প্রবাসের বিশ্ববিদ্যালয়ে নিরস ঈদ

জন্মের পর থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ঈদের অভিজ্ঞতা ছিলো এক রকম।ঈদ মানে নতুন জামা কেনা, ঈদের দিন সবার বাড়ী বাড়ী গিয়ে খাওয়া, বড়দের কাছ থেকে ঈদ সালামী আদায় করা। ঈদের আগের দিন রাতে সব কাজিনরা মিলে হাতে মেহেদী লাগাতাম সাথে পরিকল্পনা করতাম কোথায় কোথায় ঘুরতে যাবো, কোন বাড়ীর কোন খাবারটা মজা, কখন গেলে খাবারগুলা ঠিক মত পাওয়া যাবে।

২০১৮ সালের রোজার ঈদে হঠাৎ আমার সেই চিরচেনা ঈদের আমেজটা পুরা মাত্রাই পরিবর্তন হয়ে গেলো। উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে ২০১৭ সালে সেপ্টেম্বর মাসে পাড়ি জমাই জার্মানির পাসাও নামক একটা ছোট পাহাড়ি শহরে। ২০১৮ সালে জীবনে প্রথম নিজের দেশের বাহিরে রোযা রাখা, তাও আবার ১৮ ঘন্টা, সাথে প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, পেপার সাবমিশনের যন্ত্রণাতো আছেই। বাংলাদেশের মত করে আমি রোজাটাকে অনুভব করতে পারিনি, রোযার সময় দেশে একটা অন্য রকম আমেজ থাকে সবাই এক সাথে ইফতারি করা, নামাজ পড়ার সেহেরী করার! সোসাল মিডিয়ায় যখন বন্ধু বান্ধবীদের ঈদের জামা কেনা বা বাস ট্রেনের টিকেট সংক্রান্ত কোন পোষ্ট দেখতাম, তখন মনে মনে আফসোস হত এটা ভেবে যে এবার ঈদে আর নতুন জামা কেনার ইচ্ছে আমার মধ্য আর নাই, বাড়ী যাওয়ার জন্য টিকেট নিয়ে ও আর কোন ঝামেলা নাই।

যায় হোক, এক এক করে শেষ হতে লাগলো প্রবাসে প্রথম রোজা। পাসাও তে তখন আমরা বাংলাদেশী ছিলাম হাতে গোনা কয়েক জন।সবাই মিলে এক সাথে ঈদ উদযাপন করার জন্য পরিকল্পনা করা হলো, কি কি খাওয়া হবে, কে কি রান্না করবে তারও একটা লিস্ট করা হলো। কিন্তু রোজার শেষের দিকে এসে পড়ে গেলাম টেনশনে, যদি রোজা ৩০টা হয় তাহলে ঈদ পড়বে শনিবার আর যদি ২৯টা হয় তাহলে পড়বে শুক্রবার। দুর্ভাগ্যবশত ওই শুক্রবার এবং শনিবার ২ দিনই পড়ে গেলো আমার বাধ্যতামূলক ব্লকড সেমিনার। যেটা শুরু হবে সকাল ৯টা থেকে এবং এক টানা চলবে বিকেল ৫টা পর্যন্ত।

শেষ পর্যন্ত ঈদ পড়লো শুক্রবার। ভেবেছিলাম শনিবার পড়লে, প্রথম দিন আমার প্রেজেন্টেশন দিয়ে ফেলবো এবং প্রফেসরকে অনুরোধ করবো পরের দিন টা যেন আমাকে ছুটি দেয়। ঈদ শুক্রবার হওয়ায় সে আশা আর পূর্ণ হলো না। ঈদের আগের রাতে অনেক রাত পর্যন্ত জেগে সেমিনারের প্রেজেন্টেশন রেডি করলাম। তারপর ঈদের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে ফ্রেস হয়ে, মনের দুঃখে না খেয়ে সেমিনারে চলে গেলাম। কিন্তু কেন জানি বার বার মনের মধ্যে খঁচ খঁচ করছিলো, এটা ভেবে যে আমার ইদ এমন করে ক্লাসেই কাটবে। আমার ক্লাসে আমিসহ আরো ২ জন বাংলাদেশী ছিলো।

আমরা ৩ জন গিয়ে প্রফেসরকে বললাম আজ আমাদের প্রধান ধর্মীয় উৎসব ইদ! এই জন্য আমরা আজ আমাদের প্রেজেন্টেশন দিতে চাচ্ছি না এবং দুপুরে খাবারের বিরতি পর্যন্ত আমরা থাকবো তারপর চলে যাবো।প্রফেসর ও সাথে সাথে রাজী হয়ে গেলেন এবং লান্স ব্রেকের পর আমাদের যাওয়ার অনুমতি দিলেন।এরপর চলে গেলাম হাতে গোনা কয়েক জন বাংলাদেশী মিলে আয়োজন করা ঈদের অনুষ্ঠানে।

খাবারের আয়োজনের মধ্যে ছিলো দেশীয় ইদের খাবার এবং খাওয়া শেষে বিনোদনের জন্য ব্যবস্থা করা হয়েছিলো কিছু ইনডোর গেম।এভাবে পরিসমাপ্তি হলো প্রবাসের প্রথম ঈদ।নিজের মনকে সান্ত্বনা দেওয়ার অদ্ভুত এক যুক্তি দাড় করিয়েছিলাম সেদিন; জীবনের অগ্রগতির জন্য পরিবর্তনের অনিবার্য, তাই পরিবর্তনকে সহজে মেনে নেওয়া ভালো। পরের ঈদে অবশ্য আর এতোটা খারাপ লাগেনি, কারন তত দিনে নিজের মনকে প্রস্তুত করে ফেলেছিলাম।


সর্বশেষ সংবাদ