ডিপ্লোমা শেষে ‘অনার্স ভর্তিতে সংগ্রাম করা’ আল-আমিন এখন অ্যাডমিন ক্যাডার
৪৩তম বিসিএসে প্রশাসন ক্যাডারে সহকারী কমিশনার ও এক্সিকিউটিভ ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মো. আল-আমিন। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়টির প্রথম শিক্ষার্থী হিসেবে বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত হন। দীর্ঘ সংগ্রাম আর পরিশ্রমে পূর্ণ ক্যাডার আল-আমিনের জীবন। তিনি একসময় সাধারণ শিক্ষা থেকে বেরিয়ে কারিগরি শিক্ষা শুরু করেন। এরপর আবার ফিরে আসেন সাধারণ শিক্ষায়।
পরে মায়ের অনুপ্রেরণায় শুরু করেন বিসিএস প্রস্তুতি, পেয়েছেন সাফল্যও। বিসিএসে সুপারিশ পাওয়ার আগেও তিনি বেশকিছু প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেছেন। তার গ্রামের বাড়ি রাজশাহী জেলার মোহনপুরে। বাবা মো. আলতাফ হোসেন পেশায় একজন কৃষক। মায়ের নাম তহুরা বেগম। দুই ভাইয়ের মধ্যে বড় আল-আমিন। ছোট ভাই রাজশাহী কলেজের ইতিহাস বিভাগের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী।
আল-আমিন মোহনপুরের পাকুড়িয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে তার মাধ্যমিক শিক্ষা শেষ করেন। পরে তিনি কলেজে ভর্তি না হয়ে রাজশাহীর আইএইচটিতে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজিতে ভর্তি হন। এরপর আবার সাধারণ শিক্ষায় ফিরে উচ্চশিক্ষার জন্য ভর্তি হন বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগে।
শিক্ষাজীবন নিয়ে আল-আমিনের রয়েছে দীর্ঘ গল্প। তিনি এসএসসি শেষ করে ভর্তি হন ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল টেকনোলজিতে। ২০১৪ সালে এখান থেকে পড়াশোনা শেষ করেন। তিনি বলেন, ডিপ্লোমা পড়ার পেছনের গল্পটাও অনেক বড়। সংক্ষেপে বলতে গেলে ‘বাবা কার কাছে শুনেছিলেন সেখানে পড়লে নাকি তাড়াতাড়ি সরকারি জব পাওয়া যায়!’
বাবার ইচ্ছায় গুরুত্ব দিয়ে অনেকটা নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে ডিপ্লোমায় ভর্তি হয়েছিলেন আল-আমিন। তিনি বলেন, ডিপ্লোমা শেষে চট্টগ্রাম, নীলফামারী, বাগমারা, পিরোজপুরসহ একাধিক জায়গার ডায়াগনস্টিক সেন্টারে খুব স্বল্প বেতনে কাজ শুরু করি। তবে একটা পর্যায়ে এসে আবার অনার্স করার সিদ্ধান্ত নিই। ডিপ্লোমা পড়লেও আমার মন সবসময় পড়ে থাকতো সাধারণ শিক্ষায়।
কৃষক বাবার স্বল্প আয়ে প্রাইভেট ভার্সিটির মোটা অঙ্কের টাকা ম্যানেজ করা কঠিন ছিলো আল-আমিনের। তিনি বলেন, প্রথম সেমিস্টার থেকেই কোচিং-টিউশনি করে যেভাবেই হোক ম্যানেজ করে চলেছি। এর ছয় মাস পরেই বাবা আমাকে ঋণ করে কম্পিউটার কিনে দেন। আমি গ্রাফিক্স ডিজাইন শিখে ফুলটাইম ফ্রিল্যান্সিং শুরু করি। খুব অল্প দিনেই সফলও হই।
তিনি বলেন, ফ্রিল্যান্সিং শুরু করলে বাসা থেকে আর টাকা নিতে হয়নি। আমি ২০২০ সালের নভেম্বরে অনার্স শেষ করি। তখন পর্যন্ত আমার কোনো সরকারি চাকরির প্রতি কোনো ইচ্ছাই ছিলো না।
বিসিএসর প্রতি আগ্রহ-অনুপ্রেরণা কীভাবে জানতে চাইলে আল-আমিন বলেন, ২০২০ সালের নভেম্বরে প্রাইমারির এক বিশাল সার্কুলার হয়। বাবা-মা এটা শুনে আমাকে প্রস্তুতি নেয়ার জন্যে এক প্রকার চাপ প্রয়োগ করেন। আমার মাকে যখন বলেছিলাম—আমি তো এতো পড়া পড়তে পারবো না, আমার সে ধৈর্য নেই। মা শুধু বলেছিলো, এতদিন তো ভালোই পড়েছো, আমার বিশ্বাস তুমি পারবে। শুরু করে দেখো কি হয়।
এরপর মায়ের অনুপ্রেরণা আর সাহসে বিসিএসের প্রস্তুতি শুরু আল-আমিনের। রাজশাহী শহরে গিয়ে শুরু করেন পড়াশোনা। তিনি বলেন, বিসিএস প্রস্তুতিতে খুব কাছের বন্ধু মো. জাহিরুল ইসলাম (৪১তম বিসিএসে কৃষি ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত) আমাকে সবসময় গাইডলাইন দিয়েছে। অনেক হেল্প করেছে।
তিনি বলেন, শুরুতে এক সেট বই কিনে পড়াশোনা শুরু করি। তখন করোনার সময় সবকিছু বন্ধ ছিলো। সেই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছি। আশ্চর্য হয়ে যাই যে, আমি কিনা আধা ঘণ্টাও একটানা পড়তে পারতাম না। আর এখন আমি টানা ৭-৮ ঘণ্টাও পড়েছি বিসিএস প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য।
৪৩তম বিসিএস ছিলো আল-আমিনের প্রথম বিসিএস। তিনি বলেন, প্রিলির আগে আমি ১০ মাসের মত সময় পাই। এর আগে আমি পুরো সিলেবাস ৪-৫ বার রিভিশন দিয়ে ফেলি। এতে খুব সহজেই প্রিলি উতরে যাই। রিটেনের প্রিপারেশনের পুরোটাই আমার জব করা অবস্থাতেই নেওয়া।
চাকরির পাশাপাশি বিসিএস প্রস্তুতি নিয়েছেন আল-আমিন। এরপর তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আসতে শুরু করে একের পর এক সাফল্য। তিনি বলেন, প্রথমে পাইকগাছা খুলনাতে একটা সরকারি প্রজেক্টে জব পাই। সেখান থেকে রাজশাহী জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে অফিস সহকারী কাম কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক পদে যোগ দিই। সেখান থেকে সহকারী শিক্ষক পদে যোগ দিই। আমি আমার উপজেলার মেধাতালিকায় প্রথম ছিলাম। তারপর বাংলাদেশ ব্যাংকের এডিতে জয়েন করি। এরপর আসে বিসিএসের সফলতা।
প্রথম বিসিএসেই সাফল্য পেয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত আল-আমিন। তিনি বলেন, আলহামদুলিল্লাহ, নিজেকে শেষবারের মত শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আমি এডমিন ক্যাডারে ১৪৭তম হয়ে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছি। সিভিল সার্ভিসের সব থেকে সম্মানজনক পেশায় কাজের সুযোগ পেয়ে বাবা-মাকে গর্বিত করতে পেরেছি। এটা আমার জন্যে অনেক বড় পাওয়া।
বরেন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রথম ক্যাডার হিসেবে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন তিনি। আল-আমিন বলেন, আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে আমিই প্রথম বিসিএস ক্যাডার। আমার বাবা-মা যে কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। ভবিষ্যতে দেশের সেবা করার যে সুযোগ আমি পেয়েছি, তা কাজে লাগানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা করবো। আমি নিজে এক সময় ম্যাজিস্ট্রেটদের সাথে তাদের সহকারী হিসেবে কাজ করেছি। সেই অভিজ্ঞতা আমাকে আমার কাজে অনেক হেল্প করবে।