ক্যাম্পাস খোলার আগেই নজরদারিতে ছাত্রনেতারা
দীর্ঘ দেড় বছর পর আগামী ১২ সেপ্টেম্বর থেকে সব স্কুল-কলেজ খুলে দেওয়া হচ্ছে। আর শিক্ষার্থী করোনার টিকা নিশ্চিত করে আগামী অক্টেবারে খুলবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। এসময়ে আন্দোলনের নামে ক্যাম্পাসে ক্যাম্পাসে বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা যেকোনো ধরনের সংঘর্ষ কিংবা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরকারকে এ ব্যাপারে সতর্ক করে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থা প্রতিবেদন জমা দিয়েছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে র্যাব-পুলিশসহ সব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে সর্বোচ্চ সজাগ থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
সে অনুযায়ী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের সব উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের কড়া নজরদারিতে রাখার প্রস্তুতি নিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। একই সঙ্গে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির নেপথ্যদের চিহ্নিত করে তাদের গতিবিধিও নজরদারির প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। কঠোরভাবে মনিটরিং করা হবে মাদ্রাসার শিক্ষক ও ছাত্রনেতাদের গতিবিধি। বিশেষ করে জামায়াত ও হেফাজতে ইসলামের নেতাদের সব ধরনের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে।
শঙ্কা করা হচ্ছে, তারা আগেভাগেই নানা ষড়যন্ত্রের ছক সাজাচ্ছে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগেই তা বাস্তবায়ন করতে পারে। জানা গেছে, এ ব্যাপারে এরই মধ্যে সারাদেশে পুলিশ সুপারদের (এসপি) বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে যেসব জেলায় বড় পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, ওইসব জেলার আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে বেশি সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। স্পেশাল ব্রাঞ্চ (এসবি) ও জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা সংস্থা (এনএসআই) এ ব্যাপারে আগাম তথ্য সংগ্রহে এরই মধ্যে মাঠে নেমেছে।
এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগও এ ব্যাপারে দলীয় নেতাকর্মীদের সজাগ থাকার নির্দেশ দিয়েছে। ষড়যন্ত্রকারীরা শিক্ষাঙ্গনে কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির অপচেষ্টা চালালে তা যাতে শক্ত হাতে তাৎক্ষণিক দমন করা যায়, সে ব্যাপারে প্রস্তুত থাকার তাগিদ দিয়েছে।
সম্প্রতি ছাত্রলীগের এক আলোচনা সভায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, শিগগিরই বিশ্ববিদ্যালয় খুলছে। বিশ্ববিদ্যালয় খুললে অনেক অপশক্তি এবার মাঠে নামবে, চ্যালেঞ্জ করবে। তারা প্রস্তুতি নিচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয়কে ঘিরেই তারা অস্থিতিশীলতা তৈরি করবে। শেখ হাসিনার সরকারকে হটানোর জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, এখনো বাংলার আকাশে ষড়যন্ত্রের গন্ধ। সতর্ক থাকতে হবে। সামনের দিনে আরও চ্যালেঞ্জ আছে। দক্ষিণ এশিয়ার একটি দেশে ক্ষমতার পরিবর্তনের পর একটি গোষ্ঠী উচ্ছ্বসিত। এখানে তাদের মতলবটা কী? শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খোলার প্রস্তুতি চলছে। ফলে অনেক অস্থিরতা সৃষ্টি হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার প্রস্তুতির সঙ্গে সঙ্গে তারা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির প্রস্তুতি নিচ্ছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চের একটি সূত্র জানায়, সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর ছাত্র সংগঠনের প্রথম সারির নেতাদের ওপর নজরদারি বাড়ানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা রয়েছে। বিশেষ করে ছাত্রদল ও ছাত্র শিবিরের নেতাদের গতিবিধি কঠোরভাবে নজরদারি করতে বলা হয়েছে। সে অনুযায়ী তারা মাঠে কাজ করছেন।
সূত্রটি জানায়, গোয়েন্দারা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্যেক ছাত্র সংগঠনের নেতাদের পৃথক তালিকা তৈরি করছে। একই সঙ্গে তাদের প্রিভিয়াস ক্রাইম রেকর্ড (পিসিআর) খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিগত সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত বিভিন্ন নৈরাজ্যকর ঘটনায় কার-কী ভূমিকা ছিল, তাও সুনির্দিষ্টভাবে নিরূপণ করছেন গোয়েন্দারা। অল্প সময়ের মধ্যে এ কার্যক্রম শেষে সমন্বিত একটি তালিকা তৈরি করা হবে।
এদিকে উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের হলগুলো খুলে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে গোয়েন্দারা যাতে আবাসিক ছাত্রদের গতিবিধি কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে ব্যাপারে সর্বোচ্চ প্রস্তুতি রাখা হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, হলগুলো থেকেই বিশ্ববিদ্যালয়কেন্দ্রিক বিশৃঙ্খলার সূত্রপাত হয়ে থাকে। তাই তারা যদি আবাসিক ছাত্রদের গতিবিধি আগে থেকেই সঠিকভাবে মনিটর করতে পারেন তবে তাদের পক্ষে শিক্ষাঙ্গনে নৈরাজ্য সৃষ্টি করা ততটা সহজ হবে না।
এনএসআইয়ের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলেন, মাঠপর্যায় থেকে তারা যে তথ্য পেয়েছেন, তাতে ছাত্র সংগঠনের ব্যানারে আন্দোলনের নামে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির ছক সাজানো হলেও তাদের ইস্যুগুলো ছাত্র অধিকার সংশ্লিষ্ট নয়। তারা মূলত সরকারের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও দুঃশাসনের অভিযোগ তুলে আন্দোলনে নামার পরিকল্পনা করছে।
গোয়েন্দাদের এ আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা কারও কারও বক্তব্যে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। গত ২ সেপ্টেম্বর ঢাবি ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে ছাত্রফ্রন্টের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক শোভন রহমান বলেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুললে এবার সরকারের দুর্নীতি-দুঃশাসনের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরের বক্তব্যে একই ধরনের আভাস পাওয়া গেছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার পদমর্যাদার এক কর্মকর্তা বলেন, বিভিন্ন আন্দোলনের সূতিকাগার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। এ কারণে তারা সর্বোচ্চ সজাগ রয়েছে। বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতা ও ক্যাডার, যারা বিভিন্ন সময় নানা নৈরাজ্যকর ঘটনায় নেতৃত্ব দিয়েছে তাদের তালিকা হাতে নিয়ে এরই মধ্যে নজরদারির প্রস্তুতি চূড়ান্ত করেছেন। বিশ্ববিদ্যালয় খোলার আগে থেকেই তারা মনিটরিং কার্যক্রম শুরু করবেন। করোনা মহামারির এই দুঃসময়ে কোনো ইস্যুতে যাতে শিক্ষাঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে না ওঠে সে ব্যাপারে তারা সর্বোচ্চ তৎপর থাকবেন।
ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) কৃষ্ণপদ রায় বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সব সময়ই সরকারবিরোধী সব ধরনের কর্মকান্ডের ওপর গোয়েন্দা নজরদারি থাকে। তবে দীর্ঘদিন পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কারণে সরকারবিরোধী ছাত্র সংগঠনের ওপর বিশেষ নজরদারি রয়েছে। বিশেষ করে হেফাজতে ইসলামের ছাত্রনেতা ও শিক্ষকদের কড়া নজরদারিতে রাখা হয়েছে। তারা যাতে কোনো ধরনের নাশকতামূলক কর্মকান্ড ঘটিয়ে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে না পারে।