জাকসুতে ছাত্রশিবিরের জয়ের ৫ কারণ
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে ইসলামী ছাত্রশিবির। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) নির্বাচনের পর এবার জাকসুতেও সংগঠনটির জয়জয়কার দেখা গেল। দীর্ঘদিন যেখানে ছাত্রশিবির কার্যত ‘অলিখিত নিষিদ্ধ’ ছিল, সেখানে তাদের এই ফলাফলকে যুগান্তকারী অর্জন হিসেবে দেখেছেন বিশ্লেষকেরা। তারা মনে করছেন, দীর্ঘ পরিকল্পনা, শক্তিশালী নেটওয়ার্ক, আবাসিক ও অনাবাসিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ, ছাত্রী সংগঠনের সক্রিয় ভূমিকা এবং ঐক্যবদ্ধ রাজনীতিই শিবিরকে এই অভাবনীয় সাফল্য এনে দিয়েছে।
দীর্ঘ তিন দশক পর অনুষ্ঠিত জাকসু নির্বাচনে ভোট গ্রহণ শুরুর পর কারচুপির অভিযোগ তুলে ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলসহ পাঁচটি প্যানেল নির্বাচন বর্জন করে। বর্জনকারীদের মধ্যে ছিল প্রগতিশীল শিক্ষার্থীদের ‘সম্প্রীতির ঐক্য’, বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের ‘সংশপ্তক পর্ষদ’, এবং স্বতন্ত্রদের ‘অঙ্গীকার পরিষদ’। দীর্ঘ ৪৮ ঘণ্টা অপেক্ষার পর ফলাফল ঘোষণা করা হয়। যদিও কিছু অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার অভিযোগ ওঠে, তবু অনেকে মনে করছেন নির্বাচন মোটামুটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষভাবে সম্পন্ন হয়েছে।
ঘোষিত ফলাফল অনুসারে, জাকসুর কেন্দ্রীয় সংসদের মোট ২৫টি পদের মধ্যে ২০টিতে জয়ী হয়েছে ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’। বাকি ৫টির মধ্যে ২টি পদে জয়ী হয়েছেন স্বতন্ত্র প্রার্থী এবং ৩টিতে জয় পেয়েছে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ। শনিবার (১৩ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৭টার দিকে সিনেট ভবনে জাকসু নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল ঘোষণা করেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার অধ্যাপক মনিরুজ্জামান।
ফলাফলে দেখা যায়, স্বতন্ত্র প্যানেল থেকে সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে জয়ী হয়েছেন আব্দুর রশিদ জিতু। তিনি আগে ছাত্রলীগের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত থাকলেও পরে ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ছাত্রশিবির সমর্থিত ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ প্যানেল থেকে সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে ৩৯৩০ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন মাজহারুল ইসলাম। এ ছাড়া এজিএস (পুরুষ) পদে ২৩৫৮ ভোট পেয়ে জয়ী হয়েছেন ফেরদৌস আল হাসান এবং এজিএস (নারী) পদে ৩৪০২ ভোট পেয়ে নির্বাচিত হয়েছেন আয়েশা সিদ্দিকা মেঘলা।
তথ্যমতে, জাকসুর মোট ২৫টি পদের মধ্যে সম্পাদকীয় পদ ১৮টির মধ্যে ১৫টিতেই এবং কার্যকরী ৬ পদের মধ্যে ৫টিতেই জয় পেয়েছে ছাত্রশিবির সমর্থিত প্যানেল ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় (জাবি) দেশের একমাত্র পূর্ণাঙ্গ আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে পরিচিত। এখানকার ছাত্ররাজনীতির ইতিহাসও সমৃদ্ধ। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ থেকে শুরু করে সাম্প্রতিক গণ-অভ্যুত্থান পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। ১৯৯২ সালে ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান কবির হত্যাকাণ্ডকে অনেকেই জাবির ছাত্ররাজনীতির বড় মোড় পরিবর্তনের ঘটনা হিসেবে দেখেন। অভিযোগ ওঠে ছাত্রশিবিরের বিরুদ্ধে এবং এরপর থেকে সংগঠনটি কার্যত ক্যাম্পাসে ‘নিষিদ্ধ’ হয়ে যায়। কয়েক দশক ধরে প্রকাশ্যে তাদের উপস্থিতি দেখা যায়নি। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময় কঠোর দমননীতি তাদের কার্যক্রমকে আরও সীমিত করে। তবে গোপনে ছাত্রলীগের ছায়ায় মিশে রাজনীতি ধরে রেখেছিল শিবিরের একটি গ্রুপ। আবার ক্যাম্পাসের বাইরে থেকে ক্লাস-পরীক্ষার ফাঁকে রাজনীতি-নিরপেক্ষ শিক্ষার্থীদের মধ্যে নিজেদের প্রতি সহানুভূতি তৈরি করেছে একটি গ্রুপ। এর আগে বিএনপির সময়েও শিবিরের একটি গ্রুপের নেতাকর্মীরা সেই দলটির নেতাকর্মীদের সঙ্গে মিশে গিয়েছিল।
২০২৪ সালের জুলাই–আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের পর রাজনৈতিক অঙ্গন উন্মুক্ত হলে শিবির প্রকাশ্যে আসে। এক বছরের মধ্যে তারা নিজেদের সংগঠনকে শক্তিশালী করে দৃশ্যমান করে তোলে। এর ফলেই জাকসু নির্বাচনে ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী জোট’ গঠন করে তারা অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করে। তাদের জয়ী হওয়ার পেছনে কিছু কারণ উল্লেখ করেছেন বিশ্লেষকেরা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও জাবির সাবেক শিক্ষার্থী এস এম তৌফিকুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের পতনের পর আন্ডারগ্রাউন্ড থেকে প্রকাশ্যে আসা, লিবারেল অ্যাপ্রোচ গ্রহণ, ব্যক্তিগত ইমেজ ও সংকটকালে পাশে থাকার কৌশলই শিবিরকে জয়ী করেছে। অন্যদিকে, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা সাফিউল হাসান চিশতীর মতে, জাবিতে শিবির সবসময়ই ছিল; শুধু আড়ালে রাজনীতি করেছে। আশপাশের গ্রামে তাদের শক্ত ঘাঁটি রয়েছে, যা পতনের পর আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে।
বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় শিক্ষার্থী সংসদ (জাকসু) নির্বাচনে ছাত্রশিবিরের জয় কেবল কৌশল বা কাকতালীয় নয়। এর পেছনে রয়েছে ছাত্রশিবিরের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা, সংগঠিত নেটওয়ার্ক ও কার্যকর কর্মকাণ্ড।
কৌশলী ও পরিকল্পিত রাজনীতি
নব্বইয়ের দশকের পর থেকে জাবি ক্যাম্পাসে গোপনে তাদের কার্যক্রম চালু ছিল এবং ধীরে ধীরে নেটওয়ার্ক বাড়ানো হয়েছে। দীর্ঘ দেড় দশক ধরে আওয়ামী লীগের শাসনামলে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র আধিপত্য থাকলেও শিবির গোপনে ছাত্রলীগের সঙ্গে মিশে রাজনীতি সচল রাখে। ছাত্রশিবিরের একাধিক নেতার মতে, এটা তাদের কৌশল ও পরিকল্পনার অংশ ছিল। অনেকে অভিযোগ করেন, যারা ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রলীগ থেকে পদত্যাগ করেছেন, তাদের মধ্যেও গোপনে শিবিরের সংযোগ ছিল। আবাসিক হলে থেকে রাজনীতি চালিয়ে শিবির সবসময় ক্যাম্পাসে উপস্থিত ছিল।
গণরুম ও জোর করে মিছিলে নেওয়ার সংস্কৃতির বিরোধিতা
জাবি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হলেও প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থীদের অনেককে গণরুমে থাকতে হয় এবং জোর করে মিছিলে নেওয়া হয়। ক্ষমতাসীন ছাত্রসংগঠনের নেতারা নিজের রুম একাই দখল রাখেন, অন্য শিক্ষার্থীদের বাধ্য করেন গণরুমে থাকার জন্য। এই সংস্কৃতির বিরোধিতাই সাধারণ শিক্ষার্থীদের মনে আস্থা তৈরি করেছে এবং শিবিরের পক্ষে ভোটের কারণ হিসেবে কাজ করেছে।
ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলকে একই কাতারে বিচার
শিবিরের প্রচারণায় বলা হয়, আদর্শ ও আচরণগত দিক থেকে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলের মধ্যে তেমন তফাৎ নেই। গণরুম, গেস্ট কালচার, জোর করে মিছিলে নেওয়া, চাঁদাবাজি ও টেন্ডারবাজিসহ নানা অনিয়মের প্রভাব শিক্ষার্থীদের আস্থা শিবিরের দিকে নিয়ে এসেছে।
ছাত্রীসংস্থার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা
জাবির অর্ধেক শিক্ষার্থী নারী এবং তাদের অধিকাংশই আবাসিক। নারী হলগুলোতে শিবিরের নারী শাখা আগেই তৎপর ছিল। জুলাই গণঅভ্যুত্থানের পর কার্যক্রম আরও বৃদ্ধি পায়। শিবিরের প্যানেলে নারী প্রার্থী ছিলেন ৬ জন, যারা সকলেই জয়ী হয়েছেন। বেশ কয়েকজন প্রার্থী সাধারণত বোরকা বা হিজাব পরিধান করেন না। অনেকের আশঙ্কা ছিল, শিবির জয়ী হলে মেয়েদের পোশাক পরিধানে চাপ দেওয়া হতে পারে। তবে ছাত্রশিবির নিশ্চিত করেছে, জাবিতে নারীরা স্বাধীনভাবে পোশাক পরবেন। তাদের সব ধরনের নিরাপত্তা দেবে ছাত্রশিবির। এ ভরসাতেই নারী শিক্ষার্থীরা তাদের ভোট দিয়েছেন।
গণঅভ্যুত্থান ও শিক্ষার্থীদের আস্থা অর্জন
ছাত্রশিবিরের নেতাকর্মীরা জুলাইয়ের গণঅভ্যুত্থানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। গণঅভ্যুত্থানের ‘স্পিরিট’ ধরে রাখতে এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থে তারা বিভিন্ন সহযোগিতা করেছেন। আবাসিক হলের গণরুম বন্ধ, ক্যাম্পাসে অনুষ্ঠান আয়োজন, গরিব ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সহায়তা—সবই শিক্ষার্থীদের আস্থা ও ভরসা তৈরি করেছে। ফলে ভোটে তাদের সমর্থন আরও দৃঢ় হয়েছে। জাকসুতে তাদের রীতিমতো ভোটবিপ্লব হয়েছে।