধ্যমিকে পাস করেন তিনি। সে সময় টাকার অভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির ফরম কিনতে পারেননি। শেষে ভর্তি হন জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ে।
নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া দেবব্রতকে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা করতেও বেগ পেতে হয়েছে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের খরচ চালাতে ১২-১৩টি টিউশনি করিয়েছেন। পরে চাকরির জন্য কোচিংও করতে পারেননি। সেই দেবব্রতই এখন বিসিএস ক্যাডার। ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে (পদার্থ) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।
দেবব্রত বলছিলেন, ‘বন্ধুরা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলে ভর্তি হচ্ছে শুনে নিজের জন্য খারাপ লাগতো। আমি যদি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঘ-ইউনিটের ফরমও নিতাম, তাও চান্স পেতাম। কিন্তু ফরম কেনার টাকা, যাতায়াত ভাড়া- কারও কাছ থেকে পাইনি। পরে ন্যাশনালে ভর্তি হলাম। বন্ধুরা বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেলে চান্স পেয়েছে। আমিও পারতাম, কিন্তু পারিনি। তখন থেকেই মনে হলো, আমার আর একটাই অপশন আছে—বিসিএস।’
নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া দেবব্রতকে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা করতেও বেগ পেতে হয়েছে। নিজের পড়াশোনার পাশাপাশি পরিবারের খরচ চালাতে ১২-১৩টি টিউশনি করিয়েছেন। পরে চাকরির জন্য কোচিংও করতে পারেননি। সেই দেবব্রতই এখন বিসিএস ক্যাডার। ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে (পদার্থ) সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি।
দেবব্রত’র বাড়ি গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়া উপজেলার গোপালপুরে। বাবা দেবরঞ্জন চক্রবর্তী পুরোহিত। দু’ভাইয়ের মধ্যে বড় দেবব্রত গোপালপুর পঞ্চপল্লী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা করেছেন। এরপর জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত গোপালগঞ্জ সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষে একই কলেজে পদার্থ বিজ্ঞান বিষয়ে ২০১৩-১৪ শিক্ষাবর্ষে সিজিপিএ-৩.৩৪ পেয়ে অনার্স এবং ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষে ৩.৩৯ পেয়ে মাস্টার্স শেষ করেন।
৪৩তম বিসিএস ছিল দেবব্রতর তৃতীয় বিসিএস। অনার্স পর্যায়ের পড়াশোনা শেষ করে ২০১৯ সালে প্রথমবার ৪০তম বিসিএসে অংশ নেন তিনি। তবে প্রস্তুতি না থাকায় সফল হতে পারেননি। ২০২০ সালের শুরুতে করোনা মহামারির সময়টিকে কাজে লাগিয়ে বিসিএসের প্রস্তুতি নিতে শুরু করেন। মহামারির পর স্থগিত থাকা মাস্টার্স পরীক্ষাও শুরু হয়। পাশাপাশি সময়ে শুরু হয় ৪১তম বিসিএসের প্রিলি। ভালো প্রস্তুতি থাকা সত্ত্বেও সেবারও প্রিলিতে ফেল করেন দেবব্রত।
এর মধ্যেই ১৫তম শিক্ষক নিবন্ধনের ফল প্রকাশিত হয়। এতে পদার্থ বিজ্ঞানে মেধাক্রম ২৩২ নিয়ে উত্তীর্ণ হন। হিরন পঞ্চপল্লী উচ্চবিদ্যালয়ে চাকরি হয় তার। তবে বিসিএসের নেশায় সেখানে যোগদান করেননি তিনি। এ নিয়ে আত্মীয়-স্বজনদের কাছে শুনতে হয়েছে অনেক কথা। তবে কারও কথায় কান না দিয়ে শুধু বিসিএস জয়ের লক্ষ্যে মনোনিবেশ করেন দেবব্রত।
‘এ নিয়ে আত্মীয়-স্বজন আমাকে কিছু না বললেও বাবা-মাকে কথা শুনিয়ে বলেন, সবাই চাকরি পায় না। আর তোমাদের ছেলে চাকরি পেয়ে ছেড়ে দিচ্ছে। নিজেকে কী ভাবে সে? অনেক বড় হয়ে গেছে?’, বলছিলেন দেবব্রত। এরপর ৪৩তম বিসিএসের প্রিলিতে উত্তীর্ণ হওয়ার মাধ্যমে সফল হন তিনি। প্রিলিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর তার কাছের বড় ভাই (৩৮তম বিসিএসের ক্যাডার) এবং এক শিক্ষক (৩৬তম বিসিএস) রিটেনের জন্য কোচিং করতে ঢাকায় যাওয়ার পরামর্শ দেন।
পরিবারকে আর্থিকভাবে সহযোগিতা করতে তখন গোপালগঞ্জে ১৩টি টিউশনি করাতেন দেবব্রত। ফলে নিজে কোচিং করার সুযোগ পাননি। তিনি বলেন, আমি জেদ করে ভাবলাম, সৃষ্টিকর্তা সহায় থাকলে আমিও পারব। কোচিং ছাড়া সেই দাদা আর আর স্যারের পরামর্শ মতো বই কিনে পড়তে লাগলাম। তবে লিখিত পরীক্ষার আগে অসুস্থ হয়ে পড়ি। ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ খেয়ে সুস্থ থাকলে পড়তাম। যত সময় জেগে থাকতাম, শুধু পড়তাম। এমনকি টিউশনি করাতে গিয়েও পড়েছি। আমার অবস্থা বাবা-মা আর নানি বুঝতেন। তারা বলতেন, সৃষ্টিকর্তা তোকে খালি হাতে ফেরাবে না।
অনার্সে ভর্তি হওয়ার শুরু থেকে বন্ধুর বই ধার করে পড়েছেন এ তরুণ। এরই মধ্যে তার ছোট ভাই বিদ্যুতায়িত হয়ে আহত হন। ছেলেকে বাঁচাতে তার পরিবার আত্মীয়-স্বজনদের কাছে ধরনা দেয়। ২০১৫ সালের সে সময়ে প্রথম টিউশনি শুরু করেন। পরবর্তীতে ২০১৭ সাল থেকে ২০২৪ সালে ক্যাডার হওয়ার আগ পর্যন্ত ১২ থেকে ১৩টি টিউশনি করাতেন। সপ্তাহের দিনগুলোতে তিন ভাগ করে প্রতিদিন ১ ঘণ্টা করে ছয় থেকে সাতটি টিউশনি করিয়েছেন তিনি। এর ফাঁকে পড়তেন। তিনি বলেন, যখনই সময় পেতাম, পড়তাম। কোথাও যাওয়ার সময় গাড়িতে বসে অথবা রিকশায়ও পড়েছি।
শিক্ষক হওয়ার ইচ্ছায় অন্য চাকরির চেষ্টা করেননি দেবব্রত। এর মধ্যে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন তিনি। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে গুয়াধানা উত্তরপাড়া বেণীমাধব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে যোগদান করেন। বর্তমানে সেখানেই কর্মরত রয়েছেন। একই বছরের জুলাইয়ে শুরু হয় লিখিত পরীক্ষা। আন্তর্জাতিক বিষয়াবলি ভালো হয়নি তার। কিন্তু তারা দাদা আর শিক্ষক উৎসাহ দিয়ে বলতেন—হয়ে যাবে, ভাইভার প্রস্তুতি নাও।
আরো পড়ুন: ওয়ার্ল্ড সায়েন্স কম্পিটিশনে দুই স্বর্ণপদক জয় করল বাংলাদেশ
এর প্রায় এক বছর পর ফল বের হয়। ভাইভার বাধাও সাফল্যের সঙ্গে অতিক্রম করে ৪৩তম বিসিএসে শিক্ষা ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন দেবব্রত। নিজের রোল দেখে সেদিন ভাষা হারিয়ে ফেলেছিলেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘রেজাল্ট বের হলে রোল দেখে নিজেকে আর সামলাতে পারিনি। বাবাকে ফোন করে বলি, বাবা আমি এখন বিসিএস ক্যাডার। তিনি আনন্দে চেঁচিয়ে উঠেন। মা আর নানি কেঁদে ফেলেছিলেন।’
শিক্ষক হওয়ার প্রবল ইচ্ছা থেকেই বিসিএসে প্রথম পছন্দ দেন শিক্ষা ক্যাডার। দেবব্রত এ প্রসঙ্গে বলেন, ‘অন্য ক্যাডার পছন্দ দিয়ে আমি হয়তো ম্যাজিস্ট্রেট হতে পারতাম, কিন্তু শিক্ষক হলে আমি ম্যাজিস্ট্রেট গড়তে পারব।’চলার পথে কিছু মানুষের সহযোগিতা পাওয়ার কথা স্মরণ করে দেবব্রত বলেন, ‘স্ত্রী দিশা চক্রবর্তী সর্বদা আমার সঙ্গে থেকে আমাকে উৎসাহিত করেছে। এছাড়া আমার দুই মামা এবং বড় ফুফাতো ভাই আমার জন্য প্রার্থনা করেছেন।’
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা নিয়ে দেবব্রত বলেন, শিক্ষার্থীরা যাতে মানুষের মতো মানুষ হতে পারে, সেভাবে তাদের গড়ে তুলতে চান। এছাড়া দাঁড়াতে চান অসহায় মানুষের পাশে।