আন্দোলনে চোখ হারানো সাকিবের ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তির স্বপ্নও শেষ হওয়ার পথে
নাম সাকিব আল হাসান। বয়স ১২ বছর। তৃতীয় শ্রেণিতে পড়তেন। নেশাগ্রস্ত বাবা স্কুলে যেতে না দেয়ায় পালিয়ে স্কুলে যেতেন। কিন্তু ২০২৪ সালের শুরুর দিকে স্কুলে যাওয়ার অপরাধে বাবা মারধর করায় পড়াশোনা আর চালিয়ে নিতে পারেননি। যদিও স্বপ্ন দেখা থামাননি সাকিব। তবে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে গত ১৯ জুলাই রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট এলাকার ইসিবি চত্বরে পুলিশের গুলিতে আহত হন। ডান চোখ হারিয়ে এখন স্কুলে যাওয়ার স্বপ্ন পুরোপুরি নিভে গেছে বলে মনে করছেন সাকিব। আন্দোলনে কেন গিয়েছেন প্রশ্ন করলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন ৪র্থ শ্রেণিতে ভর্তির স্বপ্ন দেখা এই আন্দোলনকারি।
সাকিব জানান, তার স্বপ্ন ছিল পড়াশোনা করে অনেক বড় হবেন একদিন। কিন্তু চোখ হারিয়ে হাসপাতালে ভর্তি থাকায় ক্লাসে ফেরার স্বপ্ন এখন অনিশ্চিত। ডান পাশের চোখ পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালে সম্ভবপর চিকিৎসা হয়েছে। দু’একদিনের মধ্যে ডাক্তার ছেড়ে দেবেন। ছাড়া পেলে রাজধানীর ভাষানটেক মাটিকাটা এলাকায় ফিরে যাবেন। কিন্তু পড়াশোনার খরচ কে বহন করবেন? চিকিৎসার খরচ কোথা থেকে আসবে এসব প্রশ্নের মাঝে আটকে গেছে সাকিবের পরিবারের ভরণপোষণ এবং তাদের মাথা গোঁজার বিষয়টি।
‘বাবা আমাদের খোঁজ রাখেন না। আমাদের মা মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চালান। যে সামান্য টাকা উপার্জন করেন সেটা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। আমাদের জন্য সরকার দীর্ঘস্থায়ী কিছু না করলে চিকিৎসা এবং বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে— আন্দোলনে আহত হয়ে চোখ হারানো সাকিব আল হাসান
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, মানুষের বাসা বাড়িতে মায়ের কাজ করে উপার্জিত অর্থ দিয়ে চলে তাদের সংসার। মায়ের ভাষ্য, ‘আমার সংসার নুন আনতে পান্তা ফুরায়। এখন সাকিবের দেখভাল করব নাকি বাসা-বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাব, সেটা জানা নেই। কেউ আমার ছেলেটার চিকিৎসা ও পড়াশোনার খরচ বহন করলে বড় কৃতজ্ঞ থাকতাম।’
গত ১৯ জুলাই আহত হওয়ার পরে ২০ জুলাই সাকিবের মা তাকে হাসপাতালে এনে চিকিৎসা না করিয়েই ফিরে যান। এ বিষয়ে মা সাবিনা ইয়াসমিন জানান, তখন ছেলেকে চিকিৎসা করার মতো কোনো অর্থ তার কাছে ছিল না। তাই ফিরে যেতে হয়েছিল। পরে অবস্থা খারাপ দেখে গত অক্টোবরের শেষে আবারো তাকে নিয়ে হাসপাতালে আসেন। ছেলের চোখ ভালো হওয়ার কোন সম্ভাবনার কথা ডাক্তার জানাতে পারেনি। বাধ্য হয়েই এখন পরিবারের খরচ যোগাতে হাসপাতাল ছেড়ে বাসায় ফিরে যেতে হবে।
সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘আমার আরেকটি ছোট ছেলে আছে, তাকেও দেখভাল করতে হয়। তাদের খরচ যোগাতে বাসাবাড়িতে কাজ করি। গত ১ মাস কাজ বন্ধ। যাদের বাসায় কাজ করতাম তাদের থেকে কিছু টাকা ধার নিয়ে সাকিবের চিকিৎসার জন্য এসেছি।’
‘আমরা রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করেছি। এখানে যাদের চোখ ভালো হয়নি কিংবা ডাক্তারার কোনো আশা দেখাতে পারেননি। বাইরে নিয়ে গেলেও তাদের চোখ ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই এই মুহূর্তে তাদের ব্যক্তিগত পুনর্বাসন হওয়াটা বেশি জরুরি— অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরী, পরিচালক জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতাল
ছোট্ট সাকিবের চোখ হারানোর বেদনা আজীবন বয়ে বেড়াতে হবে- এমন চিন্তা-দুর্ভাবনাতেই যেন ঘুম নেই সাকিবের মা সাবিনা ইয়াসমিনের। তার ভাষ্য, ‘সারাজীবনের জন্য আদরের সন্তানের পঙ্গুত্ব বরণ কিছুতেই মানতে পারছি না। এখন একটাই পথ, সারাজীবন ছেলের পাশে থেকে তাকে সাহায্য করা। কারণ, আমার পরিবারে কেউ নেই। তার বাবা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন কয়েক মাস আগে। ছেলে কিংবা স্ত্রীর কোন খোঁজ রাখেন না তার নেশাগ্রস্ত বাবা।’
কথা হয় সাকিবের সাথে। আহত হওয়ার গল্প এবং বর্তমান অবস্থা জানতে চাইলে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে ভর্তি হওয়ার স্বপ্ন দেখা এই শিক্ষার্থী। তিনি বলেন, ‘আমি বন্ধুদের সাথে আন্দোলনে গিয়েছিলাম। কিন্তু এভাবে চোখ হারাতে হবে বুঝতে পারিনি। আমি পড়াশোনা চালিয়ে নিতে চাই। এই মুহূর্তে দেখার কেউ নেই। বাবা আমাদের খোঁজ রাখেন না। আমাদের মা মানুষের বাসায় কাজ করে সংসার চালান। যে সামান্য টাকা উপার্জন করেন সেটা দিয়ে সংসার চালানো কষ্টকর। আমাদের জন্য সরকার দীর্ঘস্থায়ী কিছু না করলে চিকিৎসা এবং বেঁচে থাকা কষ্টকর হবে।’
সাকিবের মা জানিয়েছেন, সম্প্রতি সরকারের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকা পেয়েছেন তারা। তবে এই অর্থ দিয়ে স্থায়ী কোনো পুনর্বাসন সম্ভব নয়। গ্রামের বাড়ি শেরপুরেও তাদের কোনো ঠাঁই নেই। ফলে সরকারের পক্ষ থেকে স্থায়ী পুনর্বাসনের দাবি জানান জুলাই আন্দোলনের এই ভুক্তভোগী পরিবার।
আরও পড়ুন: ‘আমাকে এখন পর্যন্ত কেউ দেখতে আসেনি, কারণ আমার পরিবারে কেউ নেই’
জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. খায়ের আহমেদ চৌধুরীর সঙ্গে আহত রোগীদের বিষয়ে কথা বললে তিনি জানান, ‘আমরা রোগীদের সর্বোচ্চ চিকিৎসা নিশ্চিত করেছি। এখানে যাদের চোখ ভালো হয়নি কিংবা ডাক্তারার কোনো আশা দেখাতে পারেননি। বাইরে নিয়ে গেলেও তাদের চোখ ভালো হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। কাজেই এই মুহূর্তে তাদের ব্যক্তিগত পুনর্বাসন হওয়াটা বেশি জরুরি।’