ছাত্রলীগকে ঘিরে অশান্তি, পদ না পেয়ে তাণ্ডব
বাংলাদেশ ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের সারাদেশে কমিটি ঘোষণা নিয়ে এখন চলছে সংঘাত-সংঘর্ষ। ছাত্রলীগে পদ না পেয়ে বঞ্চিতরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, সড়ক-মহাসড়ক, মার্কেটে তাণ্ডব চালাচ্ছে। পুলিশ প্রশাসনও কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে পদবঞ্চিত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীদের হামলায় ক্লাস ও পরীক্ষা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ছাত্রলীগের পদবঞ্চিত সদস্যেরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এলাকায় ভাঙচুর করে ও আগুন জ্বালিয়ে দেয়। তারা বাস ও শাটল ট্রেনে হামলা চালিয়ে বন্ধ করে দেয়। ট্রেনের দুইজন চালককেও অপহরণ করে। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত কোনো মামলা বা কাউকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
এসব হামলাকারীরাই মঙ্গলবার প্রকাশ্যে সংবাদ সম্মেলন করে আপাতত তাদের আন্দোলন স্থগিতের ঘোষণা দিয়েছে। কারণ তাদের সমস্যা সমাধানের আশ্বাস দিয়েছেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। তারা উপমন্ত্রীর অনুসারী।
বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের আরেকটি গ্রুপ সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছিরের অনুসারী। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে গত দুই বছর ছয় মাসে এই কমিটি ইস্যুতে ১৮-২০ বার সংঘাত ও সংঘর্ষ হয়েছে।
আর শুধু চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় নয় এবার নতুন এবং পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা নিয়ে অব্যাহতভাবে সংঘাত সংঘর্ষ চলছে। সড়ক অবরোধ ও দোকান পাট ভাঙচুর হচ্ছে। এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ের কমিটি নিয়েও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে।
চার বছর আগে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হলেও এখনো বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, জেলা ও উপজেলায় কমিটি হয়নি। কয়েকমাস আগে থেকে এই কমিটিগুলো ঘোষণা শুরু হয়। অভিযোগ আছে এইসব কমিটি গঠনে কোনো নিয়ম নীতি মানা হচ্ছের না।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি আল নাহিয়ান খান জয় এবং লেখক ভট্টাচার্য তাদের পছন্দমত লোকজনকে প্যাডে দেয়া চিঠির মাধ্যমে কমিটিতে নিচ্ছেন। এর পেছনে আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ আছে। কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের কাছে তারা এপর্যন্ত কমিটির ১১৩টি চিঠি দেয়ার কথা বললেও বাস্তবে তারা এক হাজারেরও বেশি চিঠি দিয়ে কমিটিতে পদ দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে।
ছাত্রলীগের মোট সাংগঠনিক ইউনিট ১১৩টি এর মধ্যে ৫৫টিরই মেয়াদ নেই। এই ১১৩টি ইউনিট হলো ৮০টি জেলা ও মহানগর এবং ৩৩টি বিশ্ববিদ্যালয়। এর বাইরে উপজেলা, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড ভিত্তিক কয়েকশ কমিটি আছে। সেগুলোরও অধিকাংশের মেয়াদ নেই।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় উপ-সমাজসেবা সম্পাদক তানভীর হাসান সৈকত বলেন, দীর্ঘদিন কমিটি না থাকায় অনেকেই এখন কমিটিতে থাকতে চাচ্ছেন। তবে কমিটি গঠনে আমাদের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের কোনো পরামর্শ নেয়া হচ্ছে না। সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক তাদের ইচ্ছে মত কমিটি গঠন করছেন। এর ফলে কোনো কোনো কমিটিতে বয়স্ক, বিবাহিত ও অছাত্ররা ঠাঁই পাচ্ছেন। কেউ কেউ অর্থ লেনদেনেরও অভিযোগ করছেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় কমিটির এপর্যন্ত কোনো বৈঠক না হওয়ায় আমরা অভিযোগ খতিয়ে দেখার সুযোগ পাইনি।
তার কথা,সএসব কারণে কমিটি ঘোষণার পর নানা ধরনের প্রতিক্রিয়া হচ্ছে। তবেভাঙচুর, হামলা আগুন এগুলো কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
আরও পড়ুন: চবি ছাত্রলীগ মানেই 'সংঘর্ষ'
সাম্প্রতিক সময়ে কমিটি নিয়ে যত সংঘাত-সংঘর্ষ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে একই সময়ে গত রোববার যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি ঘোষণা করা হয়েছে। সেখানে কমিটিতে গণডাকাতি ও হত্যা মামলার দুইজন আসামি শীর্ষ পদে ঠাঁই পেয়েছেন।
পয়লা আগস্ট চট্টগ্রাম উত্তর জেলা ছাত্রলীগে অছাত্র, বিবাহিত ও হত্যা মামলার আসামিদের আশ্রয় দেয়া নিয়ে বিক্ষোভ ও ভাঙচুর হয়। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে কমিটি দেয়ার অভিযোগ করা হয়।
গত ২৫ জুন বরিশালে মহানগর ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে বিক্ষোভ হয়। অছাত্র, বয়স্ক ও বিবাহিতদের কমিটিতে আশ্রয় দেয়ার প্রতিবাদ করেন পদবঞ্চিতরা।
১৪ মে ঢাকার ইডেন কলেজ ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে দুই গ্রুপে উত্তেজনা ও সংঘর্ষ হয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে পুলিশ মোতায়েন করা হয়। পদবঞ্চিতরা নতুন সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের হলের রুমে তালা লাগিয়ে দেয়। ৮ মে চাঁদপুরের ফরিদগঞ্জে ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ে দিনভর সংঘর্ষে ২০ জন আহত হয়।
২০ জানুয়ারি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের কমিটি গঠন নিয়ে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ১৩ জন আহত হন। ৩ জানুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরির ২৬ নাম্বার ওয়ার্ড কমিটি গঠন নিয়ে দুই গ্রুপে সংঘর্ষ হয়। দুই গ্রুপ পাল্টাপাল্টি কমিটি ঘোষণা করে।
গত বছরের ১১ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মহানগরীর ১৩টি ইউনিটের কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিতরা সড়ক অবরোধ করে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ করে।
একই দিনে পটুয়াখালী জেলার মির্জাগঞ্জ উপজেলা কমিটি ঘোষণার পর পদবঞ্চিতরা বিক্ষোভ মিছিল করে এবং পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। ওই বছরের ১১ ডিসেম্বর খুলনার পাইকগাছা উপজেলায় ছাত্রলীগের নতুন কমিটি ঘোষণার পর বঞ্চিততের সঙ্গে সংঘর্ষে চারজন গুরুতর আহত হয়।
ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় নেতারা যা বলেন
এনিয়ে কথা বলার জন্য বার বার চেষ্টা করেও ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে পাওয়া যায়নি। তবে সহ-সভাপতি কামাল খান বলেন, ‘‘এই শোকের মাসে কমিটি ঘোষণার নামে চিঠি উৎসব হচ্ছে। এর ফলে যে প্রতিক্রিয়া হচ্ছে তা নিয়ে আমরা বিব্রত। সভাপতি ও সাধারণ সাধারণ সম্পাদকের স্বেচ্ছাচারিতার কারণে এরকম হচ্ছে।”
তার কথা, প্রত্যেকটা কমিটি ঘোষণার পরই আমরা অছাত্র, বিবাহিত, মামলার আসামিদের কমিটিতে ঠাঁই দেয়ার অভিযোগ পাই। আর্থিক লেনদেনেরও অভিযোগ পাই। তবে এর সব সত্য নয়, কিছু সত্যতা আছে। কমিটি গঠনে কোনো নিয়ম নীতি মানা হচ্ছে না। সিভি দেখে পদ দেয়া হচ্ছে না। আমাদের পরামর্শ নেয়া হচ্ছে না।” তবে তিনি এই তাণ্ডবের বিরুদ্ধে আইনগত ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেয়ার দাবি জানান।
তবে আরেকজন সহ-সভাপতি তানজিদুল ইসলাম শিমুল দাবি করেন, "সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় আছে তাই এর সুফল পেতে সবাই ছাত্রলীগের নেতা হতে চান। ছাত্রলীগে যোগ দিয়েই তারা পদ চান। তাই সমস্যা হচ্ছে। কোনো কমিটি ঘোষণার পরই যারা পদ না পান তারা আর্থিক লেনদেনসহ নানা অভিযোগ তোলেন। বিক্ষোভ করেন। কিন্তু সবাইকে তো আর নেতা বানানো যায় না। আমরা কমিটি গঠনের সময় সিভি দেখেই সিদ্ধান্ত নিই। যারা অভিযোগ করেন তাদের অভিযোগ ঠিক না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েও যারা যোগ্য তাদেরই কমিটিতে নেয়া হয়েছে।”
তিনি জানান, আগামী সেপ্টেম্বরের মধ্যে তারা কমিটি গঠন শেষ করতে পারবেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক রাজু মুন্সী বলেন, পদবঞ্চিতরা প্রতিবাদ করতেই পারেন। কিন্তু তারা যে তাণ্ডব চালিয়েছে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তারা তাদের নেতার নির্দেশে করেছেন। এখন আবার নেতার নির্দেশে থেমেছেন। [সূত্র: ডয়চে ভেলে বাংলা]