০৮ অক্টোবর ২০২৩, ১৮:০৬

প্রেসিডেন্সি থেকে নিউ সাউথ ওয়েলস— বদিউজ্জামানের পিএইচডির গল্প

মো. বদিউজ্জামান  © টিডিসি ফটো

দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশে উচ্চশিক্ষা গ্রহণের স্বপ্ন অনেকের। ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও সঠিক গাইডলাইন এবং পরিকল্পনার অভাবে বিশ্বের শ্রেষ্ঠ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়ার সুযোগ পাচ্ছেন না তারা। দেশের অনেক শিক্ষার্থী অক্সফোর্ড, এমআইটি, ক্যমব্রিজসহ বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়াশোনা করছে। তাদেরই একজন প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটির সাবেক শিক্ষার্থী মো. বদিউজ্জামান। বর্তমানে তিনি কিউএস র‌্যাংকিংয়ে ১৯ তম স্থানে থাকা অস্ট্রেলিয়ার ইউসিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস-এ স্কলারশিপ নিয়ে পিএইচডি করছেন। দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসের পাঠকদের জন্য মো. বদিউজ্জামানের স্কলারশিপ ও বিদেশে পড়াশোনার গল্প তুলে ধরা হলো—

অস্ট্রেলিয়া ইউনিভার্সিটি অব নিউ সাউথ ওয়েলস (UNSW, Sydney) কিউএস র‌্যাংকিংয়ে বিশ্বের ১৯তম বিশ্ববিদ্যালয়। এছাড়া এটি অস্ট্রেলিয়ার গ্রুপ-৮ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি রিসার্চ ইনটেনসিভ বিশ্ববিদ্যালয়। আমি ২০১৯ সালে UNSW, Sydney থেকে পিএইচডি করার জন্য UNSW Scientia PhD Scholarship Scheme এর অফার পাই। ২০১৭ সাল থেকে ২০২০ সাল পর্যন্ত মোট ৪০০ জন শিক্ষার্থীকে এই স্কলারশিপটি দেয়া হয়। মূলত UNSW ২০২৫ স্ট্র্যাটেজির একটি অংশ হিসেবে এই স্কলারশিপটি তৈরি করা হয়েছিল। যে সকল শিক্ষার্থীরা তাদের গবেষণার মাধ্যমে গ্লোবাল ইমপ্যাক্ট তৈরি করতে সক্ষম তাদেরকে উদ্দেশ্য করে এই বৃত্তির পরিকল্পনা করা হয়।
 
যেসব শিক্ষার্থীদের UNSW Scientia PhD Scholarship অফার করা হয়েছিলো তাদের এই বৃত্তির সাথে টিএফএস বা টিউশন ফি স্কলারশিপ দিয়ে চার বছরের টিউশন ফি কভার করা হয়; যা গড়ে ১ লাখ ৪৮ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার। এর সাথে শিক্ষার্থীকে চার বছরের জন্য প্রতি বছরের থাকা-খাওয়া হিসেবে এখনকার মুদ্রায় বছরে ৪৩ হাজার ৭৩৮ অস্ট্রেলিয়ান ডলার দেয়া হয়। সাথে শিক্ষার্থীদের প্রতিবছর ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্টের জন্য ১০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার হিসেবে মোট ৪০ হাজার অস্ট্রেলিয়ান ডলার দেয়া হয়। শিক্ষার্থী প্রয়োজনে ক্যারিয়ার ডেভলপমেন্ট এর এই অর্থ রিলোকেশন অর্থাৎ প্লেন ফেয়ার এবং ফ্যামিলির হেলথ ইসনস্যুরেন্সের জন্য ব্যয় করতে পারবেন। এছাড়াও শিক্ষার্থীর জন্য সিঙ্গেল হেলথ ইসনস্যুরেন্স কভারেজের জন্য ২ হাজার ৭৭৪ অস্ট্রেলিয়ান ডলার RTP/UPA স্কলারশিপ দেয়া হয়।

আরও পড়ুন: উচ্চশিক্ষায় কেন বেছে নেবেন নেদারল্যান্ডসকে

সব মিলিয়ে Scientia PhD Scholarship Scheme এর সার্বিক আর্থিক স্কলারশিপ বাংলাদেশি টাকায় আড়াই কোটির অধিক। ফলে এটি UNSW, Sydney-এর অন্যতম আকর্ষনীয় এবং প্রেস্টিজিয়াস একটি বৃত্তি। এই বৃত্তি পেতে হলে শিক্ষার্থীকে তার গবেষণার মাধ্যমে গ্লোবাল ইমপ্যাক্ট তৈরির সক্ষমতা সম্পন্ন একটি গবেষণা প্রকল্প নিয়ে আবেদন করতে হয়। গর্বের ব্যাপার হল উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী বিভিন্ন বছরে ২০১৭ থেকে ২০২০ এর মধ্যে এই বৃত্তিটি পেয়েছে; যা বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের গবেষণায় সক্ষমতা এবং মেধার স্বাক্ষর। যদিও ২০২০ সালে থেকে আর Scientia PhD বৃত্তি দেয়া হয়নি, তবে পিএইচডির জন্য অষ্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে নানাবিধ বৃত্তির সুবিধা রয়েছে। এ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে গেলে সকল তথ্য পাওয়া যাবে।

দেশ, বিশ্ববিদ্যালয় এবং বৃত্তি ভেদে আবেদন প্রক্রিয়া ভিন্ন হতে পারে। যেমন UNSW Scientia PhD এর ক্ষেত্রে প্রার্থীকে একটা এক্সপ্রেশন অব ইন্টারেষ্ট দিয়ে শুরু করতে হত। এরপর কিছু ইমেইল কমিউনিকেশন, মোটিভেশনাল ইন্টারভিউ, এক বৃত্তির জন্য তিন জনের নোমিনেশন পাওয়া, চূড়ান্ত আবেদন এবং ফলাফল। কোন কোন বৃত্তির জন্য প্রথমেই সুপারভাইজের সাথে রিাসর্চ প্রোপোজাল নিয়ে যোগাযোগ করতে হয়। পদ্ধতি যে রকমই হোক না কেন, কিছু কমন গুনাবলি পিএচডি করার জন্য থাকতে হবে যা কেবল একাডেমিক ফলাফলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়।

পিএইচডি বৃত্তির জন্য সব থেকে বড় ভুল ধারনা হলো অত্যন্ত ভাল রেজাল্ট থাকতে হবে। বাস্তবতা হল অতীতে গবেষণার অভিজ্ঞতা এবং চমৎকার একটি গবেষণার প্রস্তাবনা থাকলেই সহজে পিএইচডির জন্য বৃত্তি পাওয়া যেতে পারে। যেমন ধরুন, আমি প্রথাগতভাবে ইন্টারমিডিয়েট করিনি। এসএসসির পরে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করে আমি প্রেসিডেন্সি ইউনিভার্সিটি থেকে ব্যাচেলর করি। ব্যাচেলর অধ্যয়নরত অবস্থায় আমরা একটি স্টার্টাপ নিয়ে কাজ করছিলাম ফলে আমার সমাপনী সিজিপিএ ছিলো ২.৭৫, নিতান্তই গন্য করা মত না। স্টর্টাপ নিয়ে কাজ করার পাশাপাশি পড়াশোনাটা চালিয়ে যেতে খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স শুরু করি এবং সেখানেই আমার সুপারভাইজার ( প্রফেসর ড. রফিকুজ্জামান) স্যারের মাধ্যমে রিসার্চের হাতেখড়ি; যা ছিল পিএইচডিতে আসার প্রথম ধাপ।

যারা ভবিষ্যতে পিএইচডি করতে আসতে চান তাদের কয়েকটি বিষয়ে সিস্টেমেটিক ভাবে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। প্রথম সিদ্ধান্ত পিএইচডি কি আসলে জরুরি? ভবিষ্যতে যারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে চান অথবা গবেষণাধর্মী পেশায় থাকতে চান পিএইচডি তাদের জন্য উপযুক্ত পছন্দ হতে পারে। এর পরের প্রস্তুতি হলো ব্যাচেলর লেভেল বা অবশ্যই মাস্টার্স লেভেল থেকে গবেষণা শুরু করা। বিশেষ করে যদি আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ে রিসার্চ মেথডোলোজি কোর্সটি নাও থাকে নিজে থেকে রিসার্চ মেথডোলোজি শিখে নেয়া। যখন গবেষণার পদ্ধতিগুলো জানবেন তখন দেখবেন যে আপনি আপনার কৌতুহলকে সিস্টেমেটিক পদ্ধতিতে একটি প্রশ্নে রূপদান করতে পারছেন যা গবেষকদের জন্য অত্যন্ত জরুরি। কিছুটা গবেষণা বোঝার পরে চেষ্টা করতে হবে অন্যান্য গবেষকদের সাথে কোলাবোরেট করা এবং নিজেদের গবেষণা পাবলিশ করা। কেননা পিএইচডির বৃত্তি আবেদনের সময় পাবলিকেশন একটা বড় প্রমান যে আপনার গবেষণার দক্ষতা আছে। এরপরের ধাপ হবে নিজের গবেষণার ক্ষেত্র ঠিক করা এবং সেই ক্ষেত্রের নিত্যনতুন সব গবেষণাপত্র পড়ে ধারনা নেয়া এবং নিজের পিএইডডির জন্য রিসার্চ প্রোপোজাল তৈরি করা।

আরও পড়ুন: কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিনামূল্যে মাস্টার্স-পিএইচডির সুযোগ, সঙ্গে থাকছে ২৭ লাখ টাকা

একটি ভালো রিসার্চ প্রপোজালের সাথে আরেকটি দক্ষতা অত্যন্ত জরুরী, সেটা হলো যোগাযোগ। আপনাকে প্রথমে ইমেইলে বা কোন একটা আবেদনের মাধ্যমে সুপারভাইজার বা কর্তৃপক্ষকে বোঝাতে হবে আপনার সক্ষমতা যেখানে চমৎকার করে ইমেইল লিখতে পারাটা খুবই জরুরী। এরপরেই আসবে মোটিভেশনাল ইন্টারভিউ অথবা ক্ষেত্র বিশেষে নিজের উপরে প্রেজেন্টেশন, যেখানে আপনার ওরাল কমিউনিকেশন ভাল থাকতে হবে। কোন একটা প্রশ্ন এলে সেটার বিশ্লেষণধর্মী একটা উত্তর দিতে পারলে বৃত্তি পাবার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। দেখুন উন্নত বিশ্বে কেউ কোথাও প্রশ্ন করবে না আপনি কোথা থেকে পড়েছেন এবং আপনার সিজিপিএ কত? তারা শুধু দেখবে আপনার কম্পিটেন্সি। একজন গবেষকের সব থেকে বড় কম্পিটেন্সি প্রশ্ন করা এবং যে কোন জিনিসের প্রতি প্রথার বাইরে দৃষ্টিভঙ্গি। একজন শিক্ষার্থীকে অবশ্যই গবেষণায় আসার আগে ক্রিটিক্যাল্লি ভাবা এবং বিশ্লেষণ করার সক্ষমতা থাকতে হবে। সর্বোপরি একজন গবেষকের জন্য রিসার্চ ইন্টিগ্রিটি বা গবেষণার সততা সম্পর্কে পরিচ্ছন্ন ধারনা নিয়ে সততা এবং স্বচ্ছতার সাথে গবেষণা করতে হবে। তাহলেই গবেষক তার গবেষণা দ্বারা মানব সভ্যতার উপকার সাধন করতে পারেন।

পিএইচডি শুরু করার আগে এবং পরে দুটো সময়ের অভিজ্ঞতা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভিন্ন হয়। শুরুর আগে এটা এক ধরনের একাডেমিক ফ্যান্টাসির মত লাগলেও জার্নিটার জন্য দরকার প্রচণ্ড রকমের ধৈর্য্য এবং অধ্যবসায়। সর্বোপরি পিএইচডি শুরুর করার আগে ভেবে নিতে হবে আদৌ দরকার কি না? দরকার হলে এখন থেকে গবেষণা কিভাবে হয় জানতে শুরু করুন, কমিউনিকেশন দক্ষতা বাড়ান, তৈরি করুন আপনার গবেষণার বিষয়। এসবে আপনার দৃঢ়তা থাকলে বৃত্তি পাওয়া আপনার জন্য সু-নিশ্চিত।