গণঅভ্যুত্থানে শহীদের কথা
শহীদ শাহীকে মেডিকেলে পড়ানোর ইচ্ছা ছিল পরিবারের, অকালেই ঝরল স্বপ্ন
- এমএ আরাফাত ভূঞা, ফেনী প্রতিনিধি
- প্রকাশ: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:০৭ AM , আপডেট: ১১ জানুয়ারি ২০২৫, ০৯:৩৭ AM
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শুরু থেকেই সক্রিয় ছিলেন ছাইদুল ইসলাম শাহী (২০)। আন্দোলন যখন তুঙ্গে, তখন সারা দেশের মতো ফেনীও উত্তাল। ৪ আগস্ট ২০২৪। আন্দোলনে অংশ নিতে সেদিন ফেনীর মহিপালে যান শাহী। মহিপাল ফ্লাইওভারের পাশে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার সঙ্গে জমায়েত হন তিনি। ওইদিন দুপুরের দিকে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা অতর্কিত চারদিক ঘেরাও করে গুলি করতে থাকে। গুলিতে মারাত্মক আহত হন শাহী। তার পিঠে ৩টি ও কানের নিচে একটি গুলি লাগে। মহিপাল সার্কিট হাউজ রোডে পড়ে থাকে তার নিথর দেহ। স্থানীয়রা উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়ার পথেই মৃত্যু হয় তার।
জানা গেছে, ছাইদুল ইসলাম শাহী ফেনী সদর উপজেলার ফাজিলপুর ইউনিয়নের ৫ নম্বর ওয়ার্ড লকিয়ত উল্ল্যাহ সওদাগর বাড়ির মো: রফিকুল ইসলামের ছেলে।
ছেলে হারানোর শোকে এখনও কাঁদছেন মা রাহেনা বেগম। কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলের সাহসিকতার বর্ণনা দিয়ে মা রাহেনা বেগম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শাহী সেদিন আন্দোলনে অংশ নিতে আমার কাছে ২৫ টাকা গাড়ি ভাড়া চায়। কিন্তু আমার কাছে না থাকায় তার বাবা থেকে ২৫ টাকা নিয়ে ফেনীর মহিপালে যায়। সেদিন ঘর থেকে বের হওয়ার আগে সে আমাকে বলেছিল, তার কাছে ২৫ টাকা আছে, আরও ২৫ টাকা পেলে ফেনী গিয়ে ফিরে আসতে পারবে।
‘আন্দোলনের শুরুর পর থেকেই সে প্রতিদিন ফেনী গিয়ে অংশগ্রহণ করত এবং আমাকে জানিয়ে যেত। আমি কখনও তাকে যেতে বারণ করিনি। তবে আমাদের সংসারটা অভাবের, তার বাবা লেগুনা গাড়ি চালান। আর্থিকভাবে সচ্ছল না হওয়াতে আমি তাকে কখনো ঠিকমতো টাকা দিতে পারিনি’—যোগ করেন শাহীর মা।
মা রাহেনা বেগম আরও বলেন, সেদিন মহিপালে আন্দোলনে যাওয়ার আগে আমাকে বলেছিল এবার শেখ হাসিনা সরকারের পতন না হলে আর কখনোই হবে না, প্রয়োজনে মা তোমাকেও আন্দোলনের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। আমার তিন ছেলের মধ্যে শাহী দ্বিতীয়। ধারদেনা করে তাদের পড়াশোনা করিয়েছি। অনেক স্বপ্ন ছিল শাহীকে নিয়ে কিন্তু সন্ত্রাসীরা তা পূরণ হতে দেয়নি। আমার ছেলেটারে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি আমার ছেলের হত্যার সুষ্ঠু বিচার চাই।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে শহীদ শাহীর বাবা মো: রফিকুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘আমার ইচ্ছা ছিল ছেলেকে ডাক্তার বানাব। মেডিকেলে পড়াব। কিন্তু আমার সেই স্বপ্ন আর পূরণ হলো না। আমার তিন সন্তানের মধ্যে শাহী সবচেয়ে মেধাবী ছিল। কিন্তু তারা আমার ছেলেটাকে মেরে ফেলল।’
শাহীর বড় ভাই শহিদুল ইসলাম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার ভাই আমাদের সবার থেকে আলাদা ছিল। খুব কম কথা বলত কিন্তু তার মনের ভেতরে দেশের জন্য গভীর ভালোবাসা ছিল। আমার ভাই ২০১৮ কোটা আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলনেও অংশগ্রহণ করে। ২০২৪ এর আন্দোলনেও একজন সাধারণ শিক্ষার্থী হিসেবে আন্দোলনে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা তাকে গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করেছে।
আরও পড়ুন: মায়ের ওড়না মাথায় বেঁধে আন্দোলনে যান শ্রাবণ, ফেরেন লাশ হয়ে
৪ আগস্টের কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, সেদিন বাড়ি থেকে মা কল দিয়ে বলছিলেন, শাহী তো গুলি খেয়েছে। আমি হতভম্ব হয়ে গুলি কীভাবে খেয়েছে, তা জানতে চেয়েছিলাম। তখন মা বললেন, শাহীর বন্ধুর কাছ থেকে একটা কল এসেছে। তার বন্ধুর নাম্বার নিয়ে আমি তাকে কল দিয়েছিলাম তখন তার বন্ধু বলেছে ভাইয়া, আপনি টেনশন করবেন না, সে (শাহী) পায়ে একটা গুলি খেয়েছে। আপনি তাড়াতাড়ি ফেনী চলে আসেন। আমি তখন বারৈয়ারহাট ছিলাম। সেখান থেকে সিএনজি নিয়ে কোনো রকমে ফেনী সদর হাসপাতালে পৌঁছাই। সেখানে গিয়ে দেখি তিনটি লাশ পড়ে আছে তাদের মধ্যে আমার ভাইয়ের লাশটি দেখতে পাই।
পরিবারের কথা তুলে ধরে শহীদ শাহীর বড় ভাই আরও বলেন, আমি একটি সামান্য চাকরি করি। আমাদের মা অসুস্থ প্রতিদিন তিনি শাহীর জন্য কান্না করেন। তবে এটি আমাদের জন্য গর্বের বিষয় যে আমার ভাই দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। ভাই হারানোর কষ্ট অবশ্যই আছে, কিন্তু তার আত্মত্যাগ আমাদের অনুপ্রেরণা দেয়।
শাহীর বাল্যকালের বন্ধু নিশাদুল ইসলাম সৌরভ দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, শাহীর সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল ৪ আগস্টের দিন সকালে। শাহীর দেশের প্রতি গভীর ভালোবাসা ছিল। দেশের নানা অন্যায় ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সে সবসময় সরব থাকত। খেলাধুলার প্রতি তার প্রবল আগ্রহ ছিল এবং সে চট্টগ্রামে বিভাগীয় পর্যায়েও ফুটবল খেলেছে। তার স্বপ্ন ছিল পরিবারের অভাব-অনটন দূর করে মায়ের কষ্ট লাঘব করা।
শহীদ শাহীর আন্দোলনের সহযোদ্ধা শাহারিয়ার আলম মাহিন বলেন, শাহীর সাথে আমার পরিচয় ছিল অনেক আগে থেকেই। যদিও দীর্ঘদিন দেখা হয়নি, ৪ আগস্ট মহিপালে আন্দোলনের সময় শাহীর সাথে আমার দেখা হয়। সেদিন সে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিল, ‘হাল ছাড়া যাবে না ভাই।’ সেদিনই সে আমাকে লটকন খেতে দিয়েছিল। কিন্তু দেখা হওয়ার মাত্র আধা ঘণ্টা পরেই শুনি সে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।
আরও পড়ুন: বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গিয়ে প্রেম, অতঃপর বিয়ে
ছাইদুল ইসলাম শাহী ২০০৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জন্মগ্রহণ করেন। পরিবারের তিন সন্তানের মধ্যে তিনি দ্বিতীয়। শিক্ষাজীবনের প্রাথমিক পর্যায়ে তিনি ২০২১ সালে ফাজিলপুর ডব্লিউ-বি কাদরী উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষা পাশ করেন।
পরবর্তীতে ২০২৩ সালে বারৈয়ারহাট কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করার কথা থাকলেও, পরিবারের আর্থিক সমস্যার কারণে পরীক্ষায় বসতে পারেননি। ২০২৪ সালে তিনি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশগ্রহণের পরিকল্পনা করেন। এছাড়াও তিনি স্থানীয় একটা ডেন্টাল কেয়ারে ডাক্তারের সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন।