প্রিলি পাস জানলেও মেয়ের ক্যাডার হওয়া শোনা হয়নি তন্বীর বাবার
- মো. আমান উল্লাহ, বাকৃবি
- প্রকাশ: ১৪ আগস্ট ২০২৩, ১০:৫১ PM , আপডেট: ১৫ আগস্ট ২০২৩, ০৭:১৯ PM
একজন কর্মজীবী নারীর দিন যেভাবে শুরু হয় তার দিনটিও একইভাবে শুরু হয়েছিলো সেদিন। চিন্তা, উৎকণ্ঠায় দুরুদুরু মন নিয়ে সেদিন সকাল ৯টায় যান অফিসে। একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় কাজ করেন তিনি। কিন্তু অন্য কর্মজীবীর চেয়ে তিনি আবার আলাদা। কারণ তিনি একই সাথে একাধিখ কাজ করেন- যেন এক সব্যসাচী।
তাই তো তাকে অফিস শেষেই পড়ন্ত বিকালে দৌড় মারতে হয় একটি টিভি চ্যানেলে। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতে। অনুষ্ঠান বিরতিতে টিভি স্টুডিওতেই জানতে পারলেন ফল প্রকাশিত হয়েছে। দেখলেন সফলদের তালিকাতে তার রোল নম্বরটিও জ্বলজ্বল করছে। বলছিলাম ৪১তম বিসিএস পরীক্ষায় প্রশাসন ক্যাডারে সুপারিশপ্রাপ্ত ফারজানা রহমান তন্বীর কথা।
ফারজানা রহমান তন্বী একজন সংগ্রামী নারীর প্রতিচ্ছবি। জন্ম নরসিংদীর শিবপুর উপজেলায়। তার এই সাফল্য পাওয়ার পথটি মোটেও মসৃণ ছিলো না। সরকারি কর্মকর্তা বাবা মরহুম মো. হাফিজুর রহমান এবং মা মোকারিমা খনম খুব করে চাইতেন তাদের আদরের মেয়ে হবে বিসিএস ক্যাডার।
৪১তম বিসিএস প্রিলি পরীক্ষার ফল প্রকাশের দিন বাবাকে হারিয়েছিলেন। এসময় তন্বী মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। এই অবস্থায় মায়ের যত্ন নেয়ার পাশাপাশি, চাকরি-লিখিত প্রস্তুতি চলে যুগপৎভাবে। তন্বী ফলাফল পাওয়ার পরই প্রথমে মাকে ফোন দিয়ে জানিয়েছিলেন। আর বারবার বলেছিলেন ‘আমার আব্বু দেখে যেতে পারলো না! বাবা তোমার মেয়ে এখন বিসিএস ক্যাডার হয়ে গেছে।’
স্থানীয় এলাকায় স্কুল-কলেজের গন্ডি পেরিয়ে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি অর্থনীতি ও গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছিলেন তন্বী। অনার্স দ্বিতীয় বর্ষ চলাকালীন বিসিএস প্রস্তুতি শুরু করলেও তিনি তখন পুরোদমে শুরু করেননি।
২০১৭ সালের শেষ দিকে পূর্ণাঙ্গভাবে বিসিএস প্রস্তুতি নেন। তার পড়ালেখার যেকেনো বিষয়ে বুঝে বিস্তারিত পড়ার অভ্যাস ছিলো। বিসিএস প্রস্তুতি শুরু থেকে খুটিনাটি সব বিষয়ের নোট করতেন। এজন্য লিখিত পরীক্ষা তার জন্য সহজ হয়ে যায়। উপস্থাপনা করতে গিয়ে কথা বলার বিষয়টি তন্বীর ভাইবায় অনেক কাজে দিয়েছিলো। ভাইবার প্রস্তুতিও তিনি বেশ গুছিয়ে নিয়েছিলেন। একটি প্রশ্নের উত্তর দিলে পরের প্রশ্ন কী হবে এই চিন্তা করে ভাইবার প্রস্তুতি নিয়েছিলেন।
বিসিএস তন্বীর অনেক দিনের স্বপ্ন ছিলো। বিভিন্ন জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে বিসিএস ক্যাডারদের যে সম্মান করা হতো তখন থেকে বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্ন দেখতেন। বিসিএস ক্যাডার হওয়ার স্বপ্নটা তিনি নিজে যতটা দেখেছিলেন তার থেকে বেশি স্বপ্ন ছিলো তন্বীর বাবার। তিনি দেখতে চাইতেন যে তন্বী একদিন বিসিএস ক্যাডার হবেন। বাবার ইচ্ছা আর জীবনসঙ্গীর অনুপ্রেরণাই তন্বী নিজের সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করতে থাকেন।
তন্বী বলেন, ‘২০২১ সালের ১ আগস্ট একই সাথে আমার খুশির আবার সবচেয়ে কষ্টের দিন। সেদিন ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের দিনই আমার বাবা এই দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। আব্বু শুধু জেনেছিলেন আমি প্রিলিতে পাস করেছি। এভাবে আব্বুকে হারিয়ে আমি বিসিএসের প্রতি আরও বেশি ডেডিকেটেড হয়েছি। প্রতিদিন মনে হয়েছে, আব্বুর স্বপ্নটা পূরন করতেই হবে আমাকে।’
তন্বী ২০১৭ সালে আরটিভি-ডাবর ভাটিকা ক্যাম্পাস স্টারে অংশগ্রহণ করে বাকৃবি থেকে ক্যাম্পাস স্টার হন। সেখানে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রতিনিধিত্ব করেন। তখন থেকে তন্বীর মিডিয়া জগতে কাজ করা শুরু হয়। তন্বী ২০১৮ সাল থেকে বেসরকারি দীপ্ত টিভিতে জনপ্রিয় দীপ্ত কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা করেন। এখন তিনি গ্লোবাল টিভিতে উপস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন।
তন্বী বিশ্বাস করেন বিসিএস ক্যাডার হওয়া ভাগ্যের বিষয়। প্রত্যেকেরই প্রচেষ্টা থাকে। যারা লিখিত দিয়ে ভাইবা পর্যন্ত আসে এবং যারা শেষ পর্যন্ত আসতে পারে তারা যেমন মেধাবী, যারা আসতে পারে নি তারাও মেধাবী। মেয়েদের ক্ষেত্রে পড়ালেখা শেষ করে বিসিএস প্রস্তুতি নেওয়া একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। ধৈর্য্য ধরে সামনে এগিয়ে আসতে হবে।
ভবিষ্যত পরিকল্পনা সম্পর্কে তন্বী বলেন, আমার দায়িত্বটা আমার স্বপ্নের জায়গা। একটি আবেগের জায়গা। আমার অর্পিত দায়িত্ব সততা, নিষ্টার সাথে পালন করতে পারি। মানুষের সেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখতে পারি। বিশেষ করে নারী, শিশু এবং যারা মাইনরিটি আছে তাদের কল্যানে কিছু করতে পারি এটাই আমার স্বপ্ন।