চবি ছাত্রলীগ মানেই ‘সংঘর্ষ’
কখনও আধিপত্য বিস্তার, কখনও পূর্ণাঙ্গ কমিটির দাবি, আবার কখনও তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বার বার সংঘর্ষে জড়াচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) শাখা ছাত্রলীগ। এর ফলে বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য বারবার গণমাধ্যমে খারাপ খবরের শিরোনাম হচ্ছে ছাত্রলীগের এই শাখাটি।
এক বছরের জন্য ২০১৯ সালের ১৪ জুলাই চবি শাখা ছাত্রলীগের নতুন নেতৃত্ব আসে। এতে সভাপতি হিসেবে রেজাউল হক রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ইকবাল হোসেন টিপু দায়িত্ব পান। দুই সদস্য বিশিষ্ট কমিটি আড়াই বছর পরও পূর্ণাঙ্গ করতে পারেনি। বরং তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে বার বার সংঘর্ষে জড়াচ্ছে শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা।
সর্বশেষ, গত বুধবার চবির বগিভিত্তিক বিজয় উপ-গ্রুপের সঙ্গে সংঘর্ষ জড়ায় সিএফসির (চুজ ফ্রেন্ডস উইথ কেয়ার) উপ-গ্রুপের কর্মীরা। এ সময় উভয় পক্ষকে দেশীয় অস্ত্র হাতে দেখা যায়। এছাড়া রাতের ট্রেনে সিএফসির এক কর্মীকে মারধরের ঘটনায় স্টেশন চত্বরে অবস্থান নেয় সিএফসি। দুই হলে প্রায় ১২টি ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। পরে পুলিশ ও প্রক্টরিয়াল বডির চেষ্টায় পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়। এ সময় প্রক্টরিয়াল বডির সদস্যরাও সিএফসি কর্মীদের পাথরে আহত হন।
পরে রাত সাড়ে ১২টা থেকে তিনটা পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দী ও শাহ আমানত হলে পুলিশের সহায়তায় তল্লাশি চালায় প্রক্টরিয়াল বডি। এ সময় বেশকিছু দেশীয় অস্ত্র, রামদা, কিরিচ, বটি, গুলতি উদ্ধার করে প্রক্টরিয়াল বডি। তবে কাউকে গ্রেফতার করা সম্ভব হয়নি।
আরও পড়ুন: চবির হলে অভিযান, ককটেলসহ বিপুল পরিমাণ অস্ত্র উদ্ধার
এর আগে মঙ্গলবার তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় শাখা ছাত্রলীগের বিজয় ও সিএফসির উপ-গ্রুপের মধ্যে। পরে সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী হলে বিজয় ও আমানত হলে সিএফসি অবস্থান নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায়। বিবদমান এই দুই উপ-গ্রুপ শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের অনুসারী। ক্যাম্পাসে বিজয় উপ-গ্রুপে সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক মো. ইলিয়াসের ও সিএফসি সভাপতি রেজাউল হক রুবেলের নেতৃত্ব রয়েছে।
তথ্যমতে, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা শিক্ষা উপমন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল (সাবেক মহিউদ্দিন চৌধুরী) ও সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দিনের অনুসারী হিসেবে পরিচিত। এক সময় এরা শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক রাজনীতি করতো।
বগিভিত্তিক এসব গ্রুপের মধ্যে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সংঘাতের প্রেক্ষিতে ২০১৬ সালে শাটল ট্রেনের বগিভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। এরপর থেকে তারা ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে রাজনীতি শুরু করেন। বর্তমানে আওয়ামী লীগের এই দুই নেতার বগিভিত্তিক ৮টিরও বেশি উপ-গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে শাখা ছাত্রলীগে। বর্তমানে তারা ক্যাম্পাস ও আবাসিক হলে সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িত।
এরমধ্যে নওফেলের বিজয় ও সিএফসি উপ-গ্রুপ। অন্যদিকে, আ জ ম নাছিরের অনুসারী নেতাদের নেতৃত্বে একাধিক বগিভিত্তিক গ্রুপ রয়েছে। এরমধ্যে রয়েছে সিক্সটি নাইন, বাংলার মুখ, একাকার, উল্কা, কনকর্ড ও এপিটাফ প্রভৃতি।
আরও পড়ুন: চবিতে আবারও বিজয়-সিএফসির সংঘর্ষ
গত ২৩ ফেব্রুয়ারি সিক্সটি নাইনের জুনিয়র এক কর্মীকে র্যাগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষে জড়ায় বগিভিত্তিক সিক্সটি নাইন ও এপিটাফ। খবর ছড়িয়ে পড়লে সিক্সটি নাইনের কর্মীরা সূর্যসেন হলে আক্রমণ করে। দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এছাড়া সূর্যসেন হলের দরজা, জানালা ও বাইক ভাঙচুর করে সিক্সটি নাইনের কর্মীরা। পরেরদিন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এ ঘটনা খতিয়ে দেখতে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে।
গত ১৮ জানুয়ারি শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠন নিয়ে সংঘর্ষে জড়ায় বিজয় ও সিএফসির নেতাকর্মীরা। সংঘর্ষে দুই পক্ষের অন্তত ১৩ কর্মী আহত হয়েছেন। বিজয়ের নেতাকর্মীদের দাবি, রাত ১২টার দিকে বিনা উস্কানিতে সিএফসির নেতাকর্মীরা সোহরাওয়ার্দী হলের সামনে এসে তাদের নেতাকর্মীর ওপর হামলা করেন। পরে তারা প্রতিহত করেছেন। অন্যদিকে সিএফসির নেতাকর্মীদের ভাষ্য, কয়েক দিন ধরে বিজয়ের নেতা-কর্মীরা ‘স্লেজিং’ করছেন। এ কারণে তারা ‘রিপ্লাই’ দিয়েছেন।
এর আগে ১৩ জানুয়ারি দুপুরে ক্যাম্পাসে এসেছিলেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক হায়দার মোহাম্মদ জিতু ও উপ-সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক শেখ নাজমুল ইসলাম। তবে বিশ্ববিদ্যালয় শাখার পূর্ণাঙ্গ কমিটির দাবিতে তাদের মূল ফটকে আটকে দেন বিভিন্ন উপ-গ্রুপের নেতাকর্মীরা।
এরপর থেকে পরিস্থিতি থমথমে হতে থাকে। এর মধ্যে ১৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে বিজয়ের এক নেতার জন্মদিনে অনুষ্ঠানে ঢিল ছোড়েন বলে অভিযোগ ওঠে সিএফসির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে। সোহরাওয়ার্দী হলের মোড়ে এই জন্মদিনের অনুষ্ঠান চলছিল।
জানা যায়, দুই সদস্যের নতুন কমিটি হওয়ার পর গত আড়াই বছরে এরকম শতাধিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এতে আহত হয়েছে কয়েকশ নেতাকর্মী। জানা গেছে, দীর্ঘদিন পূর্ণাঙ্গ কমিটি না থাকায় চেইন অব কমান্ড নেই শাখাটিতে। অনেকটা নিয়ন্ত্রণহীনভাবেই চলছে শাখা ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম। বগির সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারছে না চবি ছাত্রলীগ। বগিভিত্তিক উপ-গ্রুপগুলো তাদের কার্যক্রম চালিয়েই যাচ্ছে।
উপ-গ্রুপগুলোর দাবি, শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটির কারণেই বার বার সংঘর্ষ হচ্ছে। এতে সাংগঠনিক কোনো ব্যবস্থা হচ্ছে না। বাড়ছে হতাশা-ক্ষোভ। এ সব ঘটনাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তদন্ত কমিটি গঠন করলেও সেটা থেকে ফলপ্রসূ কোনো সমাধান আসেনি। অনেক সময় দেখা যায় এসব ঘটনায় বহিষ্কার করলেও মানবিক আবেদনে সেটি মওকুফ হয়ে যাচ্ছে।
চবি শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, পূর্ণাঙ্গ কমিটি না হওয়াতে অনাকাঙ্খিত এসব ঘটনা ঘটার একটি কারণ হতে পারে। তবে আমরা চেষ্টা করছি দ্রুত কমিটি পূর্ণাঙ্গ করতে। এজন্য সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে আমরা নিয়মিত যোগাযোগ রাখছি। তাছাড়া কেন্দ্রীয় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গেও আমাদের কথা হচ্ছে।
“তাছাড়া ক্যাম্পাসে নিয়মিত যারা সংঘর্ষে লিপ্ত হচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে যদি আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হতো তাহলে এটা পুনরায় হতো না। এছাড়াও আবার অনেকের রাজনৈতিক ব্যাকগ্রাউন্ড নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। বর্তমানে ছাত্রলীগ পরিচয়ে যেই হারে দলে অনুপ্রবেশ করছে তার নিয়েও আমরা শংকিত। এসব বিষয়ও আমরা মনিটর করছি।”
তিনি বলেন, অপরাধ করে কেউ যদি পার পেয়ে যায় তাহলে পরবর্তীতে তার অপরাধ আরও বৃদ্ধি পায়। তাই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে বলেছি, এসব ঘটনায় যেন দৃশ্যমান শাস্তিযোগ্য কোন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাহলে তা অনেক কমে যাবে।
আরও পড়ুন: চবিতে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ
এদিকে, গত ১৩ জানুয়ারি সাংগঠনিক দায়িত্ব পাওয়ার পর প্রথমবারের মতো চবি ক্যাম্পাসে সাংগঠনিক সফরে আসেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রতিনিধি দল। কেন্দ্রীয় নেতারা ক্যাম্পাসে আসলে তাদের পথ অবরুদ্ধ করে পূর্ণাঙ্গ কমিটির দাবিতে প্ল্যাকার্ড ও স্লোগান দেন পদপ্রত্যাশীরা।
ওইদিন চবিতে আসেন চবি শাখা সাংগঠনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের প্রশিক্ষণ সম্পাদক হায়দার রহমান জিতু ও উপ-সাংস্কৃতিক সম্পাদক শেখ নাজমুল। তারা ২৫ জানুয়ারির মধ্যে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করবেন বলে আশ্বাস দেন সভাপতি রেজাউল হক রুবেল ও সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হোসেন টিপুকে। কিন্তু আজও হয়নি পূর্ণাঙ্গ কমিটি।
কেন চবি ছাত্রলীগের কমিটি পূর্ণাঙ্গ হচ্ছে, জানতে চাইলে শাখা হায়দার রহমান জিতু দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, দীর্ঘদিন ধরে কমিটি কেন্দ্রীক চাওয়া-পাওয়া নিয়ে অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলো ঘটছে। তবে কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার লক্ষ্যে বর্তমানে আমরা কাজ করছি। গত জানুয়ারিতে দায়িত্ব পেয়ে সেখানেও আমরা গিয়েছি।
চবি শাখা ছাত্রলীগের প্রতি বর্তমানে আমাদের দুটি মেসেজ থাকবে— কোন ব্যক্তি কিংবা কোন গ্রুপ, উপ-গ্রুপ ছাত্রলীগের নামে সংঘর্ষে জড়ালে এক্ষেত্রে কঠোর হস্তে ব্যবস্থা নেবে কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ। অপরটি, কমিটি পূর্ণাঙ্গ করার জন্য শাখা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে আগামী ১৮ মার্চের মধ্যে (পদপ্রত্যাশীদের) নাম জমা দিতে বলেছি। জমা দিলেই শিগগির কেন্দ্রীয় সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের কাছে অনুমোদনের জন্য নেওয়া হবে।
বিশ্বিবদ্যালয় প্রশাসন নির্বিকার
পান থেকে চুন খসা মাত্রই ছাত্রলীগের উপ-গ্রুপগুলো সংঘর্ষে জড়ালেও নির্বিকার থাকে প্রশাসন। এসব ঘটনায় ব্যবস্থা নেয়া তো দূরের কথা অধিকাংশ ঘটনায় তদন্ত কমিটিও গঠন করা হয় না। সর্বশেষ ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায় গত বছর ১৭ অক্টোবর রাতে ১২ ছাত্রলীগকর্মীকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিভিন্ন মেয়াদে বহিষ্কার করে বিশ্ববিদ্যালয় কতৃপক্ষ।
নিয়মানুযায়ী বহিষ্কারদেশ প্রদান করার সাথে সাথে চিঠি দিয়ে বহিষ্কৃত শিক্ষার্থী, তার বিভাগ ও অভিভাবককে জানানোর কথা থাকলেও রহস্যজনকভাবে দেড়মাস পর চিঠি পাঠানো হয়েছে।
বহিষ্কারাদেশ চলাকালে সব ধরনের একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ না নেওয়ার কথা থাকলেও বেশ কয়েকজন বর্ষ ফাইনাল পরীক্ষায় অংশ নিয়েছেন। সর্বশেষ গত ১৫ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া স্বাক্ষরিত ভিন্ন ভিন্ন চিঠিতে মানবিক দিক বিবেচনায় বহিষ্কৃতদের বহিষ্কারদেশ প্রত্যাহার করা হয়। তবে কিসের ভিত্তিতে এই বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হয়েছে তা চিঠিতে উল্লেখ করা হয়নি।
চবির জৈষ্ঠ্য শিক্ষকদের দাবি, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন যদি সংঘর্ষের ঘটনায় জড়িতদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনতো তবে, সংঘর্ষের ঘটনা অনেকটা কমে যেতো।
তবে চবির প্রক্টর রবিউল হাসান ভূঁইয়া গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন, ক্যাম্পাসে সংঘর্ষে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তাছাড়া সংঘর্ষের পর নিয়মিত আবাসিক হলগুলোতে অভিযান চালানো হয়।