বিসিএস ক্যাডার হয়ে উঠার গল্প:

কষ্টগুলোই ছিল রাজিবের অনুপ্রেরণা

মো. রাজিব হোসাইন
মো. রাজিব হোসাইন  © সংগৃহীত

৩৬তম বিসিএস-এ মেধা তালিকায় ৩১তম হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে নিয়োগ পেয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র মো. রাজিব হোসাইন। অার্থিক অস্বচ্ছলতা আর মাধ্যমিকের শুরুতে মায়ের অসুস্থ্যতার কারণে লেখাপড়া থেকে ছিটতে পড়তে যাচ্ছিলেন এই রাজিব। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়া নিয়ে ছিল নানা অনিশ্চয়তা। ধার-দেনায় বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তির পরেও সেমিস্টার পদ্ধতির মারপ্যাঁচে হারাতে বসেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রত্বও। কিন্তু অতন্ত ধৈর্য্য আর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে জয় করছেন সব বাধা। পূর্ণ করেছেন তার বহুল প্রত্যাশিত লক্ষ্যও। তার বিসিএস প্রশাসন ক্যাডার হয়ে উঠার গল্প শুনেছেন আমাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিবেদক নুর হোসেন ইমন। পড়ুন তার চুম্বক অংশ।

-গল্পটি একটি ছোট পরিবারের। গল্পের নায়ক মো. রাজিব হোসাইন। তার পিতা মো. আব্দুল বারিক হলেন ভূমিহীন কৃষক। অন্যের জমিতে বর্গা চাষ করে সংসারের খরচ চালাতেন রাজিবের পিতা। বড় ভাই আর মা-বাবা নিয়ে রাজিবদের পরিবারের সদস্য ছিল চারজন। সুখের কোন অন্ত না থাকলেও রাজিবদের ছিল না টাকা। বাবার অল্প আয়ে পরিবারের খাওয়ার খরচ মিটাতেই হিমশিম খেতে হতো। দরিদ্রতা আর কষ্টের মধ্য দিয়ে বেড়ে উঠা রাজিব ৩৬তম বিসিএস পরিক্ষায় মেধা তালিকায় ৩১তম হয়ে প্রশাসন ক্যাডার হন।

রাজিবের গ্রামের বাড়ী ঝিনাইদহ জেলার শৈলকূপা থানার শ্রীরামপুর গ্রামে। ছোটবেলা থেকেই প্রচন্ড পড়ূয়া ছিলেন তিনি। পঞ্চম শ্রেণীতে পান সরকারি বৃত্তি। ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন বসন্তপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। পিতা পড়ালেখার খরচ চালাতে পারছেন না বলে বারবার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয় রাজিবের।

মাধ্যমিকে কখনও নতুন বই কিনতে পারেননি তিনি। পড়ালেখা করতেন স্কুলের বড় ভাইদের পুরাতন বই সংগ্রহ করে। এর মধ্যেই অসুস্থ হয়ে পড়েন তার মা জোহরা খাতুন। অসুস্থ মায়ের সেবা যত্ন করা ছাড়াও ৪/৫ বছর পিতার সাথে রান্নার কাজও করতে হয়েছে রাজিবকে।
পরিশ্রমী ও মেধাবী শিক্ষার্থী হওয়ায় রাজীব ছিলেন শিক্ষকদের নয়নের মনি। স্মৃতি চারণে রাজীব স্মরণ করেন তার স্কুলের লিয়াকাত স্যারের কথা। যিনি ক্লাসের বাইরেও রাজিবকে নিয়ে আলাদা করে পড়িয়েছিলেন।

রাজিবদের ঘরে পড়ার জন্য ছিল একটি টেবিল, কিন্তু সেখানে কোন চেয়ার ছিল না। ওই টেবিলেরই দুপাশে চকি দিয়ে হারিকেনের আলো জ্বালিয়ে পড়ালেখা করতেন তারা দু’ভাই। স্কুল জীবন শেষ করে ভর্তি হন শেখপাড়া দু:খী মাহমুদ ডিগ্রি কলেজে। শিক্ষকদের আর্থিক সহযোগিতায় পড়ালেখা চালিয়ে যান তিনি এবং উচ্চ মাধ্যমিকে পান জিপিএ ফাইভ।

রাজিবের বাবা-মায়ের ইচ্ছা ছিলো ছেলেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াবেন। রাজিবের মা কখনও দেখেননি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেমন, তবে তিনি জানতেন এটি দেশের বড় এবং সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। তাই খুব করে চাইতেন তার ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুক এবং দেশের মানুষের জন্য কিছু করুক। কয়েকজনের থেকে টাকা ধার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষার জন্য টাকা জোগাড় করেন রাজিবের বাবা। মায়ের চেষ্টায় রাজিব ৪৮১তম হয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে নিজের খরচ চালানোর জন্য টিউশনী নেন রাজিব। টিউশনী করিয়ে হলে ফিরতে বাজতো রাত ১১টা। তাই অনেক সময়ই রাতে না খেয়ে কাটাতে হত তাকে। এর আগে গ্রামে পড়ে এসেছেন বাংলা মাধ্যমে কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ালেখা ইংরেজি মাধ্যমে তাই খাপ খাইয়ে নিতে কষ্ট হচ্ছিল তার। সবকিছু মিলিয়ে ১ম ও ২য় বর্ষে রেজাল্ট খারাপ করেন তিনি।

হলের বড় ভাইদের থেকে বিসিএস পরীক্ষা দেয়ার অনুপ্রেরণা পান রাজিব। ৩য় বর্ষ থেকেই স্বপ্ন দেখা শুরু করেন ম্যাজিস্ট্রেট হবেন। এর জন্য কখনও কোন কোচিং সেন্টারে গিয়ে কোচিং করতে বা মডেল টেস্ট দিতে হয়নি তাকে। রুমে বসে নিজে নিজেই প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। ৩৬ তম বিসিএস এ পেয়ে যান প্রথম পছন্দ প্রশাসন ক্যাডার। প্রস্তুতির ৩ বছর যেন সময় নষ্ট না হয় এজন্য ফেসবুক ডিএ্যাক্টিভেট করে রেখেছিলেন তিনি। সকালে বাবা মায়ের সাথে কথা বলে নিতেন আর ইমারজেন্সি না হলে সারাদিন কারো ফোনও ধরতেন না। তার স্বপ্ন ছিলো দেশের মানুষের জন্য কিছু করবে এবং তার বেড়ে উঠার স্থান ও তার গ্রামের মানুষগুলোর জন্যও কিছু করবে। তার সমস্ত কাছের পিছনে আদর্শ হিসেবে কাজ করেছে তার মা-বাবা।

সফলতার পিছনে কোন জিনিস বেশী অনুপ্রেরণা দিয়েছে জানতে চাইলে রাজিব বলেন, আমার কষ্টগুলোই আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। আমি কখনও ছোট বেলার কষ্টগুলো ভূলতে পারব না।
ভবিষ্যৎ ইচ্ছা সম্পর্কে রাজিব ‌‌'দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস'কে বলেন, আমি চাইবো প্রজাতন্ত্রের সেবক হিসেবে অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে। মানবিক দিক থেকে অনেক কাজ করার সুযোগ আছে, তাই আমি চাইবো সুযোগ ও সাধ্য অনুযায়ী মানবিক কাজ করার। আর গ্রামের মানুষ, আমার স্কুল ও শিক্ষকদের জন্য কিছু করার চেষ্টা করব। সর্বোপরি চেষ্টা করব ভালো মানুষ হতে।

যারা আগামী দিনে বিসিএসের প্রস্তুতি নিবে তারা কিভাবে শুরু করবে প্রশ্ন ছিলো রাজিব হোসাইনের কাছে। তিনি ‌‌'দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস' এর মাধ্যমে তার উত্তরসুরীদের উদ্দেশ্যে বলেন, বিসিএস-র জব একটি সম্মানজনক পেশা। সবাইকে বলবো না, তবে যারা চায় তাদের উদ্দেশ্যে বলব- চেষ্টা থাকলেই সব কিছু করা সম্ভব। প্রথমে লক্ষ্য স্থির করতে হবে, তারপরে সে অনুযায়ী চেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে। প্রথমত যে যে বিষয়ে পড়ে সে বিষয়ে অগাধ জ্ঞান লাগবে কারণ ভাইবাতে নিজের বিভাগ সম্পর্কে প্রশ্ন করবে। নিজের ভাষা ভালোভাবে কথা বলা শিখতে হবে, এর জন্য সাধারণভাবে কথা বলার সময় একটু যত্নশীল হলে বা চর্চা করলেই সম্ভব। এর পাশাপশি ইংরেজিতে ভালোভাবে কথা বলার চেষ্টা করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজনে কোন ইংলিশ স্পোকেন কোর্স করে নেয়া যেতে পারে। অনার্স ৩য় বর্ষ থেকেই প্রস্তুতি শুরু উপযুক্ত সময়। কোনভাবেই বিনা দরকারে সময় নষ্ট করা যাবে না। পাশাপশি বাংলা ও ইংরেজি পত্রিকার সম্পাদকীয়, দেশী-বিদেশী ঘটনাগুলো সম্পর্কে আপডেট থাকতে হবে।


সর্বশেষ সংবাদ