৩১ জানুয়ারি ২০২৪, ১৬:০২

প্রথম বিসিএসে ফরেস্ট, দ্বিতীয় বিসিএসে অ্যাডমিন ক্যাডার শাবিপ্রবির সোহানা

সুনিম সোহানা  © টিডিসি ফটো

৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবিপ্রবি) ছাত্রী সুনিম সোহানা। গত ডিসেম্বরের শেষের দিকে এই বিসিএসে ২ হাজার ৮০৫ জনকে ক্যাডার ও নন-ক্যাডারে চূড়ান্ত সুপারিশ করেছে সরকারি কর্ম কমিশন (পিএসসি)।

সোহানার গ্রামের বাড়ি সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলায়। তার বাবার নাম শেখ আব্দুল হালিম, একজন কলেজ শিক্ষক। আর মায়ের নাম মাহফুজা সুলতানা, একজন স্থানীয় সরকার প্রতিনিধি। সোহানারা দুই ভাই-বোন আর তিনি বড়।

সোহানা মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক যশোর বোর্ড থেকেই সম্পন্ন করেন। তিনি মাধ্যমিক সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও উচ্চ মাধ্যমিক সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ থেকে শেষ করেন। পরবর্তীতে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরেস্ট্রি ও এনভায়রনমেন্ট সায়েন্স বিভাগে ভর্তি হন। সেখান থেকেই তিনি অনার্স ও মাস্টার্স শেষ করেন। তিনি প্রথম ৪১তম বিসিএসে অংশগ্রহণ করেন এবং প্রথমবারই ফরেস্ট ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। পরবর্তীতে প্রশাসনের প্রতি অন্যরকম ভালো লাগা থেকে অংশগ্রহণ করেন ৪৩তম বিসিএসে এবং এবার তিনি প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হন।

তার শিক্ষাজীবন কেমন ছিল, এই প্রশ্নে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমি বড় হয়েছি সাতক্ষীরা সদরেই। স্কুল ও কলেজ ছিল যথাক্রমে সাতক্ষীরা সরকারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় ও সাতক্ষীরা সরকারি কলেজ।

পড়াশোনার হাতেখড়িটা হয় বাবা মায়ের কাছেই। আব্বু কখনো পড়াশোনা নিয়ে জোর করেনি, কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করে দেননি, আমার খুশি এবং ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দিয়েছিলেন। তবে আমার আম্মু বরাবরই খুব সিরিয়াস ছিল আমার পড়াশোনা এবং এক্সট্রা কারিকুলাম অ্যাক্টিভিটিজ নিয়ে। এখনো মনে পড়ে ছোট বেলায় যখন দাদুর বাড়িতে ছিলাম, ভোর ৫টায় আম্মু উঠে রান্না শেষ করে, আমাকে এবং আমার ছোট্ট ভাইটাকে রেডি করে ১ থেকে দেড় ঘণ্টা জার্নি করে আমাকে স্কুলে নিয়ে আসতো। তখন পড়তাম সাতক্ষীরা পিএন বিয়াম ল্যাবরেটরি স্কুলে।

যেখানে শহরের বাচ্চারাই মাসে ৫-৬ দিন স্কুল মিস দিত, সেখানে অত দূর থেকে এসে স্কুল করেও আমার কখনো স্কুল মিস বা লেইট  এর রেকর্ড ছিল না। এটা শুধু আমার মায়ের জন্য। উনি চেয়েছিল আমি ভালো স্কুলে পড়ি, আমার পড়াশোনার পরিবেশটা ভালো হোক এবং আমি যেন পড়াশোনার প্রতি আগ্রহী হই। 

সত্যিকার অর্থে আমার মায়ের এই আগ্রহ এবং কষ্ট আমাকে পড়াশোনায় এবং নিজ ক্যারিয়ার সম্পর্কে সচেতন করে তোলে। আমার ক্লাস ফাইভের বৃত্তি পরীক্ষা আগে আম্মু আমাকে পড়ে পড়ে শোনাতেন, আমি পড়তে চাইতাম না, লিখতাম না। আম্মু শুধু বলতেন তুমি শোনো মন দিয়ে আমি পড়ছি। কেন যেন সে দৃশ্যটা এখনো আমি চোখ বন্ধ করে দেখতে পাই, খুব ভালো লাগে এই স্মৃতিটা। ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পরীক্ষার আমি ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় এবং আমি দেখলাম আমার বাবা-মা অনেক খুশি হয়েছেন। তাদের এই খুশি আমার মনে পড়াশোনা প্রতি আগ্রহের জন্ম দেয়। পরবর্তীতে নিজে থেকেই পড়াশোনা করতাম এবং সিরিয়াস ছিলাম। ফলে, অষ্টম শ্রেণিতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় এবং এসএসসিতে জিপিএ-৫ সহ সাতক্ষীরা জেলাতে মেধা তালিকায় সপ্তম স্থান অধিকার করি ও বৃত্তি পায়। আমার শিক্ষা জীবনে অসাধারণ কিছু শিক্ষক পেয়েছিলাম যাদের থেকে আমি অনেক কিছু শিখেছি এবং আমি সর্বদা কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি।

সোহানার বিসিএসের গল্প সম্পর্কে জানতে চাইলে বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন বিএসসি শেষ বর্ষে তখন চাকরির টেনশন মাথায় আসলো এবং বিসিএসের প্রিপারেশন নেয়া শুরু করলাম। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার একদম শুরু থেকে স্বপ্ন  ছিল বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিসে নিজেকে দেখবো। আগে থেকেই আমার লক্ষ্যটা ফিক্সড ছিল বলে প্রিপারেশন নেওয়াতে অনেকটা সহায়ক হয়েছে এবং কখনো লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়নি। এছাড়া, মাঝপথে দেশে চাকরি করবো নাকি বিদেশে উচ্চ শিক্ষার জন্য  যাব এই ধরনের দোটানাও কাজ করেনি। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি কোনো কিছু পাওয়ার জন্য পরিশ্রম ও সময় ব্যয় এর পূর্বে, নিজের লক্ষ্যটা ঠিক করা উঠিত এবং সেই সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা থাকা উচিত।

বিসিএস সফলতায় আপনার পরিবারের ভূমিকা কেমন ছিল প্রশ্নে বলেন, আমার পরিবারই আমার শক্তি। আমার সফলতায় মা, বাবা ও নানুমনির অবদান অপরিসীম। বিসিএসের দীর্ঘ যাত্রায় আমার সকল শিক্ষকবৃন্দ সহ বিশেষভাবে আমি শরীফ হোসাইন আহমদ চৌধুরী স্যার এর প্রতি কৃতজ্ঞ। এছাড়া স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছু কাছের বন্ধু পেয়েছিলাম যারা সব সময় আমাকে সাপোর্ট করেছে।  বাস্তবিক অর্থে একজন  মানুষের সফলতার ভাগীদার তার পরিবারসহ কাছের মানুষগুলো। আমিও এর ব্যতিক্রম না,আমার এই ক্ষুদ্র সফলতা অর্জন শুধু সম্ভব হয়েছে এ সকল মানুষের অবদানের জন্য। 

বিসিএস এর প্রিলিমিনারিসহ, ৪ ঘণ্টার প্রতিটি সাবজেক্টের লিখিত পরীক্ষায় আম্মু নিয়েন যেতেন এবং এতটা সময় বাইরে অপেক্ষা করতেন। আম্মুর কষ্টের কথা মনে পড়লে মনে হতো এর তুলনায় আমার কষ্ট কিছুই না এবং কখনো আমি এই দীর্ঘ সময়ে ধৈর্য হারায়নি। ৪৩তম রেজাল্ট হওয়ার পর নিজের সবচেয়ে বেশি মনে পড়ছিল আমার নানুভাই এর কথা। বেঁচে থাকলে উনি হয়ত অনেক অনেক খুশি হতেন, আশেপাশের সব মানুষকে ডেকে ডেকে আমার রেজাল্ট জানাতেন এবং পেপারে আমার সংবাদটা পড়তেন। আমার নানুভাইয়ের চেহারাটা বারবার মনে পড়ছিল, কত স্বপ্নই তিনি দেখছিলেন আমাকে নিয়ে। নানুভাই এর খুব ইচ্ছা ছিল আমি বিসিএস ক্যাডার হয়েছি এটা উনি পেপারে পড়বেন আজ সত্যিই যখন পেপারে এটা প্রকাশিত হবে আমার নানুভাই এই সংবাদটা আর পড়তে পারবেন না।

বিসিএস সফলতায় তার অনুভূতি কি প্রশ্নে তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ ৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। 

২০২৩ এর ৩ আগস্ট এবং ২৬ ডিসেম্বর ছিল আমার জীবনের অন্যতম স্মরণীয় দিন। ৩ আগস্টে ৪১তম বিসিএসের চূড়ান্ত ফলাফল প্রকাশিত হয় এবং ২৬ ডিসেম্বর প্রকাশিত হয় ৪৩তম বিসিএস এর চূড়ান্ত ফলাফল। ২৬ ডিসেম্বর দিনটা যে আমার জন্য স্বপ্নের  মতো হতে চলেছে এটা কখনোই ভাবিনি। ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার কয়েক ঘণ্টা পর ও মনে হয়েছে যেন ঘোরের মধ্যে আছি। সমস্ত প্রশংসা মহান আল্লাহ রাব্বুল আলমীনের জন্য।

৪১তম ছিল আমার প্রথম বিসিএস, প্রথম চাকরির পরীক্ষা, প্রথম প্রিলিমিনারি। ৪১তম নিয়ে বরাবরই আশা ছিল অনেক বেশি এবং মহান আল্লাহ  আমাকে হতাশ করেননি। ৪১তম বিসিএস এ ফরেস্ট ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। কিন্তু প্রশাসন প্রতি সব সময় অন্যরকম ভালো লাগা ছিল। প্রিপারেশন এর শুরু থেকেই প্রশাসন ক্যাডার এ নিজেকে দেখবো ভেবে কল্পনা করতাম। আর সেই কল্পনা সত্যি হলো, ৪৩তম বিসিএস  ফলাফল পেয়ে। 

পরিশেষে তিনি দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আলহামদুলিল্লাহ। মহান আল্লাহ এই সফলতা দান করেছেন। নিশ্চয়ই যে প্রতিজ্ঞা এতদিন লালন করে এসেছি সেটা কর্মক্ষেত্রে প্রতিফলিত করার জন্য।

সবার কাছে দোয়াপ্রার্থী যেন নিষ্ঠার সাথে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারি এবং সর্বোপরি সাধারণ মানুষের জন্য কাজ করে যেতে পারি।