বিদেশি শিক্ষার্থীদের ব্রিটিশ ভিসা বাতিল ন্যায়সংগত ছিল না
ইংরেজি দক্ষতা যাচাই পরীক্ষায় জালিয়াতির অভিযোগ তুলে যুক্তরাজ্যে হাজার হাজার বিদেশি শিক্ষার্থীর ভিসা অন্যায়ভাবে বাতিল করা হয়েছে।এটা মোটও ন্যায়সংগত হয়নি, এমনটাই উঠে এসেছে তদন্তে। এতে অভিবাসন বিভাগ (হোম অফিস) এবং পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক প্রতিষ্ঠানের নানা অদক্ষতা ও দায়িত্বহীনতার কথাও উঠে এসেছে।
গতকাল শুক্রবার ব্রিটিশ সরকারের কার্যক্রম নজরদারি করা প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল অডিট অফিসের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রায় আড়াই হাজার বিদেশি শিক্ষার্থীকে জোর করে বিতাড়ন করা হয়েছে। গ্রেপ্তার ও বিতাড়নের বিষয়ে হোম অফিসের সতর্কতামূলক চিঠি পাওয়ার পর প্রায় ৭ হাজার ২০০ শিক্ষার্থী নিজ উদ্যোগে দেশে ফিরে গেছেন। যুক্তরাজ্যের আদালতে প্রায় সাড়ে ১২ হাজার শিক্ষার্থীর আবেদনের শুনানি হয়েছে। তাদের মধ্যে এ পর্যন্ত ৩ হাজার ৬শ শিক্ষার্থী আপিলে জয়ী হয়ে ভিসা ফেরত পেয়েছেন।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের বেশির ভাগই দক্ষিণ এশিয়ার। তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশি শিক্ষার্থী আছে, তাদের অনেকেই এখনো যুক্তরাজ্যে ভিসা বাতিলের ঘটনায় আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন।
ন্যাশনাল অডিট অফিস বলছে, ঠিক কতজন শিক্ষার্থী পরীক্ষায় জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন সেটি নিরূপণ করা কঠিন। কিন্তু হোম অফিস যখন ঢালাওভাবে ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত নেয়, তখন ভুক্তভোগীদের নির্দোষ প্রমাণের কোনো সুযোগ দেয়নি। নিরপরাধ শিক্ষার্থীর সংখ্যা যত কমই হোক না কেন, তাদের কল্যাণের বিষয়টি হোম অফিসের বিবেচনায় থাকাটাই কাম্য ছিল।
ন্যাশনাল অডিট অফিস বলছে, ইটিএস-এর দাবি ঠিকমতো যাচাই করেনি হোম অফিস। হোম অফিসের সেই দক্ষতাও নেই। কেবল কথায় ভরসা করে ঢালাও ভিসা বাতিল করা হয়েছে।
এ ছাড়া প্রতিবেদনে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রক ইটিএস-এর বড় ধরনের গলদ ও অদক্ষতা উঠে এসেছে। ইটিএস অন্তত ৬ হাজার পরীক্ষার্থীর নাগরিকত্ব ‘ব্রিটিশ’ বলে নিবন্ধন করেছে। অথচ কোনো ব্রিটিশ নাগরিকেরই এই পরীক্ষা দেওয়ার প্রয়োজন নেই। এ ছাড়া পরীক্ষার্থীদের নাম ও জন্ম তারিখসহ মৌলিক তথ্য নিবন্ধনের ক্ষেত্রে ব্যাপক ভুল-ভ্রান্তি ধরা পড়ে। যে কারণে টোয়েক পরীক্ষা দেননি এমন শিক্ষার্থীও ভিসা বাতিলের শিকার হয়েছেন।
এই প্রতিবেদনের প্রতিক্রিয়ায় হোম অফিস বলছে, ২০১৪ সালের দিকে শিক্ষার্থী ভিসার ব্যাপক অপব্যবহারের ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত প্রতিবেদনেও সংঘবদ্ধ জালিয়াতির কথা উঠে এসেছে। জালিয়াতির সুযোগ করে দেওয়ার কারণে ২৫ জনকে বিচারের মুখোমুখি করার কথাও উল্লেখ আছে।
যুক্তরাজ্যে বিদেশি শিক্ষার্থীদের ভিসার মেয়াদ বৃদ্ধি করতে বা ভিসা পরিবর্তন করতে ইংরেজি দক্ষতার প্রমাণ দিতে হয়। ২০১৪ সালে বিবিসির এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে দেখানো হয় যে ‘টেস্ট অব ইংলিশ ফর ইন্টারন্যাশনাল কমিউনিকেশন’ (টোয়েক) পরীক্ষার ২টি কেন্দ্রে জালিয়াতির ঘটনা ঘটছে। একজনের পরীক্ষা অন্যজন দিয়ে দিচ্ছেন। এমন জালিয়াতির ঘটনা ফাঁস হওয়ার পর সরকার ওই পরীক্ষার মোট ৯০টি সেন্টারই বন্ধ করে দেয়। টোয়েক পরীক্ষার নিয়ন্ত্রক সংস্থা ‘এডুকেশনাল টেস্টিং সার্ভিসকে’ (ইটিএস) বিষয়টি তদন্তের আহ্বান জানায়। সংস্থাটি ২০১১ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫৮ হাজার পরীক্ষার্থীর তথ্য যাচাই করে জানায় যে প্রায় সব পরীক্ষাই (৯৭ শতাংশ) সন্দেহজনক। সংস্থাটি ৫৮ শতাংশ পরীক্ষা অবৈধ ঘোষণা করে। আর ৩৯ শতাংশ পরীক্ষা প্রশ্নবিদ্ধ বলে মত দেয়।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের পক্ষে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন মাইগ্রেশন ভয়েসের পরিচালক নাজেক রমাদান বলেন, দীর্ঘদিন ধরে ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি করে আসছেন তদন্ত প্রতিবেদনে তার প্রমাণ পাওয়া গেল। গত কয়েক বছর ধরে অনেক নির্দোষ শিক্ষার্থী জালিয়াতির কলঙ্কের বোঝা বয়ে বেড়াচ্ছেন। এসব শিক্ষার্থীকে জালিয়াতির অভিযোগ থেকে নিজেদের নাম মুক্ত করতে সুযোগ দেওয়ার পাশাপাশি পড়াশোনা সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
ভুক্তভোগী শিক্ষার্থীদের পক্ষে কাজ করা লেবার দলীয় আইনপ্রণেতা স্টিফেন টিমস গার্ডিয়ানকে বলেন, তদন্ত প্রতিবেদনের ওপর ভিত্তি করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাজিদ জাভিদের একটি বিবৃতি দেওয়ার কথা। শিগগিরই তিনি সেই বিবৃতি দেবেন এবং তাতে নির্দোষ শিক্ষার্থীদের ভোগান্তির অবসান মিলবে বলে আশা প্রকাশ করেন টিমস।
প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগে যুক্তরাজ্যের অভিবাসনের দায়িত্বে (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) ছিলেন থেরেসা মে। শিক্ষার্থীদের ঢালাও ভিসা বাতিলের সিদ্ধান্ত তিনিই দিয়েছিলেন। তার আগে মে প্রায় ১৪শ কলেজের বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তির লাইসেন্স বাতিল করে দেন। এতে আরও হাজার হাজার বিদেশি শিক্ষার্থীকে যুক্তরাজ্য থেকে বিতাড়িত হতে হয়। অভিবাসন নিয়ে তাঁর মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ির কারণেই উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারির মতো বড় ধরনের অন্যায় ঘটে যায়। ১৯৪৮ থেকে ১৯৭৩ সাল সময়ে যুক্তরাজ্যে বসতি গড়া লোকদের অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত করাকেই বলা হচ্ছে উইন্ডরাশ কেলেঙ্কারি। ওই ঘটনার ভুক্তভোগীদের সরকার এখন ক্ষতিপূরণ দিতে বাধ্য হয়েছে।
ব্রেক্সিট নিয়ে গৃহবিবাদের জের ধরে গতকাল শুক্রবার পদত্যাগের ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মে। বিদায় বেলায় মের রাজনৈতিক জীবনের বিশ্লেষণে তাঁর অভিবাসন সংক্রান্ত বিতর্কিত উদ্যোগগুলোও আলোচিত হচ্ছে।