চব্বিশ নয়, শিবিরের একাত্তর-নব্বইয়ের ভূমিকা নিয়ে আপত্তি একাধিক ছাত্রসংগঠনের
গত ২৯ অক্টোবর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে (জাবি) ইসলামী ছাত্রশিবিরের তিন নেতার প্রকাশ্যে আসার ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে মধ্যরাতে ক্যাম্পাসে বিক্ষোভ মিছিল বের করে প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের নেতাকর্মীরা। সেসময় ছাত্রশিবির স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করার অধিকার রাখে না উল্লেখ করে সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সংগঠক সোহাগী সামিয়া বলেছিলেন, ‘১৯৭১ সালে যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে দাঁড়িয়েছিল, সেসব ব্যক্তি কারা ছিল—তার চেয়ে আমাদের কাছে বড় হিসাব হলো, কোন সংগঠন ছিল। আজ ২০২৪ সালে দাঁড়িয়ে আপনি সেই সংগঠনের আদর্শকে ধারণ করে এখানে রাজনীতি করতে আসছেন, যে সংগঠন বাংলাদেশকে কোনো দিন চায়নি; স্বাধীনতাকে চায়নি—সেই সংগঠন স্বাধীন বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে রাজনীতি করার অধিকার রাখে না।’
গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর সর্বপ্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে (ঢাবি) প্রথম আত্মপ্রকাশ করে ছাত্রশিবির। তবে শুরুতে অন্যান্য ছাত্রসংগঠনের শিবির প্রশ্নে আপত্তি দেখা যায়নি। যদিও দিন যত গড়াচ্ছে, শিবিরের রাজনীতির বিরুদ্ধে অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের অবস্থান তত শক্ত হচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতির প্রকৃতি ও ধরন’ বিষয়ক কমিটির সঙ্গে ১০ ডিসেম্বর দুই ধাপে ছাত্রসংগঠনগুলোর মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। বিকেলে ছাত্রশিবির সেই আলোচনায় অংশ নিলে সভা ছেড়ে চলে আসে ৩ ছাত্রসংগঠন। ওই তিনটি সংগঠন হচ্ছে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী, সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (মার্ক্সবাদী) ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্ট (বাসদ)।
তাদের ভাষ্য, ২০২৪ সালের জুলাই আন্দোলনে শিবিরের ভূমিকা যাই হোক, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে এবং ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে শিবিরের 'বিতর্কিত' ভূমিকার ব্যাপারে তাদের অবস্থান পরিষ্কার করতে হবে।
বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি নূজিয়া হাসিন রাশা দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধ গণহত্যার সাথে তারা জড়িত। পরবর্তীতে ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনেও তাদের ভূমিকা বিতর্কিত। পরবর্তীতে ক্যাম্পাসের গণতান্ত্রিক সকল ছাত্রসংগঠন এক হয়ে পরিবেশ পরিষদ থেকে শিবিরকে নিষিদ্ধ করলো।
তিনি আরও বলেন, বর্তমানে আমরা দেখছি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শিবিরকে নানাভাবে স্পেস দিচ্ছে। বিভিন্ন ফোরামে তাদেরকে ডাকা হচ্ছে। গতকাল এরকমই একটা প্রোগ্রামে বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীসহ আরো দুটো সংগঠন সভা থেকে ওয়াক আউট করেছিল। আমরা বলতে চাই, ছাত্রশিবিরের পূর্বের অমিমাংসিত ইতিহাস রয়ে গেছে। সামনে তারা কীভাবে রাজনীতি করবে এবং সব বিষয় মীমাংসা করা পর্যন্ত তাদের সাথে গণতান্ত্রিক কোনো সংগঠন বসতে পারি না।
এদিকে গতকাল বুধবার (১১ ডিসেম্বর) বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রী সাধারণ সম্পাদক জাবির আহমদ জুবেল প্রেরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ছাত্রলীগ-ছাত্র শিবিরের মত গণহত্যার সহযোগী শক্তিকে পুনর্বাসন করে ডাকসু নির্বাচনকে বিতর্কিত করা যাবে না।
গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের এই বিজ্ঞপ্তিতে স্বাক্ষর করেন বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর সভাপতি দিলীপ রায়, গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সভাপতি ছায়েদুল হক নিশান, বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রাম পাহাড়ি ছাত্র পরিষদের সভাপতি অঙ্কন চাকমা, বিপ্লবী ছাত্র-যুব আন্দোলনের সভাপতি তওফিকা প্রিয়া এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি রাগীব নাঈম।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়, ১৯৭১ সালে ছাত্র শিবিরের পূর্বসূরি ইসলামী ছাত্রসংঘের সদস্যরা আল-বদর বাহিনী গঠন করে৷ যারা বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল৷ একাত্তরে জামায়াতে ইসলামের খুন ধর্ষণের পক্ষে ছাত্রশিবির দীর্ঘদিন যাবৎ সম্মতি উৎপাদন করে আসছে। নব্বইয়ের গণঅভ্যুত্থানেও বিতর্কিত ভূমিকার জন্য ছাত্রশিবির এবং জাতীয় ছাত্র সমাজ দীর্ঘ তিন দশক যাবৎ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ সংগঠন। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে ফ্যাসিবাদী শক্তির গণহত্যা, নির্যাতন, নিপীড়নের বিরুদ্ধে যে গণ রায় প্রকাশ হয়েছে, ছাত্রলীগ-ছাত্রশিবিরকে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে তাকে ভূলুণ্ঠিত করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক নাছির উদ্দীন নাছির দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমাদের একাত্তর কিংবা নব্বইয়ে যেতে হবে না। তাদের গত চার-পাঁচ মাসের কর্মকাণ্ড দেখলেই বুঝতে পারব শিবিরের মধ্যে কত দ্বিচারিতা রয়েছে। ৫ আগস্টের পূর্বে ৯ দফার ৭ম দফা ছিল দলীয় ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা। আমি এর ঘোর বিরোধিতা করেছিলাম। ৯ দফার আব্দুল কাদের পরিষ্কার করেছেন যে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি শিবিরের ঢাবি শাখার এক নেতা যুক্ত করেছিলেন। ৫ আগস্ট পরবর্তীতেও দেখবেন বিভিন্ন ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি নিয়ে মিছিল হয়েছে। সবগুলোর নেতৃত্বে ছিল শিবির। উদাহরণস্বরূপ, ঢাবিতে যে মিছিল হয়েছিল তার নেতৃত্বে ছিল শিবিরের নেতা মাজহারুল ইসলাম।
তিনি আরও বলেন, শিবিরের নেতাকর্মীরা ছাত্রদলের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে এবং বিষোদ্গার করছে। যারা গুপ্ত রাজনীতি করে এবং রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি করে তাদেরকে মেইনস্ট্রিমে আসতে দিলে বরং ছাত্ররাজনীতির সৌন্দর্য নষ্ট হবে। আমি কিংবা ছাত্রদল কেউ তাদেরকে নিষিদ্ধ করতে পারবেনা। কিন্তু তাদের গুপ্ত পলিসির কারণে সকল ছাত্রসংগঠন তাদেরকে বয়কট করছে।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি রাগীব নাঈম দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা ও গণহত্যায় অংশগ্রহণের জন্য তাদের এবং তাদের বন্ধুদের প্রকাশ্যে ভুল স্বীকার করে স্পষ্টীকরণ বক্তব্য দিতে হবে। আমাদের বহু সহযোদ্ধার রক্তে শিবিরের হাত রঞ্জিত, প্রত্যেকটা হত্যার বিচার করতে হবে।
ছাত্রশিবিরের ঢাবি শাখার সাধারণ সম্পাদক এসএম ফরহাদ বলেন, ৯ দফা দেওয়ার সময় আমাদের প্রাইমারি কনসার্ন ছিল আবাসিক হলে সাধারণ শিক্ষার্থীরা যারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ছাত্রলীগকে পিটিয়ে বের করেছে তারা যেন পরবর্তীতে নির্যাতনের শিকার না হয়। আওয়ামী লীগ যেহেতু ক্ষমতায় ছিল এবং তাদের পতনও হয়নি তখনও আমরা ১ দফায় আসতে পারিনি। ছাত্রলীগের আগ্রাসী মনোভাবকে ট্যাকেল দেওয়ার জন্য মূলত এই দফাটা সংযুক্ত করা হয়েছিল। এখন ছাত্রলীগের সেই সন্ত্রাসী চ্যালেঞ্জ নেই এবং ছাত্ররাজনীতির সুন্দরতম সংস্কারের সুযোগ রয়েছে। আমরা সংস্কারের কথা বলে আসছি। তারপরেও যারা আমাদের ব্যাখ্যাকে ভিন্নভাবে দেখে, তাদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যের ব্যাপারে আমরা সন্দিহান।
শিবিরের ঢাবি শাখার প্রচার ও মিডিয়া সম্পাদক হোসাইন আহমাদ জুবায়ের বলেন, নয় দফায় লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের আলাপ এসেছিল সে সময়ে হলের ছাত্ররা দুঃসাহসী ভূমিকা রেখে সন্ত্রাসী সংগঠন ছাত্রলীগকে হল ও ক্যাম্পাস থেকে বিতাড়িত করেছিলো ওই সকল ছাত্রের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা বিষয়টি মাথায় রেখে। যেহেতু তখনো আন্দোলন একদফায় পৌঁছানো সম্ভব হয়নি।
তিনি আরও বলেন, দেশ ফ্যাসীবাদমুক্ত হওয়ার পরে আমরা স্বয়ং গঠনমূলক ছাত্ররাজনীতি চর্চার অংশ হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের প্রয়োজনীয় এজেন্ডা নিয়ে নিয়মিত বিভিন্ন শিক্ষার্থী-সম্পৃক্ত কর্মসূচি পালন করে আসছি। এখন এসে ছাত্রশিবিরের ব্যাপারে ছাত্র রাজনীতি সংক্রান্ত উত্থাপিত অভিযোগসমূহ সদুদ্দেশ্য প্রণোদিত বলে আমরা মনে করি না৷
তিনি যোগ করে আরও বলেন, নতুন ধারার গঠনমূলক ছাত্ররাজনীতির কথা যারা বক্তৃতা ও বিবৃতিতে বলেছেন তাদের উচিত সেই বক্তব্যকে বাস্তবে প্রমাণ করা। সেটি না করে প্রতিযোগী সংগঠন বা ভিন্নমতকে মোকাবেলার পুরানো ফ্যাসিবাদী পন্থা কেউ বেছে নিলে শিক্ষার্থীরা তাদের প্রত্যাখ্যান করবে।
ছাত্রসংঘ থেকে ছাত্রশিবির
১৯৭১ সালের পূর্বে জামায়াতের তৎকালীন ছাত্রসংগঠনের নাম ছিল ইসলামী ছাত্রসংঘ। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালের সংবিধানের ৩৮ ধারা অনুযায়ী রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়। যেহেতু জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতির মূল উপজীব্য ধর্ম, সেজন্য স্বাধীন বাংলাদেশে দলটির সাংগঠনিক অস্তিত্ব দৃশ্যত বিলীন হয়ে যায়। শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনামলে রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর কোন অস্তিত্ব ছিল না।
কিন্তু দৃশ্যপট বদলে যেতে থাকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট মুজিব হত্যাকাণ্ডের পর। ১৯৭৬ সালের ৩রা মে রাষ্ট্রপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম কর্তৃক একটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৮ নম্বর ধারা বাতিল করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতির উপর নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়। এরপর ১৯৭৭ সালে পরিবর্তিত পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে সংগঠনটি ‘বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবির’ নামে আত্মপ্রকাশ করে। ১৯৭৭ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে শিবিরের যাত্রা।