লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারল কি ছাত্রসংগঠনগুলো?
ছয় বছর পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ (ডাকসু) ও হল সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে আগামী ৯ সেপ্টেম্বর। এরই মধ্যে প্রার্থিতা ও ভোটার তালিকা চূড়ান্ত হয়েছে। শুরু হয়েছে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রচার-প্রচারণাও। ডাকসু নির্বাচনের ঐতিহাসিক তাৎপর্য থাকার কারণে বরাবরই জাতীয় রাজনীতিতে এটি বেশ প্রভাব ফেলে। ২০২৪ সালের জুলাই গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এবারের ডাকসু নির্বাচন একটু আলাদাভাবেই দেখা হচ্ছে।
এবার ডাকসু নির্বাচনে অন্তত ১০টি প্যানেল অংশ নিচ্ছে, অন্যরা স্বতন্ত্রভাবে অংশ নিচ্ছে। প্যানেলগুলোর মধ্যে রয়েছে জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল, ছাত্রশিবিরের নেতৃত্বে ‘ঐক্যবদ্ধ শিক্ষার্থী জোট’, বামধারার ছাত্রসংগঠনগুলো থেকে দুটি প্যানেল—বামপন্থী সাত সংগঠনের যৌথ প্যানেল ‘প্রতিরোধ পর্ষদ’, বামপন্থী তিন সংগঠনের প্যানেল ‘অপরাজেয় ৭১-অদম্য ২৪’, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের (বাগছাস) ‘বৈষম্যবিরোধী শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের প্যানেল,ছাত্র অধিকার পরিষদের ‘ডাকসু ফর চেঞ্জ’ প্যানেল, উমামা ফাতেমার ‘স্বতন্ত্র শিক্ষার্থী ঐক্য’ প্যানেল, জামাল উদ্দিন খালিদের ‘সমন্বিত শিক্ষার্থী সংসদ’ প্যানেল, জুবায়ের-মোসাদ্দেকদের স্বতন্ত্র প্যানেল।
জুলাই অভ্যুত্থানে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে আশা করা হচ্ছিল ছাত্ররাজনীতিদে দলীয় রাজনীতি মুক্ত থাকবে। লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি থেকে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু আদৌ সে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য কতটা অর্জিত হলো তার একটি ‘অ্যাসিড টেস্ট’ এবারের ডাকসু নির্বাচন। এবারের ডাকসু নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত ছাত্রসংগঠনগুলোর ওপর দলীয় প্রভাব কেমন তা নিয়ে আজকের এই বিশেষ পর্ব।
বিএনপির সহযোগী সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল। ডাকসুতে ছাত্রদলের প্যানেলে এবার সহ-সভাপতি (ভিপি) পদে নির্বাচন করছেন আবিদুল ইসলাম খান এবং সাধারণ সম্পাদক (জিএস) পদে নির্বাচন করছেন তানভীর বারী হামিম এবং সহ-সাধারণ সম্পাদক (এজিএস) পদে নির্বাচন করছেন তানভীর আল হাদি মায়েদ। ছাত্রদলের প্যানেল ঘোষণা থেকে শুরু করে এখন পর্যন্ত সরব রয়েছে তাদের মাদার সংগঠন বিএনপি।
শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিব হলে ছাত্রদলের নেত্রীদের মনোনয়নপত্র তুলতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ তুলে ছাত্রদল। পরে এ বিষয়ে বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবীর রিজভী অভিযোগ করেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে (ডাকসু) অংশ নিতে ছাত্রদল যাতে মনোনয়নপত্র কিনতে না পারে, সে জন্য ‘মব’ তৈরি করা হয়েছে। তিনি বলেন, এই ডাকসু নির্বাচন সেখানে যাতে ছাত্রদল মনোনয়নপত্র কিনতে না পারে, সে জন্য মব তৈরি করে বাধা দেওয়া হচ্ছে, সেখানে মব সৃষ্টি করা হলো।
গত ১৯ আগস্ট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও ডাকসুর ভিপি প্রার্থী আবিদুল ইসলাম খান সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমরা এখন শুধু মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করছি। তবে কারা কোন পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন, সেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান দেবেন। কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের ভিত্তিতেই ডাকসুতে ছাত্রদলের প্যানেল গঠিত হবে।’
অন্যদিকে ছাত্রদলের জিএস প্রার্থী ২১ আগস্ট বিকেলে শেখ তানভীর বারী হামীম তার ফেসবুকের ভেরিফায়েড আইডিতে ডাকসুতে ভোট চেয়ে একটি পোস্টার শেয়ার করেন। সেখানে তিনি লেখেন, ‘আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ঢাবি শিক্ষার্থীরা তাদের জবাব ব্যালটে প্রতিফলিত করবেন। আমার আস্থার জায়গা আপনারাই।’ পোস্টারের তিনি জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের ছবি সংযুক্ত করেন। যদিও আলোচনা-সমালোচনার পর তিনি পোস্টার থেকে তিনজনের ছবি সরিয়ে নতুন আরেকটি পোস্টার শেয়ার করেন।
বিএনপির সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোও ছাত্রদলের প্যানেল নিয়ে সরব রয়েছে। বিএনপির ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ও BNP Media Cell-এর পেজ থেকে গত কয়েক দিনে ডাকসু সম্পর্কিত একাধিক পোস্ট করা হয়েছে। এ ছাড়া ফটোকার্ড, ভিডিও, লাইভ স্টিমিং করা হয়েছে এসব পোস্টে। কোনো পোস্টের ক্যাপশনে লিখছে, ‘প্রতিশ্রুতি নয়, পরিবর্তনে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ডাকসু ও হল সংসদ নির্বাচন-২০২৫ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল মনোনীত আবিদ-হামিম-মায়েদ পরিষদে রায় দিন।’ কোনো কোনো পোস্টে তিন শীর্ষ প্রার্থীর ছবি দিয়ে লিখছে, ‘WE WILL BE YOUR VOICE.’ কোনো পোস্টে গণতন্ত্র, বহু মত ও মতাদর্শের পারস্পরিক সহাবস্থান, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মানসম্মত উচ্চশিক্ষা, হলগুলোতে মানসম্মত আবাসন ও খাবার, শিক্ষার্থীবান্ধব ছাত্ররাজনীতি, উন্নত সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চা, বৈচিত্র্যময় ও নিরাপদ ক্যাম্পাস বিনির্মাণের লক্ষ্যে দেশের বৃহত্তম ছাত্রসংগঠন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল সমর্থিত প্যানেলকে জয়যুক্ত করার আহ্বান করা হয়েছে।
বিএনপি নেতা ও ঢাকা দক্ষিণের সাবেক মেয়র প্রার্থী ইশরাক হোসেন তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ ‘Ishraque Hossain-ইশরাক হোসেন’ থেকে ছাত্রদলের প্যানেলের সব প্রার্থীকে আলাদা আলাদা ফটোকার্ড তৈরি করে শেয়ার দিয়েছেন। ক্যাপশনে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের প্যানেল। ডাকসু নির্বাচন ২০২৫।’
বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ফেসবুক ভেরিফায়েড পেজ ‘Tarique Rahman’ থেকে একটি ভিডিও ক্লিপ শেয়ার করা হয়েছে। ৩ আগস্ট দেওয়া এক বক্তব্যের খণ্ডিত অংশে তিনি বলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আবাস সংকট নিরসন ও খাবারের মান বাড়াতে হলগুলোতে বিদ্যমান সমস্যা এবং সমাধানের একটি লিখিত প্রস্তাবনা বিএনপির কাছে ছাত্রদলের মাধ্যমে উপস্থাপনের জন্য শিক্ষার্থীদের আহ্বান জানান।
এ থেকে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রদলের যেমন তাদের মাদার সংগঠন বিএনপির ওপর নির্ভরতা রয়েছে, তেমনিভাবে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রদল নিয়ে বিএনপির অতি উৎসাহ, উদ্দীপনা রয়েছে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম সদস্যসচিব মাহিন সরকারকে দলের অমতে ডাকসুতে প্রার্থী হওয়ায় বহিষ্কারও করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে 'গুরুতর শৃঙ্খলা ভঙ্গের' অভিযোগ এনে এ বহিষ্কার করা হয়। অন্যদিকে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ মঙ্গলবার (২৬ আগস্ট) বাগছাস (বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্রসংসদ) প্যানেলের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদেরের একটি ফেসবুক পোস্ট শেয়ার করে নিজের ফেসবুক পেজ থেকে লেখেন, ‘ডাকসুতে ভোটার হইনি, তবে প্রার্থীর আধিক্য দেখে মনে হচ্ছে ভোটার হওয়া উচিত ছিল।’
পোস্টের শেষে আব্দুল কাদেরকে মেনশন করে শুভকামনাও জানান তিনি। তবে কিছুক্ষণের মধ্যেই সেই স্ট্যাটাসের স্ক্রিনশট সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। বিষয়টি নিয়ে নানা মহল থেকে সমালোচনা শুরু হলে আসিফ মাহমুদ পোস্টটি ডিলিট করে দেন। পরে এনসিপির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ বাগছাসের ভিপি প্রার্থী আব্দুল কাদেরকে শুভকামনা জানান।
ছাত্রদল ও বাগছাস ব্যতীত ডাকসুতে অন্য প্যানেলগুলোর মধ্যে ইসলামী ছাত্রশিবিরের মূল দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র আন্দোলনের মূল দল ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, ছাত্র অধিকার পরিষদের মূল দল গণঅধিকার পরিষদ ও বামধারার ছাত্রসংগঠন নিয়ে তাদের মূল সংগঠনগুলোর ওভাবে এখনো সরব হতে দেখা যায়নি। তাই দলীয় রাজনীতির লেজুড়বৃত্তিক থেকে ছাত্রসংগঠনগুলো বের হতে পারবে কি না, তা এখনি বলা যাচ্ছে না।
স্বতস্ত্রভাবে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করা জুলাই ঐক্যের অন্যতম সংগঠক মোসাদ্দিক আলী ইবনে মোহাম্মদ বলেন, ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির অতীত কর্মকাণ্ড নিয়ে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা ট্রমা রয়েছে। দীর্ঘ ১৫ বছর আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্যাতনের স্বীকার হয়েছি। এরপর আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, ক্যাম্পাসে আর লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি চাই না। পরবর্তী সময়ে অধিকাংশ ছাত্রসংগঠন সোশ্যাল কন্টাক্টের মাধ্যমে একমত হয়েছে যে তারা হল ও অ্যাকাডেমিক এরিয়ায় রাজনৈতিক আবহের বাইরে রাখবে এবং লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতি পরিহার করবে। তারপরও কিছু সংগঠন নামে-বেনামে শিক্ষার্থীদের ম্যান্ডেডের বাইরে গিয়ে হল ও ক্যাম্পাসে রাজনীতির চেষ্টা করছে, যার আমরা তীব্র নিন্দা জানাই। তাদের মধ্যে যে প্রয়োজনীয় সংস্কার দরকার ছিল, তা আমরা অভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছরেও দেখতে পাইনি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের প্রত্যাশা ছিল, ডাকসু কেন্দ্রিক ছাত্ররাজনীতি পরিচালিত হবে। গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছর পর তার কিছুটা আমরা দেখতে পারছি। যা আমাদের কিছুটা হলেও আশাবাদী করছে।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আইনুল ইসলাম বলেন, ‘ডাকসু একটি অ্যাসিড টেস্ট। ডাকসুর মধ্যে দিয়ে আমরা দেখতে পাচ্ছি, ওই লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিটা বন্ধ হয়নি। ছাত্রদল, বাগছাস, শিবির—যেই সংগঠনগুলোর কথাই বলি না কেন, সবাই তাদের যে মূল দল, প্যাটারন্যাল দল তাদের সাথে তাদের সম্পর্ক খুবই পরিষ্কার।’
তিনি আরও বলেন, ‘কিছু দিন আগে একজনকে (একটি ছাত্রসংগঠন) বহিষ্কার করেছে। কারণ সে দলের অনুমতি ছাড়া ডাকসুতে প্রার্থী হয়েছেন। ছাত্ররাজনীতি কোন লেজুড়বৃত্তিক হবে না, ছাত্রদের যে সাধারণ স্বার্থ সেটা দেখবে, এই প্রত্যাশাটা জুলাই-পরবর্তী এখনো দেখছি না। জুলাই-পরবর্তী এক বছর পরও আমরা সেই লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতিটা রয়েই গেছে।’
এ সময় তিনি আশঙ্কা করেন, আগামী দিনে জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে একটি রাজনৈতিক সরকার এলে ছাত্ররাজনীতি সেই আগের ভয়াল রূপ ধারণ করতে পারে।