১৩ জানুয়ারি ২০২৪, ১৩:৫৬

নাঈমের কাছে যেটা গেম, রওশানের কাছে তা ধৈর্য—একসঙ্গে বিসিএস জয় দুই রুমমেটের

নাঈম হাওলাদার ও রওশান জামিল  © টিডিসি ফটো

একজন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) লেদার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ থেকে এবং আরেকজন নগর পরিকল্পনা বিভাগ থেকে পড়ালেখা শেষ করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের খানজাহান আলী হলের ২০৬ কক্ষে থাকতেন রওশান জামিল ও নাঈম হাওলাদার নামের দুই বন্ধু। দুজনেই স্বপ্ন দেখতেন বিসিএস ক্যাডার হওয়ার। সেই লক্ষ্যে অ্যাকাডেমিক লেখাপড়ার পাশাপাশি একসঙ্গে শুরু করেন বিসিএস প্রস্তুতি। ৪৩তম বিসিএসে পেয়েছেন সাফল্যও।

রওশান জামিল ও নাঈম হাওলাদার খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই রুমে কাটিয়েছেন তিন বছরের অধিক সময়। বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শেষ করার পর ঢাকার মোহাম্মদপুরে কাটিয়েছেন সাড়ে তিন বছর। বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে এসে দুই বন্ধু সিদ্ধান্ত নেন বিসিএস প্রস্তুতির। ৪৩তম বিসিএসে রওশন জামিল পুলিশ ক্যাডারে ও নাঈম হালদার অডিট এন্ড একাউন্টস ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত হয়েছেন।

নাঈম হাওলাদার বলেন, আমার বিসিএস প্রস্তুতিটা মূলত শুরু হয়েছিল কুয়েট থেকে পাস করে বের হওয়ার পরই। প্রিলির একসেট কমপ্লিট নতুন বই কিনে প্রিলির প্রস্তুতি শুরু করি। সেটি ২০১৮-এর প্রথম দিকে। আমার বিসিএস প্রস্তুতির মূল অনুপ্রেরণা আমার মেজ ভাই। আমার অ্যাকাডেমিক পড়াশুনা থেকে শুরু করে চাকরির প্রস্তুতির পড়াশুনা—সব জায়গায় ছিল তার নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টা ও অনুপ্রেরণা।

রওশান জামিল বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে বিসিএস দেব। এরপর বিশ্ববিদ্যালয় পর্ব শেষ করে ঢাকায় এসে কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব মিলে একটা মেস নিয়ে একসাথে বিসিএস প্রস্ততি শুরু করেছিলাম। ৩৬, ৩৭ এবং ৩৮তম বিসিএসে সুপারিশপ্রাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু বড় ভাই ছিলেন, যারা আমাকে সব সময় সিভিল সার্ভিসে আসার জন্য অনুপ্রাণিত করতেন। বিভিন্ন পরামর্শ ও দিক নির্দেশনা দিয়ে সহায়তা করেছেন তারা। মূলত তাদের অনুপ্রেরণাই আমার বিসিএস প্রস্তুতির পথচলাকে অনেক সহজ করেছিল। 

রওশান জামিলের বাবা পেশায় একজন কৃষক আর মা গৃহিণী। ছোটবেলা থেকে শুরু করে বিসিএস যাত্রার প্রতিটি পদক্ষেপে বাবা-মায়ের নিরঙ্কুশ সমর্থন পেয়েছেন রওশান। তিনি জানান, বাবা-মা, ছোটবোন, মামাসহ পরিবারের সবার অব্যাহত সমর্থন, মানসিক ও আর্থিক সহায়তা ছাড়া বিসিএস যাত্রার এই কঠিন দিনগুলো মোকাবিলা করা আমার একার পক্ষে হয়ত সম্ভব হত না। আমার জন্য জায়নামাজে ফেলা আমার বাবা-মায়ের চোখের পানি মহান আল্লাহ তায়ালা খালি হাতে ফেরাননি। 

নাঈম হাওলাদারে বাবাও পেশায় একজন কৃষক। ছয় ভাই ও তিন বোনের মধ্যে নাঈম তৃতীয়। তিনি জানান, এত বড় পরিবার হওয়ার সত্ত্বেও বাবা-মা অন্তত তাদের সন্তানদের লেখা পড়ায় কার্পণ্য করেননি কখনও। তন্মধ্যে আমরা দুই ভাই বিসিএস ক্যাডার। মেজ ভাই বর্তমানে দুদকের সহকারী পরিচালক আর আমি সোনালি ব্যাংকের সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছি।

কুয়েট থেকে ঢাকায় এসে সম্মিলিতভাবে দুই বন্ধু নিয়েছিলেন বিসিএস প্রস্তুতি। কুয়েটে ভর্তি হয়ে প্রথম বর্ষে পরিচয় তাদের। তারপর একসাথে করেছেন ছাত্ররাজনীতিও। সফলতার ভাগ দিতে চাচ্ছেন দুইজন দুইজনকেই।

রওশান জামিল বলেন, বিসিএস সফলতার পেছনে আমাদের দুইজনের সম্মিলিত প্রস্তুতি বিশেষ ভূমিকা ছিল। প্রিলিমিনারি পরীক্ষার পূর্বে আমরা প্রতিটি বিষয় নিজেরা আলোচনা করতাম। একে অপরকে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতাম। একসাথে বাসায় মডেল টেস্ট দিতাম। সম্মিলিত প্রস্তুতি সবচেয়ে বেশি কাজে লেগেছে বিসিএস লিখিত পরীক্ষায়।

নাঈম হাওলাদার বলেন, আমরা গ্রুপ করে পড়াশুনা করেছি। রিটেনের সময় বিভিন্ন টপিকে লিখে একে অপরের খাতা মার্কিং করেছি। সব মিলিয়ে আমাদের যুগপৎ বিসিএস জার্নিটা সকল ধরনের ভাবাবেগ মিশ্রিত এক অদ্বিতীয় ও অনন্য পথচলা ছিল যার ফলাফল মহান সৃষ্টিকর্তা বেশ প্রসন্ন রূপেই আমাদেরকে দিয়েছেন।

ভবিষ্যতে যারা বিসিএস পরীক্ষা দেবেন তাদের উদ্দেশ্য করে রওশান জামিল বলেন, বিসিএস পরীক্ষা তিনটি ধাপে সম্পন্ন হলেও আমার কাছে মনে হয় লিখিত পরীক্ষাই ক্যাডার প্রাপ্তির ক্ষেত্রে মূল নির্ধারকের ভূমিকা পালন করে। এজন্য লিখিত পরীক্ষায় বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। এখানে যত বেশি নম্বর তোলা যায় তার চেষ্টা করা উচিত। একই কথার পুনরাবৃত্তি না করা, পৃষ্ঠা ভরে লেখার চেয়ে লেখার গুণগত মানের দিকে বেশি ফোকাস করা উচিত।

তিনি বলেন, বিসিএস যতখানি মেধার পরীক্ষা, তার চেয়ে বেশি ধৈর্যের পরীক্ষা। এখানে ধৈর্য ধরা বা লেগে থাকার কোনো বিকল্প নেই।

তবে ভিন্ন পরামর্শ দিয়ে নাঈম হাওলাদার জানান, সোজা কথায় বিসিএসকে আমি একটা গেম হিসেবে দেখি। যার পুরো জার্নিটা অনিশ্চয়তায় ভরা। একজন ক্যান্ডিডেটকে সর্বদা সকল ধরনের সিচুয়েশনকে ফেস করার প্রস্তুতি নিয়ে রাখতে হবে। আমি পরপর ২ বার নন ক্যাডার পেয়েছি। তবুও হাল ছাড়িনি। তৃতীয়বারে এসে স্বপ্নকে ছুঁয়ে দিতে সক্ষম হয়েছি। তাই বলব প্রত্যেকটি মানুষের মধ্যেই জ্বলে উঠার মত বারুদ আছে। শুধু পরিশ্রম, ধৈর্য আর সময়ের অপেক্ষা মাত্র। 

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে নিজেদের উপর অর্পিত দ্বায়িত্ব যেন সততা ও নিষ্ঠার পালন করতে চান এই দুই বন্ধু। নাঈম হাওলাদার বলেন, জীবনের লক্ষ্যে পৌঁছানোর পরও পেছনে ফিরে যখন তাকাই তখন চোখে ভাসে কত শত ত্যাগ, ধৈর্য, পরিশ্রম আর বিনিদ্র রজনী। সে সব ব্যয় করেছি আমি যার জন্য, তা আজ কত কাছে। প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী হিসেবে আমার উপর যে দায়িত্ব ও কর্তব্য রয়েছে, তা যথাযথভাবে পালন করে সমাজের জন্য কাজ করে যাবো।