০৫ মে ২০২৩, ১২:১৩

দুই হাত নেই, মুখ দিয়ে লিখেই ফার্স্ট ক্লাস পেলেন চবির রায়হান

বাহার উদ্দিন রায়হান  © সংগৃহীত

দুই হাত নেই। মুখে কলম আটকে কনুইয়ের সাহায্যে লিখে কয়েকটি পরীক্ষা দিয়েছেন। আর শ্রুতলেখকের সহায়তা নিয়েছেন কয়েকটি পরীক্ষায়। এভাবে পরীক্ষা দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে ফার্স্ট ক্লাস পেয়ে স্নাতকোত্তর (সিজিপিএ-৪ এর মধ্যে ৩.১৩) পাস করেছেন বাহার উদ্দিন রায়হান।

বাহার উদ্দিন রায়হান জানান, এখন যোগ্যতা অনুযায়ী একটি চাকরি পেলে মাকে নিজের কাছে এনে রাখতে পারবেন। বাহার যখন মায়ের পেটে ছিলেন, তখন বাবা তাঁর মাকে মারধর করে চলে গিয়েছিলেন। এখন ছেলে কবে একটি ভালো চাকরি পাবেন, সে আশায় বসে আছেন মা।

গত ০১ মে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বাহার তার স্নাতকোত্তর পাসের কথা জানিয়েছেন। এরপর থেকে শুভাকাঙ্ক্ষীদের শুভকামনায় ভরে যাচ্ছে বাহার উদ্দিনের ফেসবুকের হোম পেজ।

সেখানে তিনি লিখেছেন, শুকরিয়া রবের নিকট, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগ থেকে প্রথম শ্রেণিতে মাস্টার্স শেষ করলাম। যেদিন মুখে কলম তুলেছিলাম সেদিন ভাবিও নাই মাস্টার্স পর্যন্ত পড়তে পারবো, তবে দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ভালো কিছু করবো।

শারীরিক প্রতিবন্ধকতাকে হার মানিয়ে, নিজের দৃঢ় মনোবল আর অদম্য সাহস নিয়ে যে লেখাপড়া করা যায়, এমনই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন তিনি। দুটো হাত নেই, কিন্তু বাহারের পড়াশোনার মতো কোনো কিছুই যেন থেমে নেই। সচল ব্যক্তির মতোই সাইকেল, মোটরসাইকেল চালাচ্ছেন। এমনকি স্কেটিংও খুব সুন্দরভাবেই করছেন তিনি।

একটি খণ্ডকালীন চাকরি এবং অনলাইনে টুকটাক ব্যবসা করে যে আয় হয়, তা দিয়ে এ পর্যন্ত নিজের পড়াশোনার খরচ চালিয়েছেন বাহার উদ্দিন। চট্টগ্রাম শহরে টেনেটুনে নিজের খরচ চললেও মাকে রাখতে হচ্ছে কক্সবাজারের চকরিয়ায়। অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করে মা তাঁর বাবার বাড়ির পাশে ছোট একখণ্ড জায়গা কিনেছেন। সেখানে ঘর তুলে থাকছেন।

আরও পড়ুন: শাটলে সিট দখল নিয়ে চবি ছাত্রলীগের দু'পক্ষের সংঘর্ষ, আহত ৩

রায়হানের বাড়ি কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলার লক্ষ্যারচর ইউনিয়নে। তার পরিবারে মা ছাড়া আর কেউ নেই। ২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর এক দুর্ঘটনায় তিনি হারান এক হাত ও আরেক হাতের কনুই পর্যন্ত। রায়হান তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। সেই থেকে মা খালেদা বেগম ছেলের জন্য যুদ্ধ করে চলেছেন।

পড়াশোনার প্রতি তীব্র আগ্রহ বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত নিয়ে যায় রায়হানকে। এই সাফল্যে তাই পরিবারের অবদানকে বড় করে দেখেছেন রায়হান।

জানিয়েছেন, তার এতটুকু আসার পেছনে নানার বাড়ির অবদান সবচেয়ে বেশি। কারণ, নানার পরিবার তাকে মানসিক ও আর্থিকভাবে সাহায্য করেছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর কারও সাহায্য নেননি রায়হান। নিজে অর্থনৈতিক কাজকর্ম করার চেষ্টা করেছেন। মায়ের দেখভাল করেছেন। এখন একটি চাকরি পেলে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া সম্ভব তাঁর পক্ষে।

২০০৪ সালের ৩০ অক্টোবর বাহার উদ্দিন তখন পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থী। বাড়ির পাশে বিদ্যুতের খুঁটিতে বসানো ট্রান্সফরমারে একটি ছোট পাখি ঢুকে পড়ে। সেই পাখি দেখতে গিয়ে বৈদ্যুতিক তারে হাত দিতেই ঝলসে যায় তার দুই হাত, বুকের কিছু অংশ ও পায়ের তলা। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) হাসপাতালে পাঁচ দিনের মধ্যে কেটে ফেলা হয়েছিল তাঁর এক হাত ও আরেক হাতের কনুই পর্যন্ত।

দুই হাত ছাড়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন বাহার উদ্দিন। তিনি বলেন, আমি ঝুঁকিপূর্ণ কাজ এড়িয়ে চলি। তবে চাইলে সব কাজ করতে পারি, তা প্রমাণের জন্য মোটরসাইকেল চালানো শিখেছি। স্কেটিং করি। মনেপ্রাণে চাইলে হাত না থাকলেও কোনো কাজ অসম্ভব নয়।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মো. আবদুল্লাহ আল মাসুম বলেন, বাহার উদ্দিনের পড়াশোনায় অদম্য ইচ্ছা ছিল। বিভাগের শিক্ষকেরা তার পাশে ছিলেন। এ শিক্ষার্থীর ভালো ফলাফল আমাদের বিভাগের জন্য অবশ্যই আনন্দের এবং গর্বের। আমরা চাই, যথাযথ কর্তৃপক্ষ বাহার উদ্দিনের চাকরির ব্যাপারে আন্তরিক হবে।